বোয়েলির এক বছরে চেলসি কী পেল, কী হারাল

৩০ মে ২০২২
চেলসিতে আনুষ্ঠানিকভাবে টড বোয়েলি যুগ শুরু হয়েছিল সেদিন। রোমান আব্রামোভিচের কাছ থেকে প্রায় ৪৯০ কোটি ইউরোতে (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৪ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা) চেলসি ক্লাব কিনে নেয় বোয়েলির নেতৃত্বাধীন ব্যবসায়িক গ্রুপ। নতুন মালিকানায় গতকাল এক বছর পূর্ণ হলো চেলসির। শেষ হলো পুরো একটা মৌসুম। আমেরিকান ধনকুবের মালিকের অধীন এক বছরে চেলসি কী পেল আর কী হারাল, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক কিছুটা।

টড বোয়েলির শুরুটাই হয়েছিল ‘প্রিমিয়ার লিগের উচিত আমেরিকান খেলাধুলা থেকে কিছু শেখা’—এ রকম একটা বক্তৃতা দিয়ে। কীভাবে প্রিমিয়ার লিগ আরও বেশি আয় করতে পারে, সেটা জানাতে গিয়ে প্রস্তাব করেছিলেন আমেরিকার মতো ‘নর্থ ভার্সেস অল স্টার’ ম্যাচ প্রিমিয়ার লিগেও আয়োজন করতে। এতেই বোঝা যায়, প্রিমিয়ার লিগ বা ইউরোপের ফুটবল কাঠামো কিংবা ঠাসা সূচি সম্পর্কে তাঁর ধারণা তত গভীর নয়। এটার প্রতিক্রিয়াও পেয়েছিলেন বোয়েলি। লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ তো কথাটা শুনেই বলেছিলেন, ‘এ কথা সত্যিই তিনি বলেছেন? তাহলে সূচিটাও তাঁকেই বের করতে বলুন না। তারিখ জানাতে বলুন। তিনি কি সঙ্গে হারলেম গ্লোবট্রোটারসকেও (আমেরিকার শৌখিন বাস্কেটবল দল) নিয়ে আসতে চান এখানে?’

মোহাম্মদ সালাহকে চেলসির একাডেমির খেলোয়াড় দাবি করেছেন টড বোয়েলি!
ছবি: রয়টার্স

এখানেই শেষ নয়, গত বছর সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে যে কনফারেন্সে বোয়েলি এ কথাগুলো বলেছিলেন, সেখানেই দাবি করেছিলেন—‘চেলসির একাডেমি বিশ্বের অন্যতম সেরা’। চেলসির একাডেমি বিশ্বের অন্যতম সেরা কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে সেরা কেন, সেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বোয়েলি দাবি করেছেন, চেলসির একাডেমি থেকে নাকি মোহাম্মদ সালাহ ও কেভিন ডি ব্রুইনার মতো খেলোয়াড় তৈরি হয়েছেন।


লিভারপুলের সালাহ ও ম্যানচেস্টার সিটির কেভিন ডি ব্রুইনাকে যাঁরা চেনেন, তাঁদের এটাও জানার কথা, দুজনের কেউই আসলে চেলসি একাডেমি থেকে উঠে আসা নন। মোহাম্মদ সালাহ তৈরি হয়েছেন মিসরীয় ক্লাব আল মোকাওয়ালোনে। ২০১৪ সালে যখন সালাহ চেলসিতে যোগ দেন, তত দিনে তিনি মোকাওয়ালোন ও সুইস ক্লাব বাসেলে পেশাদার ক্যারিয়ারের চার বছর পার করে এসেছেন। অন্যদিকে ডি ব্রুইনার বেড়ে ওঠা দুই বেলজিয়ান ক্লাব গেন্ট ও গেঙ্কে। ২০১২ সালে চেলসিতে যাওয়ার আগে তিনিও সিনিয়র ক্যারিয়ারের চার বছর পার করে ফেলেছেন। বোয়েলির এসব আবোল-তাবোল কথা শুনে আর্সেনালের ফরাসি কিংবদন্তি থিয়েরি অঁরি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আগে কিছুটা পড়াশোনা করে জ্ঞান অর্জন করে তারপর কথা বলতে।

আরও পড়ুন

ফুটবল-জ্ঞান ছাড়াও ক্লাবের মালিক হওয়া যায়, ক্লাব চালানো যায়। তবে সেটার জন্য নিজে কিছুটা নিষ্ক্রিয় থেকে ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ফুটবল ভালো বোঝেন, এমন কিছু মানুষকে নিয়োগ দিতে হয়। বোয়েলি সেটা না করে নিজেই সক্রিয়ভাবে খেলোয়াড় কেনাবেচা এবং ফুটবলীয় সিদ্ধান্তে সম্পৃক্ত হয়েছেন। খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুমে সাধারণত মালিকপক্ষের আনাগোনা কম থাকে। বোয়েলি যখন-তখন ড্রেসিংরুমে যাওয়াটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন। এমনকি ম্যাচের পর নিজের ক্লাবের খেলোয়াড়দের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি। এর কিছুই চেলসির খেলোয়াড়দের ভালো পারফর্ম করতে সাহায্য করেনি।

