এমবাপ্পে নাকি ইয়ামাল: এল ক্লাসিকোয় ফল নির্ধারণ করবেন কে
‘এল ক্লাসিকো’ মানেই রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের উপাখ্যান। প্রতি মৌসুমে বিশ্বব্যাপী কোটি ফুটবলপ্রেমীর চোখ থাকে এই ম্যাচে। এই ম্যাচটিই বেশির ভাগ সময় হয়ে ওঠে স্প্যানিশ ফুটবলের শিরোপা নির্ধারক। গত মৌসুমেও ‘এল ক্লাসিকো’য় একচ্ছত্র দাপট দেখিয়েই ঘরোয়া ফুটবলে ‘ট্রেবল’ জিতেছিল বার্সেলোনা। চলতি মৌসুমেও রিয়াল–বার্সা ম্যাচকেই শিরোপা লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক মনে করছেন অনেকেই। তেমনই এক ম্যাচে আগামীকাল রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ১৫ মিনিটে মুখোমুখি হবে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা। লা লিগায় মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকো ঘিরে এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে উত্তাপ।
মৌসুমের প্রথম এই ক্লাসিকোয় ফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে নানা ধরনের ছোট–বড় ফ্যাক্টর। যেমন বার্সেলোনার শটে বল পোস্টে লেগে বাইরে চলে গেল, কিন্তু রিয়ালের শটে হয়তো বল পোস্টে লেগে ভেতরে ঢুকে গেল! কিংবা হ্যান্সি ফ্লিকের অধীনে বার্সেলোনার হাই–প্রেসিং ফুটবল হয়তো রিয়ালের ওপর এতটাই চাপ সৃষ্টি করতে পারে যে তারা সামলাতে পারবে না, যেমনটা দেখা গেছে গত মৌসুমে।
আবার বার্সার সেই হাই–প্রেসিংই হয়তো ভেঙে পড়তে পারে রিয়ালের প্রতি–আক্রমণের চাপে। জাবি আলোনসোর অধীনে রিয়ালের নিয়ন্ত্রিত কৌশল হয়তো বার্সার খেলার ধারাও নষ্ট করে দিতে পারে। কিংবা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত লাল কার্ডে পুড়তে পারে কোনো দলের কপালও। এই ম্যাচে এমন অনেক কিছুই ঘটতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেবে ম্যাচের ফল।
তবে এত সব ছোট–বড় ফ্যাক্টর বাদ দিয়ে দুজন ফুটবলারের কথা বলা যায়, যাঁরা বদলে দিতে পারেন এই ম্যাচের ও মৌসুমের ভাগ্য—কিলিয়ান এমবাপ্পে ও লামিনে ইয়ামাল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির পর এই দুই তারকার মুখোমুখি হওয়া এখন নতুন এক ধ্রুপদী লড়াই হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ মৌসুমে রিয়াল–বার্সার দলীয় সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করছে এই দুই তারকার ভালো বা খারাপ করার ওপর। এমনকি ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়েও দুজনকে একে–অপরকে টেক্কা দিতে হবে।
এমবাপ্পে বিশ্বজয়ী ফুটবলার। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ব্যালন ডি’অর এখনো তাঁর অধরা। সাফল্য পাননি লা লিগাতেও। তাই এ মৌসুমটা এমবাপ্পের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এরই মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে দারুণ কিছু করার আভাস দিয়েছেন তিনি। অপেক্ষা শুধু ধারাবাহিকতা ধরে রাখার এবং ব্যক্তিগত সাফল্যকে দলীয় সাফল্যে বদলে দেওয়ার।
ইয়ামালকে ধরা হয় এ সময়ের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল ফুটবলারদের একজন হিসেবে। ১৭ পেরোনোর আগেই তিনি অনেক রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। ব্যালন ডি’অরে গতবার রানার্সআপ হলেও, ইয়ামালের লক্ষ্যটা আরও বড়। এমবাপ্পের মতো তিনিও চান চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় ও ব্যালন ডি’অরের স্বাদ। নিজেদের সেই লক্ষ্য পূরণে এমবাপ্পে ও ইয়ামাল দুজনের জন্য আগামীকাল রাতের ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ। এবার বিভিন্ন মাপকাঠিতে দুজনের কে কোথায় এগিয়ে আছেন একবার দেখে নেওয়া যাক।
গোল করার ক্ষমতা
