চাঁদে আর্জেন্টাইন ক্লাবের পতাকা নিয়ে গিয়েছিলেন আর্মস্ট্রং, যে ঘটনা অনেকেরই অজানা
পৃথিবীর সহজতম প্রশ্নগুলোর একটি—চাঁদে প্রথম পা রেখেছেন কে?
১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের সেই চন্দ্রাভিযানের সময় নীল আর্মস্ট্রং সঙ্গে করে কী নিয়ে গিয়েছিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সবার জন্য সহজ নয়। রাইট ব্রাদার্সের ফ্লাইয়ারের টুকরা, স্কাউট ব্যাজ, যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা, মেয়ের ব্রেসলেটসহ এ ধরনের টুকিটাকি জিনিসের কথাই শোনা যায় ঘুরেফিরে।
তবে কম প্রচলিত কিন্তু চমকপ্রদ একটি তথ্য হচ্ছে, আর্মস্ট্রং ২০ জুলাই চাঁদে অভিযানের সময় একটি আর্জেন্টাইন ফুটবল ক্লাবের পতাকাও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ক্লাবটি আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুদিবসে ম্যাচ থাকলে তাঁর স্মরণে এক মিনিটের নীরবতাও পালন করে থাকে।
ক্লাবটির নাম ইন্দিপেনদিয়েন্তে আভেয়ানেদা বা ক্লাব আতলেতিকো ইন্দিপেনদিয়েন্তে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আর্জেন্টাইন ক্লাবটি এখনো দেশটির শীর্ষ লিগে খেলে থাকে। ১৯৯৮ সালের ২১ জুলাই আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম পেজিনা ১২–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০ বছর আগে আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে চাঁদে গিয়েছিল ইন্দিপেনদিয়েন্তের একটি পতাকা।
তাঁর কাছে পতাকা পৌঁছে দেওয়ার সূত্রপাত হয়েছিল যাঁর মাধ্যমে, সেই হেক্টর রদ্রিগেজই শুনিয়েছেন সেই গল্প। পরবর্তী সময়ে আর্জেন্টিনার আরেক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশিওনালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সে সময়ের কোষাধ্যক্ষ লিসনোভস্কিও।
যেভাবে শুরু
১৯৬৯ সালের এপ্রিলে ইন্দিপেনদিয়েন্তের কালচার অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন সেক্রেটারি হেক্টর রদ্রিগেজ ক্লাবের সভায় জানান, তিন ব্যক্তি চাঁদে যাচ্ছেন। তাঁরা যেহেতু শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নায়ক হতে যাচ্ছেন, আমরা তাঁদের ইন্দিপেনদিয়েন্তের সদস্যপদ দিতে চাই। প্রস্তাবটি ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করে। নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সের নামে ইন্তিপেনদিয়েন্তের সদস্যপদ কার্ড তৈরি করা হয়।
সে সময় ইন্দিপেনদিয়েন্তের যিনি কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, সেই বোরিস লিসনোভস্কি ২০০৯ সালে দ্য ন্যাশিওনালকে বলেন, ‘আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কারণ, ইন্দিপেনদিয়েন্তে সব সময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল। আমরা হেক্টর রদ্রিগেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করি। আর আমরা সিদ্ধান্ত নিই মহাকাশচারীদের কাছে পতাকা পাঠানোর। উদ্দেশ্য ছিল তাঁরা যেন ইন্দিপেনদিয়েন্তের কিছু তাঁদের সঙ্গে চাঁদে নিয়ে যান। এর ফলে পৃথিবীর প্রথম ক্লাব হিসেবে আমরা আমাদের পতাকা চাঁদে নিয়ে যেতে পারব।’
প্রথমে তিনজনকেই ইন্দিপেনদিয়েন্তের আজীবন সম্মানসূচক সদস্য করা হয়। অলড্রিন ছিলেন সদস্য নং ৮০,৩৯৯, আর্মস্ট্রং ৮০,৪০০ আর কলিন্স ৮০,৪০১। সদস্যপদ কার্ডগুলো স্বাক্ষর করেছিলেন লিসনোভস্কি নিজেই। ছবিগুলো ছিল মার্কিন দূতাবাস প্রদত্ত নাসার অফিশিয়াল ফটোগ্রাফ, যেখানে তিনজন তাঁদের স্পেসস্যুট পরা অবস্থায় আছেন।
