৪৬ মাসে কাবরেরার অধীনে বাংলাদেশের কী ভালো, কী মন্দ
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বে আছেন হাভিয়ের কাবরেরা। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে তিনি এখন তৃতীয় দফা দায়িত্ব পালন করছেন, যা শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের ৩১ মার্চ। তবে হংকংয়ের বিপক্ষে ৯ অক্টোবর ঢাকায় এশিয়ান কাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ৪-৩ গোলে হারের পর একাদশ নির্বাচন ও কৌশল নিয়ে আবারও সমালোচনার তিরবিদ্ধ হচ্ছেন কাবরেরা। এখন তাঁর ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে হংকংয়ের বিপক্ষে আগামীকাল এশিয়ান কাপের ফিরতি ম্যাচের ফলাফলের ওপর।
কাবরেরার ৪৬ মাসে বাংলাদেশ জাতীয় দল ম্যাচ খেলেছে ৩৪টি। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে কাবরেরাই সবচেয়ে বেশি ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন। জয়ের হার ২৬.৪৭। জেমি ডের ৩৬ মাসে ২৯ ম্যাচে ড্র ৫, ১৫ হার। জয় ৯টি। জয়ের হার ৩১.০৩। জেমি আর কাবরেরা প্রায় একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। কাবরেরারও জয় ৯, ড্র ৮, ১৭ হার। তাঁর অধীনে অনূর্ধ্ব-২৩ দল এশিয়ান গেমসে তিন ম্যাচের একটি ড্র করেছে, হেরেছে দুটি।
কাবরেরার সময়ে কোনো ট্রফি জেতেনি বাংলাদেশ, পায়নি চমক জাগানিয়া কোনো জয়। ৯টি জয়ের মধ্যে ৩টি করে জয় এসেছে মালদ্বীপ ও ভুটানের বিপক্ষে। অন্য ৩টি জয়ের ২টি কম্বোডিয়ার বিপক্ষে ও ১টি অপেশাদার দল সেশেলসের বিপক্ষে। ৯ জয়ের মাত্র ২টি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে, অন্যটি বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্লে–অফে। বাকিগুলো প্রীতি ম্যাচ।
ভুটানের কাছে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দুবার হেরেছে। ২০১৬ সালে প্রথম, দ্বিতীয়টি কাবরেরার সময়ে। গত বছর সেপ্টেম্বরে থিম্পুতে ১-০ গোলে হার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কাবরেরার অধীনে ৩-১ গোলে হার। অঞ্জন বিস্তার হ্যাটট্রিকে নেপাল ৩৮ বছর পর বাংলাদেশের জালে ৩ গোল দেয়। কাবরেরার সময়ে বাংলাদেশ হেরেছে সেশেলসের কাছেও।
কাবরেরার অধীনে বাংলাদেশ ২০২২ সালে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ডের তিন ম্যাচেই বাহরাইন, তুর্কমেনিস্তান ও মালয়েশিয়ার কাছে হেরেছে। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতে হার ও একটিতে ড্র। ২০২৩-২৪ মৌসুমে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই জয়হীন। লেবাননের সঙ্গে একটি ম্যাচ ড্র করেছে ১-১ গোলে।
ফিফা র্যাঙ্কিংকে কোনো দেশের ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার মানদণ্ড ধরা হলে সেখানেও বাংলাদেশ আছে অনেকটা আগের অবস্থানেই। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তাঁর শুরুর সময়ে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং ছিল ১৮৬, মাঝে কিছুটা পিছিয়ে (১৯২) গেলেও এখন আবার ১৮৪।
বাফুফে বিদেশি কোচ আনে মূলত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে। কাবরেরাও ব্যতিক্রম নন। তাঁর অধীনে বাংলাদেশ সাফ ফুটবলে একটি আসরই খেলেছে। ২০২৩ সালের সেই বেঙ্গালুরু সাফে ১৪ বছর পর সেমিফাইনালে খেলাটাই কাবরেরার সেরা অর্জন। ২২ বছর ধরে দেশের ফুটবলে চলা ট্রফি খরা অব্যাহত আছে কাবরেরা যুগেও।
কোচ এনেই তাঁকে বাদ দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছে বাফুফে। অথচ একসময় সাফল্য দিয়েও কোটান-জর্জেভিচদের মতো কোচকে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হয়েছে। কাবরেরাকে সময় দেওয়াটা দেশের ফুটবলের ইতিবাচক দিকই বলতে হয়। তবে কোচকে বাফুফে কতটা কাজে লাগাল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। জেমি ডের মতো কাবরেরাও ম্যাচের পরদিন চলে যান দেশে। আবার আসেন পরের ম্যাচের আগে।
গত কয়েকটি ম্যাচে অবশ্য কাবরেরার বাংলাদেশ মাথা উঁচু করেই মাঠ ছেড়েছে। সর্বশেষ হংকং ম্যাচে হারলেও দলের পারফরম্যান্স প্রশংসাই পেয়েছে সবার। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশরাফউদ্দিন আহমেদ এটাকে একদিক থেকে অগ্রগতিই মনে করেন, ‘কাবরেরার সময় বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ৯০ মিনিট খেলার সামর্থ্য বেড়েছে। বল পায়ে না রাখার সময় খেলোয়াড়দের রানিংয়ে উন্নতি হয়েছে। নিজেদের ওপর আস্থা বেড়েছে। যে কারণে হংকংয়ের সঙ্গে ছেলেরা ম্যাচটা ৩-৩ করতে পেরেছিল।’ তবে একটা কারণে কাবরেরাকে ‘খণ্ডকালীন’ কোচই মনে হয় আশরাফউদ্দিনের, ‘কোচ তো ঢাকাতেই থাকে না! বাফুফে কীভাবে এটা মেনে নেয় বোঝা কঠিন।’
কোচ হিসেবে কাবরেরাকে নিয়ে হতাশ জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার জাহিদ হাসান, ‘কাবরেরার প্রায় চার বছরে কোনো অর্জন নেই। এরপরও এত দিন তিনি কীভাবে থাকলেন, সেটাই এখন বের করা করা উচিত।’ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলামও এমিলির সঙ্গে অনেকটা একমত, ‘তাঁর সময়ে দেশের ফুটবল কিছুই পায়নি। বড় কোনো ম্যাচ জেতেনি। অর্জন পুরোপুরি শূন্য।’ জাতীয় দলের সাবেক গোলকিপার আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘জাতীয় দলের ফল আগে যেমন গতানুগতিক ছিল, এখনো তা-ই আছে। আগের চেয়ে ভালো হয়েছে বলার সুযোগ নেই।’
ফলাফলে খুব বেশি পার্থক্য না এলেও কাবরেরার শেখানো ফুটবল খেলে মাঠে দর্শক টানতে পারছে জাতীয় দল। মাঠে লড়াই করছেন ফুটবলাররা। হামজা চৌধুরী আসার পর তো ফুটবল উন্মাদনা তুঙ্গে পৌঁছেছে। শমিত সোম, ফাহামিদুলরা যোগ হওয়ায় অতীতের চেয়ে দল এখন অনেকটাই শক্তিশালী। পরিবর্তনটা চোখে পড়ছে সবারই। তবে ফুটবলের জনপ্রিয়তা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কোচের অবদান নয়, হামজার আসাটাকেই বড় করে দেখছেন আশরাফুল, ‘হামজা ছাড়া গত মাসে নেপালে সঙ্গে বাংলাদেশ গোলশূন্য ড্র করেছে। হামজাকে আনতে পারাটা বাফুফের বড় অর্জন। হামজা দলটাকে উজ্জীবিত করতে পেরেছেন।’