দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বিপক্ষে দুই ম্যাচে কেমন খেলল আনচেলত্তির ব্রাজিল
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন ‘ফর্ম’ বা ‘আইডিয়াজ’-এর কথা। তাঁর মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি চিরস্থায়ী, নিখুঁত ও আদর্শ রূপ আছে। আমরা পৃথিবীতে যা দেখি, তা আসলে সেই নিখুঁত রূপেরই অনুকরণ। যেমন কালো রঙের একটা নিখুঁত ধারণা আমাদের মনের ভেতরে আছে বলেই আমরা চারপাশে কালো রঙের নানা রূপ দেখি। বাস্তবে আমরা যে কালো দেখি, সেটা আসলে সেই নিখুঁত কালোরই প্রতিলিপি।
ফুটবলকে যদি প্লেটোর এই ধারণার আলোকে দেখি, তবে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সৃষ্টি ‘জোগো বনিতো’কে নিখুঁত ফুটবল বলা যায়। আমরা যে ফুটবলের নান্দনিকতা, কৌশল আর সৌন্দর্য দেখি, তা মূলত সেই নিখুঁত ফুটবলেরই প্রতিফলন। আমাদের চোখ সব সময় সেই আদর্শ ফুটবল খুঁজে বেড়ায়। কোথাও তার আভাস পেলেই আমরা উল্লসিত হয়ে উঠি। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই প্রত্যাশা থাকে ব্রাজিলের কাছেই, যারা নিজেরাও অনেক আগেই সেই খেলা পেছনে ফেলে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ ঘিরে আবারও সামনে এসেছে ‘জোগো বনিতো’র আলাপ। সেদিন ৯০ মিনিট ধরে অসাধারণ ফুটবল খেলেছিল ব্রাজিল। এরপরই কিছু সংবাদমাধ্যম ও সমর্থক প্রশ্ন তোলে—ব্রাজিলের ‘জোগো বনিতো’ কি আবার ফিরে এল? তবে প্লেটোর ফর্মের যুক্তি মেনে নিলে, সেই নিখুঁত রূপ আসলে কোথাও নেই।
বরং মনে হয়, ব্রাজিলও হয়তো ভুলে গেছে সেই রূপটা কেমন ছিল। কিন্তু হারানো ঐতিহ্যের প্রতি টানই মাঝেমধ্যে আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই খেলার কথা। ‘জোগো বনিতো’র আলোচনাটা সরিয়ে রাখলেও, সেদিন ৫–০ গোলে জেতার পথে ব্রাজিলের ফুটবল সত্যিই ছিল চোখধাঁধানো। অনেক দিন পর সমর্থকেরা হয়তো খেলা দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন। যদিও পরের ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে সেই ব্রাজিলকে পাওয়া গেল সামান্যই।
প্রথমার্ধে ২–০ গোলে এগিয়েও শেষ পর্যন্ত ৩–২ গোলে হেরে যায় ব্রাজিল। আনচেলত্তি এ ম্যাচে দলে অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন। তবু প্রশ্ন উঠতেই পারে—আসল ব্রাজিল কোনটা? দক্ষিণ কোরিয়াকে উড়িয়ে দেওয়া দল, নাকি জাপানের বিপক্ষে এগিয়েও হেরে যাওয়া দল? হয়তো আসল ব্রাজিলকে খুঁজতে হবে এই দুই রূপের মাঝামাঝি কোথাও।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ম্যাচ মিলিয়ে ব্রাজিলের পারফরম্যান্সকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। দুই ম্যাচের চার অর্ধের মধ্যে তিনটিতেই তারা খেলেছে আশাজাগানো ফুটবল। জাপান ম্যাচের পর ব্রুনো গিমারেসও বলেছেন একই কথা। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিল সাম্প্রতিক সময়ের সেরা ৪৫ মিনিট খেলেছে বললেও বাড়াবাড়ি হবে না।
সিউলে সেই ম্যাচে প্রথম মিনিট থেকেই ব্রাজিলের খেলা ছিল মুগ্ধতা–জাগানিয়া। গতি, ছন্দ, কৌশল আর বোঝাপড়া—সবই ছিল নিখুঁত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলা যেন পুরোনো ওয়াইনের মতো আরও পরিপূর্ণ হয়েছে। শুধু আক্রমণ নয়, রক্ষণ সামলানো আর মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণেও তারা ছিল দুর্দান্ত। সব মিলিয়ে দলীয় নৈপুণ্যের এক অবিশ্বাস্য প্রদর্শনী। ম্যাচ শেষে আনচেলত্তি বলেছিলেন, ‘এটা ছিল পুরোপুরি দলীয় পারফরম্যান্সের দারুণ প্রদর্শনী। বলের দখল থাকুক বা না থাকুক, দুই পরিস্থিতিতেই আমরা দারুণ খেলেছি। দলের নিবেদন ছিল অসাধারণ।’
