লামিনে ‘মেসি’ ইয়ামাল: ৫০ বছরে একজন
১৭ বছর বয়সী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: ১৯ ম্যাচ, ৫ গোল, ৪ গোলে সহায়তা।
১৭ বছর বয়সী লিওনেল মেসি: ৯ ম্যাচ, ১ গোল, গোলে সহায়তা নেই।
১৭ বছর বয়সী লামিনে ইয়ামাল: ১০০ ম্যাচ, ২২ গোল, ৩৩ গোলে সহায়তা।
মেসি–রোনালদোর সঙ্গে তুলনা নয়, লামিনে ইয়ামালের শুরুটা বোঝাতে এই পরিসংখ্যান হাজির করেছে টিএনটি স্পোর্টস। ধূমকেতুর মতো শুরু হলেও ধূমকেতুর মতোই মিলিয়ে যাওয়ার পাত্র তিনি নন।
বার্সেলোনার এস্তাদি অলিম্পিক লুইস কোম্পানিসে গত রাতের ম্যাচটি স্মরণ করতে পারেন। ৬ গোলের থ্রিলার, যেখানে বার্সেলোনা–ইন্টার মিলান সেমিফাইনাল প্রথম লেগের ‘ক্লাসিক’ লড়াই ৩–৩ গোলে অমীমাংসিত। দুই দলের হয়েই ‘সুপার হিরো’ ছিলেন বেশ কজন। ইন্টারের যেমন ডেনজেল ডামফ্রিস ও মার্কাস থুরাম, বার্সার তেমনি রাফিনিয়া, ফেরান তোরেসরা। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে ঠিকই রবির কিরণের মতো আলো দিয়েছেন এক কিশোর—লামিনে ইয়ামাল নাসরাউয়ি এবানা। সংক্ষেপে লামিনে ইয়ামাল।
২৪ মিনিটে ইয়ামালের করা গোলটির প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। যেভাবে খেলেছেন তাতে গোলটি না করলেও লোকে কাল রাতে তাঁর পারফরম্যান্স মনে রাখতেন। পরিসংখ্যান বলছে ১০২টি টাচ, একটি গোল, ২টি গোল হওয়ার মতো পাস, ৬টি শট (পোস্টে মেরেছেন দুবার) এবং ১০টির মধ্যে ৬টি সফল ড্রিবলিং।
কিন্তু পরিসংখ্যানে এ তথ্য নেই—মাঠে ডান প্রান্তকে ইয়ামাল ফাইনালে ওঠার হাইওয়ে বানিয়ে যতবার কাট ইন করে ইন্টারের বক্সে ঢুকেছেন, সেটা আসলে ইতালিয়ান ক্লাবটির রক্ষণের জন্য দুঃস্বপ্নের। প্রতিবারই মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরা হয়েছে ইয়ামালকে। কিন্তু আটকানো কি সম্ভব হয়েছে? রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওগুলো ভাসছে। সেসব আসলে ইয়ামালের পায়ের কারুকাজে ইন্টারের রক্ষণকে স্রেফ খোলামকুচির মতো উড়িয়ে দেওয়ার ভিডিও।
ইংল্যান্ডের সাবেক ডিফেন্ডার ও ফুটবল–পন্ডিত রিও ফার্ডিনান্ড কি আর সাধেই নিজের এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘খাঁটি ফুটবল প্রতিভা হিসেবে আমি বলব, বিশ্ব ফুটবলে শীর্ষ পাঁচ লিগে খেলা যেকোনো খেলোয়াড়ের তুলনায় অন্য পর্যায়ের লামিনে ইয়ামাল। ১৭ বছর বয়স—একদমই অবিশ্বাস্য।’
কিংবা আর্লিং হলান্ড। ম্যানচেস্টার সিটি তারকাও কাল রাতে ইয়ামালের খেলা দেখেছেন। বার্সা উইঙ্গারের পোস্টে বল মারার ঠিক আগমুহূর্তের ছবি স্ন্যাপচ্যাটে পোস্ট করে হলান্ড ছবির ওপরই লিখেছেন, ‘এই মানুষটি অবিশ্বাস্য।’
ইয়ামালের পরিণত মস্তিষ্কের ক্ষুরধার খেলা দেখে হলান্ডও হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, যাঁকে পরিণত মানুষ বলছেন, সেই ছেলেটির বয়স মাত্র ১৭ বছর।
শুধু হলান্ড কেন, ইয়ামালের পায়ে বল গেলে লোকে আরও একটি ভুলও করে বসেন। সেটা ইচ্ছা না অনিচ্ছাকৃত, তা অজানা। ভুলটা হলো, মেসি ভেবে বসেন! হ্যাঁ, কথাটি একটু বাড়াবাড়ি করেই বলা। কারণ, ইয়ামালের খেলার ধরন মেসির মতোই। আর সেটা দেখে লোকেও হয়তো ভাবতে ভালোবাসেন, বার্সায় এখনো মেসি খেলছেন!