গত মৌসুমের শুরু থেকে এমবাপ্পে লা লিগায় ৩২টি নন-পেনাল্টি গোল করেছেন, ইয়ামাল ১০টি। এ কারণে গত মাসে ইয়ামাল ব্যালন ডি’অর না জেতায় যে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল, তা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। আক্রমণভাগের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে গত মৌসুমে ইয়ামালের নন–পেনাল্টি গোল ছিল মাত্র ৯টি। আর গোলগুলো করতে গিয়ে অনেক সুযোগও নষ্ট করেছেন এ উইঙ্গার।
xG বা এক্সপেকটেড গোলের (এটি হলো একটি পরিসংখ্যানিক মান যা দেখায় কোনো শট থেকে গোল হওয়ার সম্ভাবনা কেমন) তালিকাতেও ইয়ামালের চেয়ে এগিয়ে এমবাপ্পে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এমবাপ্পে লা লিগায় শটের সংখ্যায় শীর্ষে এবং এক্সপেকেটড গোলের দিক থেকে দ্বিতীয়। অন্য দিকে ইয়ামাল দ্বিতীয় সর্বাধিক শট নিয়েছেন, কিন্তু তিনি এক্সপেকটেড গোলের হিসাবে অনেক পিছিয়ে। অর্থাৎ ইয়ামালের শটে গোল হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম ছিল। সব মিলিয়ে ইয়ামাল এখনো নিজেকে সেরা ফিনিশারদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। রোববার রাতের ম্যাচে তাই গোল করার সম্ভাবনায় ইয়ামালের চেয়ে এমবাপ্পেই এগিয়ে থাকবেন।
সুযোগ তৈরি
গত মৌসুমে ইয়ামাল ১৩টি গোলে সহায়তা করেন, যা লা লিগায় সর্বোচ্চ। একই সময়ে এমবাপ্পে করেন মাত্র ৩টি গোলে সহায়তা। গোলে সহায়তার তালিকায় অনেক পিছিয়ে আছেন রিয়াল তারকা। বল পাস দেওয়ার পর গোল হওয়ার যে সম্ভাবনা (যাকে xA বলা হয়) তাতে ইয়ামাল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এমবাপ্পের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।
পরিসংখ্যান সরিয়ে রেখে শুধু পাসিং বা প্রচলিত ‘সৃষ্টিশীলতা’কে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেখানেও ইয়ামাল এমবাপ্পের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক। যেকোনো মুহূর্তে ইয়ামাল এমন কোনো চমক নিয়ে হাজির হতে পারেন, যা মুহূর্তের মধ্যে ম্যাচের গতিপথ বদলে দিতে পারে। ফলে সুযোগ তৈরিতে এমবাপ্পের চেয়ে ইয়ামালই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন এল ক্লাসিকোয়।
আক্রমণ তৈরি
আক্রমণ তৈরি বা বল দখলের সময় এমবাপ্পের ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই তেমন বেশি হওয়ার কথা নয়; কারণ, এটি সরাসরি গোল করা বা গোল বানানোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এক্সপেকটেড পজেশন ভ্যালু (xPV) এমন একটি পরিমাপ, যা দেখায় একজন খেলোয়াড়ের পায়ে বল থাকলে দলের গোল করার সম্ভাবনা কতটা বৃদ্ধি পায়। এই হিসাব অনুযায়ী, এমবাপ্পের মতো পেনাল্টি বক্সের আশেপাশে থাকা খেলোয়াড়রা সাধারণত তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকেন। কিন্তু ইয়ামাল এদিকে আলাদা। লা লিগায় গত মৌসুম থেকে এক্সপেকটেড পজেশন ভ্যালু অনুযায়ী তিনি শুধু তাঁর সতীর্থ পেদ্রির পেছনে রয়েছেন। ফলে এই মানদণ্ডে ইয়ামালকে এগিয়ে রাখা যায়।
শেষ কথা
একটি বড় ম্যাচের আগে দুজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে পরিসংখ্যান দিয়ে বিবেচনা করার সুযোগ সামান্য। তাই শেষ পর্যন্ত এমন দ্বৈরথে কাউকে এগিয়ে রাখা যায় না। ডিফেন্সে এমবাপ্পের কম অবদান রাখা কিংবা ইয়ামালের কম গোলের অভ্যাস তেমন প্রভাব ফেলবে না যদি তাঁরা নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারেন। অর্থাৎ এমবাপ্পে ডিফেন্সে না নেমে যেমন নায়ক হতে পারেন, তেমনি ইয়ামাল গোল না করেও। আবার পুরো ম্যাচে নিষ্প্রভ থেকেও তাঁরা হঠাৎ এমন কিছু করে বসতে পারেন, যা ম্যাচের ভাগ্য মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিতে পারে। ফলে পরিসংখ্যান ও অতীতের হিসাব–নিকাশ বাদ দিয়েই এই ম্যাচে এমবাপ্পে ও ইয়ামালের ওপর চোখ রাখতে হবে। তবেই ম্যাচটা সত্যিকার অর্থে উপভোগ্য হয়ে উঠবে