তবে শুধু দলীয় নৈপুণ্যের কথা বললে অন্যায় হবে। ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো, এস্তেভাও আর কাসেমিরোর ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ছিল সেই ম্যাচের ‘চেরি অন দ্য কেক’। ওয়ান টাচ ফুটবল, ড্রিবলিং, পাসিং কিংবা ফিনিশিং—সবই ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে মনে হচ্ছিল, ব্রাজিল একাই খেলছে। প্রতিপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়াকে যেন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
এই ধারাবাহিকতা জাপানের বিপক্ষে প্রথমার্ধেও দেখা গিয়েছিল। আগের ম্যাচের কয়েকজনকে বিশ্রাম দিয়ে নতুন একাদশ সাজিয়েছিলেন আনচেলত্তি। শুরুতে তেমন বোঝা যায়নি। জাপান অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ার মতো জায়গা দেয়নি। পাঁচজন নিয়ে রক্ষণে ছিল তারা, ফলে ব্রাজিলের স্বাভাবিক গতি কিছুটা থেমে যায়। তবু ধৈর্য ধরে নিজেদের পায়ে বল রেখে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ব্রাজিল। সেই সুযোগও তারা পেয়েছিল, যার ফলেই আসে দুটি গোল।
সিউলে সেই ম্যাচে প্রথম মিনিট থেকেই ব্রাজিলের খেলা ছিল মুগ্ধতা–জাগানিয়া। গতি, ছন্দ, কৌশল আর বোঝাপড়া—সবই ছিল নিখুঁত।
কিন্তু বিরতির পর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই ব্রাজিলকে। গতি, ছন্দ, কৌশল—কিছুই ছিল না। ছন্নছাড়া ফুটবল খেলে একে একে তিন গোল হজম করে ম্যাচও হেরে যায় তারা। আগের ১৩৫ মিনিটের সুর যেন হঠাৎ থেমে গেল। ফলে দুর্দান্ত সূচনা করা এশিয়া সফর শেষ হয় কিছুটা তিক্ত স্বাদ নিয়ে।
ব্রাজিলের জন্য ভয়টা এখানেই। ২০২২ বিশ্বকাপেও তারা দুর্দান্তভাবে শুরু করেছিল। কিন্তু ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় শেষ আট থেকে। বিশ্বকাপের মতো আসরে এই ভেঙে পড়া ঠেকানোই হবে আনচেলত্তির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ম্যাচ শেষে গিমারেসও সতর্ক করে বলেছেন, ‘আজকের ম্যাচ থেকে অনেক ইতিবাচক দিক আমরা নিতে পারি। কিন্তু শেষ ৪৫ মিনিটে যে ভুলগুলো করেছি, সেগুলো আর হওয়া চলবে না।’
তবু ভুলের আড়ালেও এই দুই ম্যাচে ব্রাজিলের বড় প্রাপ্তি আত্মবিশ্বাস আর সমন্বয়। আনচেলত্তির ‘ম্যান ম্যানেজমেন্ট’ অল্প সময়েই ফুটে উঠতে শুরু করেছে। নেইমারের পর দলের সবচেয়ে বড় তারকা ভিনিসিয়ুস ইতিমধ্যেই নিজের সেরাটা দিতে শুরু করেছেন। রদ্রিগো, কাসেমিরো, গিমারেস আর রাফিনিয়ারা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ছাড়িয়ে এখন দলের জন্য খেলছেন। আরেক বড় প্রাপ্তি এস্তেভাও। ১৮ বছর বয়সী এই উইঙ্গার সুযোগ পেয়েই নিজেকে মেলে ধরেছেন। তাঁর খেলায় আছে সুবাসও, কার্যকারিতাও। বিশ্বকাপেও আনচেলত্তির তুরুপের তাস হতে পারেন এই তরুণ।
সব মিলিয়ে এই দুই ম্যাচকে আয়না হিসেবে নিতে পারেন আনচেলত্তি। যেখানে দলের ইতিবাচক দিক যেমন স্পষ্ট, তেমনি চোখে পড়ে উন্নতির জায়গাগুলোও। সামনের দিনগুলোয় এই শিক্ষাই হয়ে উঠতে পারে ব্রাজিলের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা।