সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মনিকা বললেন, এমন ফল আরও চাই
তুর্কমেনিস্তানের জালে ৭ গোল। তিন ম্যাচে তিন জয়, ১৬ গোল। এবারের মিয়ানমার সফর যেন বাংলাদেশ নারী দলের সফলতা, দাপট আর সম্ভাবনার এক অনন্য গল্প।
চীনের রেফারি মু মিন ঝিন শেষ বাঁশি বাজালেন। তবে বাংলাদেশ নারী দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে তেমন কোনো অতিরিক্ত উল্লাস দেখা গেল না। প্রতিপক্ষের সঙ্গে করমর্দন, কিছুটা শান্ত ভঙ্গিতে মাঠ ছেড়ে গেলেন তাঁরা। সব মিলিয়ে যেন আর দশটা ম্যাচই খেলে ফেললেন মেয়েরা।
তবে খানিক পর বদলে গেল দৃশ্যপট। মাঠে গোল বেঁধে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেন খেলোয়াড়েরা। জাতীয় পতাকা নিয়ে কোচিং স্টাফদের সঙ্গে দলগতভাবে ছবি তুললেন তাঁরা। ওই সময়টাই একটু আনন্দে মেতেছিলেন মেয়েরা। তুর্কমেনিস্তানকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শুধু গ্রুপ পর্বের শেষটা রাঙানো নয়, এর আগেই মিয়ানমারকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে প্রথমবারের মতো নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গাও করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে ২০২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় নারী এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। এর ফলে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ ছিল অনেকটাই নিয়ম রক্ষার। কিন্তু মর্যাদার প্রশ্নে ছাড় না দিয়ে মেয়েরা ম্যাচ শুরু করেন চ্যাম্পিয়নের মতোই। মাত্র ২১ মিনিটেই স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৬-০ তে। প্রথমার্ধেই হয় ৭টি গোল। দ্বিতীয়ার্ধে গোল না হলেও তাতে ম্যাচের গতিপ্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এই ম্যাচে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য সংবাদ সম্মেলনে আসেন মিডফিল্ডার মনিকা চাকমা, যিনি একটি গোলও করেছেন। উচ্ছ্বসিত মনিকা বলেন, ‘অনেক ভালো লাগছে। কারণ, আমরা ২০২৬ সালের চূড়ান্ত পর্বে কোয়ালিফাই করেছি। অনেক খুশি আমরা।’ তারপর তাঁর সংযোজন, ‘আমরা এভাবে আরও ম্যাচ খেলে আরও ভালো ভালো রেজাল্ট করতে চাই। আজকের দিনের জন্য সব সতীর্থকে ধন্যবাদ। সবাই সবাইকে খুব সাহায্য করেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে মনিকাকে কথা বলতে হয়েছে তাঁর ভক্তদের নিয়েও। ভক্তদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ধীরস্থির কণ্ঠে বলেন, ‘আমি আমার ভক্তদের অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই। ওরা আমাকে অনেক সমর্থন করেছে। আমি চাই, ওরা আমাকে এভাবে সমর্থন করে যাক।’
সফরের শুরুটা হয়েছিল বাহরাইনকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে। সেই জয়ই আত্মবিশ্বাসের বাতাস ছড়িয়ে দেয় দলে। ৩৬ ধাপ এগিয়ে থাকা দলকে ৭ গোলে উড়িয়ে দিতে পারলে অনেক কিছুই করা সম্ভব, খেলোয়াড়দের মধ্যে এই বিশ্বাসের বীজ বুনে দেন কোচ পিটার বাটলার। তারপর সফরের মাঝপথে এসেছে ঐতিহাসিক জয়। র্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা স্বাগতিক মিয়ানমারকে হারিয়ে বাংলাদেশ লিখেছে নতুন ইতিহাস। আর শেষটা হলো আরেকটি বড় জয়ে। এই তিন ম্যাচ মিলিয়ে বাংলাদেশ করেছে ১৬ গোল, হজম করেছে মাত্র ১টি।
অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার সফরের আগে স্বপ্নের কথা বললেও মনে ছিল সংশয়। কিন্তু মাঠের খেলায় সে সংশয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ দেখা যায়নি। বরং প্রতিপক্ষের চেয়ে সবদিক থেকেই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। মেয়েদের স্কিল, গতি, শারীরিক সক্ষমতা, শট নেওয়ার দৃষ্টিনন্দন ক্ষমতা—সবকিছুই নজরকাড়া, যা ইয়াঙ্গুনের থুউন্না স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে উপস্থিত দর্শকেরা উপভোগ করেছেন। গোটা একটা দল হয়ে খেলার যে ছবিটা ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা, সেটা কারও নজর এড়ানোর কথা নয়।
দুর্দান্ত সব দূরপাল্লার শট নিয়েছেন স্বপ্না, মনিকা, ঋতুপর্ণারা, যা মুগ্ধতাই ছড়িয়েছে শুধু। তুর্কমেনিস্তান দুর্বল ছিল ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা যে গতিতে প্রথমার্ধ খেলেছেন, তাতে ছত্রখান হয়ে যায় প্রতিপক্ষ। বল পজেশন, পাসিং, ফিনিশিং—সবকিছুতেই এক আধিপত্যের গল্পই লিখেছেন লাল-সবুজের মেয়েরা। কোনো প্রশংসাই আসলে তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশের মেয়োরা অনেক সফরই করেছেন। কিন্তু এবারের মিয়ানমার সফরটা হয়ে থাকবে সবচেয়ে স্মরণীয়। শুধু অর্জনের দিক থেকে নয়, মাঠের নৈপুণ্যেও। এখানে দক্ষিণ এশিয়ার চেনা প্রতিপক্ষ নয়, তিন দলই ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের। তাদের বিপক্ষে তিনটিই দাপুটে জয়। এই তিন জয় কোনো একটি টুর্নামেন্টের গল্প নয়। এটি দেশের মেয়েদের ফুটবলে সম্ভাবনার উজ্জ্বল দিগন্তের সূচনার কথাও বলছে।