বোয়েলির চেলসি এক বছরে দুটি দলবদলের মৌসুমে মোট খরচ করেছে ৬১ কোটি ১৪ লাখ ৯০ হাজার ইউরো। কিনেছে ১৫ জন খেলোয়াড়। কিন্তু শুধু খেলোয়াড় কিনলেই তো হয় না। দলের গঠন অনুযায়ী কোন পজিশনে কোন খেলোয়াড় দরকার, কার বিকল্প কে হতে পারেন, সেসব মাথায় রাখতে হয়। বোয়েলি কিংবা তিনি যাঁদের খেলোয়াড় কেনার দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁরা এসব কিছু মাথায় রেখে দলবদলের বাজারে নেমেছিলেন বলে মনে হয়নি। যখন যাকে মনে ধরেছে, কিনে ফেলেছে চেলসি। এতে স্কোয়াড বিশাল বড় হয়েছে, কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্স হয়ে গেছে যা-তা।

আরও পড়ুন

দলবদলে চেলসি সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার কিনতে খরচ করেছে প্রায় ১৩ কোটি ইউরো, সেন্টার ব্যাক কিনেছে প্রায় ১৫ কোটি ইউরো দিয়ে, ফুল ব্যাক প্রায় ১০ কোটি ইউরোর, উইঙ্গার কিনেছে ২১ কোটি ইউরোতে। কিন্তু স্ট্রাইকারদের পেছনে খরচ করেছে মাত্র ২ কোটি ইউরোর কিছু বেশি। গোল কীভাবে পাবে চেলসি!

হতাশার এক মৌসুম কেটেছে চেলসির
ছবি: রয়টার্স


এমন খামখেয়ালি কেনাকাটার পর দলে না ছিল কোনো ভারসাম্য, না ছিল সঠিক সমন্বয়। সেটার ছাপ পড়েছে মাঠের খেলায়। আর খারাপ পারফরম্যান্সের পর বোয়েলি শুরু করলেন কোচ ছাঁটাই। গত বছর সেপ্টেম্বরেই বিদায় করে দেওয়া হয় ২০২০-২১ মৌসুমে চেলসিকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো টমাস টুখেলকে। ব্রাইটন থেকে নিয়ে আসা হয় গ্রাহাম পটারকে। সাত মাস পর সেই পটারও বাদ, অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রুনো সাল্টরকে। এক ম্যাচ পরেই তাঁকে সরিয়ে আবার অন্তর্বর্তী কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডকে। সব মিলিয়ে এক মৌসুমে চেলসির খেলোয়াড়েরা খেলেছেন ৪ জন কোচের অধীন। এমন অস্থিরতায় ভালো পারফর্ম করা যায় নাকি! কোচরা দলটাকে বোঝার সময়ই তো পাননি।

আরও পড়ুন

ফলাফল, এই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে চেলসি ৫০ ম্যাচে জিতেছে মাত্র ১৬টি। গত মৌসুমে যে দলটা তৃতীয় হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ পেয়েছিল, এবার তারা লিগ শেষ করেছে ১২ নম্বরে থেকে। একটা করে ম্যাচ খেলেই বিদায় নিয়েছে লিগ কাপ ও এফএ কাপ থেকে। আগামী মৌসুমে ইউরোপের কোনো প্রতিযোগিতায় তাই খেলা হবে না চেলসির।

চেলসির দুর্দশা যদি এখানেই শেষ হয়, তাহলে হয়তো খুশি হবেন ক্লাবটির অন্তঃপ্রাণ সমর্থকেরা। নতুন মৌসুমে নতুন আশা নিয়েই মাঠে যাবেন তাঁরা প্রিয় ক্লাবকে সমর্থন দিতে। আশার কথা, এরই মধ্যে নতুন কোচ হিসেবে মরিসিও পচেত্তিনোকে বেছে নিয়েছে চেলসি। পিএসজি থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন কোচিংয়ের বাইরে থাকলেও পচেত্তিনো প্রিমিয়ার লিগে বেশ অভিজ্ঞ। পাঁচ বছর টটেনহামের কোচ ছিলেন, তাঁর অধীন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও খেলেছে ক্লাবটি।

চেলসির অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড
ছবি: রয়টার্স

নতুন মৌসুম শুরুর আগেই দায়িত্ব পাওয়ায় প্রাক্‌-মৌসুমে দলটাকে গোছানোর সময় পাচ্ছেন পচেত্তিনো। চাইলে চেলসির বিশাল স্কোয়াড কমিয়ে নিজের মতো করে দলটাকে সাজাতে পারবেন। আগামী মৌসুমে ইউরোপের কোনো প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ নেই বলে চেলসির পুরো মনোযোগই থাকবে ঘরোয়া লিগ ও কাপে। যথেষ্ট বিশ্রাম নিয়ে সতেজ হয়ে খেলতে পারবেন দলের খেলোয়াড়েরা।

ব্যর্থ মৌসুম শেষে নতুন একটা মৌসুম শুরুর আগে চেলসি আসলে এর বাইরে আর ইতিবাচক কিছু খুঁজেও পাবে না।