গোল মিস করতে করতে গোল করা শিখে রাফিনিয়া ভাঙলেন মেসির রেকর্ড
গোল করতে আগে গোল মিস করা শিখতে হয়। রাফিনিয়া এই কাজে রীতিমতো ওস্তাদতুল্য। চোখ বন্ধ করে বার্সেলোনার এই উইঙ্গারকে নিয়ে ভাবলে এই ছবিটাই তো সবার আগে ভেসে ওঠে। পোস্টের আশপাশ দিয়ে বুলেটগতির সব শট গিয়ে জমছে গ্যালারিতে। গোলকিপারও এমন ভাবলেশহীনভাবে বল কুড়িয়ে আনেন যেন এটাই তো হওয়ার কথা ছিল!
রাফিনিয়া ফ্রি–কিক কিংবা হেডেও অত ভালো না। কিন্তু এরপরও রাফিনিয়াকে যদি বলা হয়, অনন্তকাল ধরে চলা ম্যাচে তাঁকে অনন্তকাল দৌড়াতে হবে, তাহলে তিনি সেটাই করবেন। মানে, ক্লান্তিতে ঢলে পড়ার আগপর্যন্ত তাঁর দৌড় থামবে না। এই দৌড়ের ফাঁকেই মিস করবেন এবং সেই মিস ভুলে আবারও আক্রমণ করবেন।
রাফিনিয়া তো আর খাঁটি স্ট্রাইকার নন, খাঁটি উইঙ্গার। তাঁর কাজই দৌড়ানো, এটার বাইরে রাফিনিয়া নিজেকে ঘষেমেজে অতিরিক্ত যে দুটি কাজ ভালোভাবে শিখেছেন, গোল করা এবং করানো। হ্যাঁ, গোল মিস করতে করতেই গোল করা শিখেছেন রাফিনিয়া। আর যিনি গোল করতে পারেন, তিনি করাতেও পারেন।
কাল রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে বার্সেলোনা–ইন্টার মিলানের প্রথম লেগের কথা আরেকবার মনে করুন। ৩৮ মিনিটে ফেরান তোরেসের গোলের প্রথমবারের মতো সমতায় ফেরে বার্সা। পেদ্রির পাস বক্সের বাঁ প্রান্তে পেয়ে রাফিনিয়া ইচ্ছে করলেই নিজে গোল করার চেষ্টা করতে পারতেন। আগের দিনগুলোয় যেমন ছিলেন আরকি। কিন্তু মানুষ দিনে দিনে যেমন পরিণত হয়, তেমনি খেলোয়াড়েরাও। রাফিনিয়া নিঃস্বার্থ হেডে বল ফেলেছেন বক্সের মধ্যে, তোরেস সেখান থেকে গোল করেছেন।
কিংবা ৬৫ মিনিটে ২৫ গজ দূর থেকে রাফিনিয়ার বুলেট গতির শট। বলটা পোস্ট কাঁপিয়ে ড্রপ খেয়ে ইন্টার মিলান গোলকিপার ইয়ান সোমারের পিঠে লেগে ঢুকে পড়ে জালে। গোলটি রাফিনিয়াকে দেওয়া হয়নি, ওটা সোমেরের আত্মঘাতী গোল। কিন্তু চোখধাঁধানো ওই শটের জন্য অনেকেই গোলটির পাশে রাফিনিয়ার নামই লিখতে চাইবেন।
রাফিনিয়ার এই যে পরিবর্তন, সেটা আসলে এবারের মৌসুমে। বার্সার হয়ে আগের মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৭ ম্যাচে তাঁর ছিল ১০ গোল। কিন্তু এবার ৫১ ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ৩০, গোল করিয়েছেন আরও ২৫টি।
আর এই পথে কাল রাতে ভেঙেছেন বার্সায় লিওনেল মেসির রেকর্ড। বার্সার হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোলে অবদানের রেকর্ড এখন রাফিনিয়ার। শুধু বার্সা নয়, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোলে অবদান তাঁর। অতীতে ব্রাজিল থেকে কারা চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছেন, সেই নামগুলো স্মরণ করে এ পরিসংখ্যানে তাকালেই রাফিনিয়ার পারফরম্যান্সের গভীরতা বোঝা যায়।