মেসির মতোই রাইট উইংয়ে থেকে দৌড় শুরু করেন, কাট ইনও মেসির মতো, ড্রিবলিং, বডি ডজ—সবকিছুতেই যেন বার্সায় আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি। আর গোল করায়? একদম টাটকা উদাহরণ তো আছেই!
ইন্টারের বিপক্ষে গোলটির কথাই ধরুন। ডান প্রান্তে তাঁর কাছ থেকে বল কাড়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন থুরাম। গোল্লাছুট খেলার মতো থুরামকে পেছন পেছন বেশ কয়েক সেকেন্ড ঘুরিয়ে তাঁকে পেছনে ফেলার সময় ইন্টার ফরোয়ার্ডের শরীরী ভাষায় হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
এরপর ইয়ামালের সামনে পড়লেন হেনরিক মিখিতারিয়ান। তাঁকেও ড্রিবলিংয়ে পাশে রেখে বক্সের ভেতরে ইয়ামাল এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, যেখান থেকে পোস্টে শট নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাঁর সামনে, পেছনে ও পাশে মিলিয়ে ইন্টারের তিন খেলোয়াড়। কিন্তু প্রতিভারা সব সময়ই পথ খুঁজে নেয়। দৌড়ের ওপরই বাঁ পায়ে মাপা শট নেন ইয়ামাল। ইন্টার গোলকিপার ইয়ান সোমার স্রেফ দর্শক বনে গিয়ে দেখলেন বলটা দূরের পোস্ট লেগে জালে ঢুকল। ঠিক ওই মুহূর্তে ইয়ামালকে মেসি ভেবে ভুল না করাটাই আসলে ভুল! বার্সায় এমন সব গোলই তো মেসিকে মেসি বানিয়েছে।
যেমনটা এখন হয়ে উঠছেন ইয়ামাল। ইংল্যান্ড ও লিভারপুলের সাবেক ডিফেন্ডার এবং বিশ্লেষক জেমি ক্যারাঘার সিবিএস স্পোর্টসে ঠিক এটাই বলেছেন, ‘যেন সেরা সময়ের মেসিকে দেখছি। বল তার পায়ে গেলে গোটা খেলাই যেন থেমে যায়, লোকে তার কাছ থেকে কিছু দেখার অপেক্ষায় থাকে।’
বার্সেলোনার হয়ে কাল রাতে নিজের ১০০তম ম্যাচে ইয়ামাল যা দেখিয়েছেন, তাতে মুগ্ধ ইন্টার কোচ সিমোন ইনজাগিও। সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বার্সার এক খেলোয়াড় আছে, যাকে থামানো কঠিন। আমরা ভালো শুরু করলেও প্রথমার্ধের শেষ ২৫ মিনিটে সে খুব ঝামেলায় ফেলেছে। সে এমন এক খেলোয়াড়, যাকে সরাসরি আগে দেখিনি এবং তার ওপর নজরদারি দ্বিগুণ করতে হয়েছে। তার মতো খেলোয়াড় ৫০ বছরে একবারই জন্মায়। আজ (কাল রাতে) আমি তার খেলায় মুগ্ধ।’
