মরক্কো ফুটবলের মায়েরা

গ্যালারিতে থাকা মাকে মাঠে এনে নাচ শুরু করে দেন মরক্কোর মিডফিল্ডার সোফিয়ান বুফাল। পরশু বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল শেষেছবি: রয়টার্স

রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর জয়ী দলের খেলোয়াড়েরা কী করেন?

কেউ হাঁটু গেড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্মরণ করেন সৃষ্টিকর্তাকে, কেউ ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন সতীর্থদের। জয় উদ্‌যাপনে কেউ হাসেন, চিৎকার করেন, কেউবা আবার চোখের জলও ফেলেন। একেকটা জয়ের পর খেলোয়াড়েরা যেসব দৃশ্যের জন্ম দেন, তার সবই দেখা যায় মরক্কো ম্যাচের পরও। তার মধ্যেই একটা দৃশ্য বিরল। একটা উদ্‌যাপন একান্তই তাঁদের।

সতীর্থ আর কোচিং স্টাফদের সঙ্গে দলবদ্ধ উৎসবের পর আশরাফ হাকিমি–হাকিম জিয়েশরা ছুটে যান ভিআইপি স্ট্যান্ডের দিকে, যেখানে বসে আছেন মা। একজন মায়ের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত যদি হয় সন্তানের সাফল্য, সেই মুহূর্তে মায়ের স্পর্শের চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! কপালে মায়ের একটা চুমু, দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরা স্পর্শই যে ছেলের জন্য আনন্দের পূর্ণতা!

মরক্কোর খেলোয়াড়দের মায়ের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার এসব ছবি এখন কাতার বিশ্বকাপের পরিচিত দৃশ্য। টুর্নামেন্টে অপরাজিত থাকা মরক্কো এরই মধ্যে মহাদেশীয় রেকর্ড গড়ে ফেলেছে। প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে। বিশ্বকাপ খেলতে এসে অনেক দলই বলে ‘পরিবার’ হয়ে ওঠার কথা। কাতারে সত্যিকারের ‘পরিবার’ দল মাকে নিয়ে খেলতে আসা মরক্কোই।

সাধারণত মাঠের খেলায় পূর্ণ মনোযোগ রাখতে বিশ্বকাপের সময় পরিবারের সদস্যদের দূরে রাখার পক্ষে থাকেন দল–ব্যবস্থাপকেরা। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও সেটি হয়ে থাকে টুর্নামেন্টের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর। তবে মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই এবং মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন সভাপতি ফৌজি লেকজার ভাবনা ছিল ভিন্ন।

আরও পড়ুন

খেলোয়াড়দের মানসিক শক্তি জোগানোর জন্য শুরু থেকেই খেলোয়াড়দের পরিবার সঙ্গে রাখার সুযোগ করে দেন তাঁরা। স্ত্রী–সন্তানদের পাশাপাশি মা–বাবাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মা, বাবা অথবা মা–বাবা দুজনকেই কাতারে নিয়ে এসেছেন আশরাফ হাকিমি, হাকিম জিয়েশ, ইয়াসিন বুনু, সোফিয়ান বুফাল, আবদেলহামিদ সাবিরিরা। তাঁদের বেশির ভাগই বিশ্বকাপ দেখতে এসেছেন এই প্রথম। থাকছেন ছেলেদের সঙ্গে উইনধাম দোহা ওয়েস্ট বে হোটেলে।

কাছাকাছি থাকায় প্রতিদিনই মা–বাবার মুখ দেখতে পাচ্ছেন ছেলেরা। বিশ্বকাপ খেলতে নামছেন গ্যালারিতে বসা পৃথিবীর সবচেয়ে আপন–মানুষগুলোর সামনে। ‘মা আমার খেলা দেখছেন—এই ভাবনা মাঠে জোগাচ্ছে বাড়তি উদ্দীপনা। ম্যাচ জয়ের পর সতীর্থদের সঙ্গে উদ্‌যাপনের পরপরই হাকিমি–জিয়েশরা ছুটে যাচ্ছেন স্ট্যান্ডের দিকে। ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন জয়ের আনন্দ।