এ মৌসুমে ইউরোপের শীর্ষ টুর্নামেন্টটিতে ১২ গোল করার পাশাপাশি ৮ গোল করিয়েছেন রাফিনিয়া—অর্থাৎ ২০ গোলে অবদান। ২০১১–১২ মৌসুমে মেসির ১৯ গোলে অবদানের রেকর্ড ভেঙে ফেললেন রাফিনিয়া। তালিকাটির শীর্ষে ওঠার সুযোগও আছে তাঁর।
চ্যাম্পিয়নস লিগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ২১ গোলে অবদানের রেকর্ড ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ইন্টারের বিপক্ষে প্রথম লেগ ৩–৩ গোলে ড্রয়ের পর সেমিফাইনালে এখনো ফিরতি লেগ বাকি বার্সার, সেমিফাইনালের বাধা পার হয়ে ফাইনালে উঠতে পারলে রাফিনিয়ার সুযোগ আরও বাড়বে।
অথচ চ্যাম্পিয়নস লিগের এ মৌসুমে রাফিনিয়া যে পরিমাণ সুযোগ নষ্ট করেছেন, সেটা না ঘটলে রোনালদো আগেই তাঁর পেছনে পড়তেন। চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত ৩২টি শট পোস্টের বাইরে মেরেছেন রাফিনিয়া, যা তাঁর নেওয়া মোট শটসংখ্যার ৭৩ শতাংশ। অন্য চোখে দেখলে ব্যাপারটি এমন—এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, যিনি চুপি চুপি এ প্রতিযোগিতার ব্যক্তিগত পর্যায়ে অন্যতম সেরা মৌসুম কাটাচ্ছেন, সেই খেলোয়াড়ই প্রতি ৯০ মিনিটে শট লক্ষ্যে রাখার হিসাবে শীর্ষ কুড়িতে নেই!
রাফিনিয়ার ক্যারিয়ারে এমনটা নতুন না। লিডস ইউনাইটেডের হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তাঁর সর্বশেষ মৌসুমে (২০২১–২২) মোট শটসংখ্যায় নয়ে থাকলেও লক্ষ্যে শট রাখার তালিকায় ছিলেন ৩১তম। সহজ কথায় রাফিনিয়া প্রচুর মিস করেন। কিন্তু সব সময় চেষ্টার ওপরে থাকায় এবং প্রচুর শট নেওয়ায় কে জানে শেষ পর্যন্ত ট্রেবল কিংবা ব্যালন ডি’অরের দেখাও মিলতে পারে! শেষটির জন্য সম্ভবত বার্সার হয়ে রাফিনিয়াকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে হবে। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীও কম নেই। বাকিটা সময়ের হাতে।
অথচ এই রাফিনিয়াই ২৭ বছর বয়সে ফুটবল ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যিস, গত বছর কোপা আমেরিকাটা তাঁর ভালো কেটেছিল। কোপার সেরা দলেও জায়গা পান। টুর্নামেন্টটি খেলে ফেরার পর তাঁকে ফোন করেন বার্সায় সদ্য যোগ দেওয়া কোচ হান্সি ফ্লিক। জার্মান এই কোচ রাফিনিয়াকে বলেছিলেন, ‘কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এসে অনুশীলন করো।’
ফ্লিক রাফিনিয়ার মধ্যে একজন নেতার গুণাবলি দেখেছেন, যিনি আক্রমণভাগে মিসের পর মিসেও কখনো হাল ছাড়েন না। বাকিটা সবাই দেখতেই পাচ্ছেন।