অথচ ওয়ার্মআপের সময়ও জানা গিয়েছিল, ইয়ামালের মাংশপেশিতে ব্যথা আছে। এই চোট নিয়েই যা দেখালেন, তাতে বার্সা কোচ হান্সি ফ্লিকও সুর মিলিয়েছেন ইনজাগির সঙ্গে, ‘সে বিশেষ কেউ। জিনিয়াস। আমার মনে হয়, সে বড় মঞ্চও উপভোগ করে। আমি খুশি এই কারণে যে ৫০ বছর পরপর আসা এমন প্রতিভা বার্সার হয়ে খেলছে।’
চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৯১ দিন) হিসেবে গোলের রেকর্ডটি কিলিয়ান এমবাপ্পের কাছ থেকে কেড়েছেন ইয়ামাল। ১৫ বছর বয়সে অভিষেকের ঠিক ২ বছর ১ দিন পর বার্সার হয়ে ম্যাচ খেলার সেঞ্চুরিও হয়ে গেল তাঁর। এমন উপলক্ষের ম্যাচে ইয়ামালের করা গোলটি থেকে হয়তো তাঁর দ্বিতীয়ার্ধের মিসটি বেশি সুন্দর; বেশ দূর থেকে লুপ করা শটে যেটা পোস্টে মারলেন। শটটি দেখে একটু দ্বিধাও হতে পারে, গোলের জন্যই শট নিয়েছিলেন, নাকি ক্রস করলেন! সিবিএস স্পোর্টসের সঞ্চালক কেট আব্দো এ নিয়ে ম্যাচ শেষে জানতে চাইলে ইয়ামাল বলেছেন, (বাঁ প্রান্তে) রাফিনিয়াকে তিনি দেখেননি। গোল করতে শটই নিয়েছিলেন।
প্রতিভারা ঠিক এ কারণেই সম্ভবত সাধারণের চেয়ে আলাদা। সিবিএস স্পোর্টসের শোতে ফরাসি কিংবদন্তি থিয়েরি অঁরির কথায় সেটাই প্রতিধ্বনিত হলো, ‘আজ (কাল) রাতে লামিনে ইয়ামালের কাছ থেকে যা দেখলাম...১৭ বছর বয়সে এমন হওয়া মোটেও স্বাভাবিক নয়। আমরা এই পর্যায়ে তার খেলা ১০০ ম্যাচ নিয়ে কথা বলেছি। এটা আসলে হতবুদ্ধিকর। আমি ঠিক জানি না, কী দেখছি, কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তার খেলা দেখে মনে হচ্ছে, পরিণত কোনো মানুষের ওপর কিছু ভর করেছে। আর যখন আমি পরিণত মানুষের কথা বলছি, সে তো এখনো সেটা হতে পারেনি। নাহ, এটা মোটেও স্বাভাবিক নয়।’
অঁরির দাবিকে সমর্থন দিচ্ছে পরিসংখ্যান। বার্সায় ১০০ ম্যাচে ৫৫ গোলে অবদান ইয়ামালের। মেসির প্রথম ১০০ ম্যাচে গোলে অবদান ৫৬টি (৪১ গোল, ১৫ গোলে সহায়তা)। আর রোনালদোর প্রথম ১০০ ম্যাচে গোলে অবদান ছিল ২৭টি ( ১৩ গোল, ১৪ গোলে সহায়তা)।
পার্থক্য হলো, নিজেদের ১০০তম ম্যাচ খেলার সময় মেসি ও রোনালদোর বয়স ইয়ামালের চেয়ে বেশি ছিল।
এবার বলুন তো, ইয়ামালের পারফরম্যান্স কি স্বাভাবিক? উত্তর আমরা সবাই জানি।