আরও পড়ুন

যে ছবি দেখা গেছে বেলজিয়ামকে হারানোর পর, কানাডার বিপক্ষে জয়ের পরও। কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে হারিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করার পর সোফিয়ান বুফাল তো মাকে মাঠেই নামিয়ে আনেন। জয়ের আনন্দে মায়ের হাত ধরে মেতে ওঠেন নাচে। সেই নাচের দৃশ্য এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’। এর আগে গ্রুপ পর্বে বেলজিয়াম ম্যাচের পর মায়ের সঙ্গে আশরাফ হাকিমির ছবিও আলোড়ন তোলে। অন্যের বাসা পরিষ্কার করে যে সন্তানকে বড় করেছেন, বিশ্বকাপ মঞ্চে সে ছেলের সাফল্যে কেঁদে ফেলেন মা সাঈদা মুও।

মায়ের ভালোবাসায় সিক্ত আশরাফ হাকিমি
ছবি: টুইটার

ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে খেলা হাকিমির জন্ম স্পেনে। এক সাক্ষাৎকারে হাকিমি তাঁর বেড়ে ওঠার কথা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মা অন্যের ঘর পরিষ্কার করতেন। বাবা ছিলেন ফেরিওয়ালা। যাঁরা জীবিকার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। আজ আমি প্রতিদিন তাঁদের জন্য লড়াই করি। তাঁরা আমার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। আমার সফলতার জন্য অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।’

কমবেশি এমন সন্তানের জন্য উৎসর্গের গল্প আছে মরক্কোর অন্য ফুটবলারদের মা–বাবারও। তিন বছর বয়সী আবদেহামিদ সাবিরিকে নিয়ে তাঁর মা–বাবাকে পাড়ি দিতে হয়েছিল জার্মানি। সেই ছেলের সঙ্গে এখন বিশ্বকাপ দেখতে এসে বেশ আনন্দে দিন কাটছে সাবিরির মা–বাবার। ম্যাচ শেষে সন্তান ছুটে আসছে, ছেলের জন্য গ্যালারিতে উল্লাস হচ্ছে—এমন দৃশ্যে তাঁরা অভিভূত। আল–জাজিরাকে তাঁরা বলেছেন, শুধু নিজের ছেলেই নয়, মরক্কো দলের প্রত্যেক ফুটবলারই তাঁদের কাছে নিজের সন্তানের মতো।

আরও পড়ুন

খেলোয়াড়দের মতো মাকে কাতারে নিয়ে এসেছেন মরক্কো কোচ রেগরাগুইও। স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিতের পর গ্যালারিতে ছুটে গিয়েছিলেন মরক্কোর কোচ। ৪৭ বছর বয়সী রেগরাগুইয়ের বৃদ্ধা মা ফাতিমা বেশ কিছুক্ষণ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। পরে মরক্কোর টিভি চ্যানেল আরিয়াদিয়াকে ফাতিমা বলেন, ‘ও খেলোয়াড় ছিল, কোচও হয়েছে অনেক দিন। কখনো ওর খেলা দেখতে যাইনি। আমি ৫০ বছর ধরে ফ্রান্সে থাকি। এই প্রথম ওকে মাঠে দেখার জন্য আমি প্যারিসের বাইরে এসেছি।’

রেগরাগুই মরক্কো জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন এ বছরের আগস্টে। দায়িত্ব নিয়েই বলেছিলেন, ‘মা–বাবার মুখে হাসি না ফোটালে আমাদের সাফল্য সম্ভব নয়।’

কাতারে এখন সেই হাসিটাই ফুটিয়ে চলেছে মরক্কো ফুটবল দল।