লিসনোভস্কি জানান, আর্জেন্টিনার দূতাবাসে গিয়ে সদস্য কার্ড ও পতাকা পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁরা, ‘আমরা তাদের সদস্য পদ কার্ড পাঠালাম, যেখানে আমার স্বাক্ষর আর ইন্দিপেনদিয়েন্তের জার্সি ছিল। হেক্টর, পেদ্রো ইসো আর আমি দূতাবাসে গেলাম। সেখানে আমরা সামগ্রীগুলো দিলাম। সংস্কৃতিসচিবের সঙ্গে দেখা করলাম, তারপর রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বললাম আর তিনি আমাদের প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি এগুলো পাঠিয়ে দেবেন। তখন আমরা জানতাম না তারা সত্যিই এগুলো যাত্রায় নিয়ে যাবে কি না। কিন্তু আমরা অবাক হলাম দেখে যে এই উপহারগুলো তারা ভীষণ ভালোভাবে গ্রহণ করল।’
কার্ড এবং অন্যান্য সামগ্রী তিন নভোচারীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল অ্যাপোলো ১১ যাত্রার আগেই। ১৯৬৯ সালের ২৩ মে ইন্দিপেনদিয়েন্তকে একটি চিঠি লেখেন আর্মস্ট্রং। রদ্রিগেজের উদ্দেশে টাইপ করা চিঠিতে আর্মস্ট্রং লেখেন, ‘প্রিয় মি. রদ্রিগেজ, অ্যাপোলো ১১–এর ক্রু সদস্যদের পক্ষ থেকে আমি আপনার চমৎকার চিঠি এবং আমাদের তিনটি পতাকা পাঠানোর সৌজন্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি শিগগিরই ফিরে এসে বুয়েনস এইরেস ভ্রমণ করতে চাই। আর আশা করি পরিস্থিতি আমাকে আপনার ক্লাব পরিদর্শনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে দেবে। আন্তরিক শুভেচ্ছা, নীল আর্মস্ট্রং।’
সবারই জানা, আর্মস্ট্রংদের সেই চন্দ্রাভিযান সফল হয়েছিল। পৃথিবীতে ফেরার পর আর্মস্ট্রং ও কলিন্স ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে আর্জেন্টিনা সফর করেন। সেটি ছিল মানবজাতির এই মহাকাব্যিক অর্জন উদ্যাপনে আয়োজিত বিশ্ব সফরের অংশ হিসেবে।
আর্মস্ট্রং ও কলিন্স অবশ্য ইন্দিপেনদিয়েন্তে যাননি। তবে রদ্রিগেজকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মহাকাশচারীদের সম্মানে মার্কিন দূতাবাসে আয়োজিত এক সংবর্ধনায়। সেদিন একজন অনুবাদকের মাধ্যমে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন ডেভিস লজের উপস্থিতিতে আর্মস্ট্রং হেক্টর রদ্রিগেজকে জানান, ইন্দিপেনদিয়েন্তের পতাকাটি পুরো যাত্রায় তাঁদের সঙ্গে ছিল।
রদ্রিগেজ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পেজিনা ১২–কে বলেন, ‘আর্মস্ট্রং আমাদের বলেছিলেন ইন্দিপেনদিয়েন্তের পতাকা তার পুরো চাঁদযাত্রার সঙ্গী ছিল। যাত্রার আগে আমরা তাঁকে বলেছিলাম যে তাঁরা শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি অর্জন করতে যাচ্ছেন আর সেটিই তাঁকে প্রভাবিত করেছিল।’
ক্লাবের মহাকাশচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ আবার হয়েছিল ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে। সেবার রদ্রিগেজ তাঁদের আবারও অফিশিয়াল ক্লাবের পোশাক পাঠান। ন্যাশিওনাল লিখেছে, ইন্দিপেনদিয়েন্তের সদর দপ্তরের দ্বিতীয় তলায় একটি ফ্রেম করা ছবি আছে। যেখানে রয়েছে আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনের সদস্য পদ কার্ড এবং চাঁদে প্রথম পদচিহ্ন রাখা মানুষের চিঠি।
আজ সেই মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে যান তিনি।