ব্রাজিল কেন পেলে–রোনালদোদের মতো তারকা পাচ্ছে না

তারকা কেন পাচ্ছে না ব্রাজিলগ্রাফিক্স: প্রথম আলো

১৮৯৪ সালে চালর্স মিলার নামের এক ভদ্রলোক দুই হাতে দুটি ফুটবল নিয়ে নেমেছিলেন ব্রাজিলিয়ান বন্দর পোর্ট অব সান্তোসে। বন্দর এলাকার লোকেরা সেদিন তাড়াহুড়োর মধ্যে মিলারের হাতে থাকা ফুটবল দুটিকে খেয়ালই করেননি। সেই দুটি বল দিয়ে ব্রাজিলের ঘরে ঘরে ‘ফুটবল’ নামের বিপ্লব নিয়ে আসেন মিলার। যে বিপ্লব শুধু ব্রাজিলেরই নয়, বদলে দিয়েছিল বিশ্ব ফুটবলের গতিপথও।

মিলারের আগে ব্রাজিলে ফুটবল খেলা হতো কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ব্রাজিলে তিনি-ই যে খেলাটির পথপ্রদর্শক এবং তাঁর হাত ধরে যে খেলাটি বদলে গেছে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মিলারকে তাঁর আনা বলগুলোকে খেলার মাঠে নামাতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কারণ, সে সময় ব্রিটিশ কমিউনিটিতে চলছিল ক্রিকেটের মৌসুম। ফুটবলকে থাকতে হয় অপেক্ষায়।

বাধার সব দেয়াল ভেঙে অবশ্য ঠিকই শুরু হয় ফুটবলের যাত্রা। তবে একবার যাত্রা শুরুর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ব্রাজিলের ফুটবলকে। এরপর ব্রাজিলের ফুটবলে শত ফুল ফুটতে শুরু করলে দৃশ্যপট আরও বদলে যায়। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের অংশগ্রহণ ভিন্ন এক মাত্রা দিয়েছিল খেলাটিকে।

ব্রাজিলের ফুটবলের এই পরিবর্তন নিয়ে ‘ফুটবল দ্য ব্রাজিলিয়ান ওয়ে অব লাইফ’ বইয়ে অ্যালেক্স বেলোস লেখেন, ‘ফুটবল কেবল তখনই ব্রাজিলিয়ান হয়েছে, যখন কৃষ্ণাঙ্গরাও শীর্ষ ফুটবলে অংশগ্রহণ করেছে। শুরুতে তাদের অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাতে সেই মানুষগুলোর আগ্রহে কোনো ভাটা পড়েনি। তারা ফ্লুমিনেন্সের সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারত না। তারা পাশের ভবনের দেয়াল বেয়ে ছাদে উঠত এবং সেখানে বসেই খেলা দেখত। এরপর তারা দেখল এই খেলা ক্রিকেটের চেয়ে মজাদার এবং এটি নকল করাও সহজ। এর জন্য দরকার শুধু একটি বল। যদি তুমি তা কিনতেও না পারো, যেকোনোভাবে চাইলে বানিয়ে নিতে পারো।’

আরও পড়ুন

অগ্রযাত্রার এই ধারাতেই ব্রাজিল পেয়ে যায় তাদের প্রথম তারকা আর্থার ফ্রেডেনরাইখকে। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রাথমিক পর্বে একে একে এসেছেন দমিঙ্গোস দা গিয়া, লেওনিদাস দা সিলভা এবং জিজিনিওর মতো তারকারা। যা পরে পূর্ণতা পেয়েছে পেলে, গারিঞ্চা, দিদি, নিলটন সান্তোস কিংবা ভাভাদের মাধ্যমে। যাদের হাত ধরে ব্রাজিল জিতেছে তিনটি বিশ্বকাপ। এরপরও অবশ্য থেমে যায়নি ব্রাজিলের তারকা তৈরির ধারা। জাইরজিনিও, জিকো কিংবা সক্রেটিসরাও ফুটবলার তৈরির ধারাকে অব্যাহত রেখেছিলেন। যে পথ ধরে এরপর বেরিয়ে আসেন রোমারিও, রোনালদো নাজারিও এবং রোনালদিনিওর মতো বিশ্বজয়ীরা।

রোনালদো ফেনোমেনন ও রোনালদিনিও পর এসেছিলেন কাকা, আদ্রিয়ানো ও নেইমাররা। কাকা ব্যালন ডি’অর জিতেছেন, আদ্রিয়ানো কিছুদিন জাদু দেখিয়ে নীরবেই হারিয়ে গেলেন এবং নেইমার এখন পর্যন্ত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সর্বশেষ বড় তারকা হিসেবে নিভু নিভু করে জ্বলছেন। অনেকে আশা করেছিলেন, নেইমারই হয়তো ব্রাজিলকে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেবেন। কিন্তু সেই আশা এখন প্রায় ম্লান হয়ে গেছে। চোটকে হারিয়ে নেইমার ২০২৬ বিশ্বকাপ জিততে পারবেন কি না, তা নিয়েও আছে শঙ্কা।

ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে
রয়টার্স

তবে এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, নেইমারের পর কে? এই জায়গায় অনেকে হয়তো ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো কিংবা রাফিনিয়াদের নাম বলবেন। কিন্তু তাঁরা যতটা রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার তারকা, ততটা ব্রাজিলের নন। ২০২২ বিশ্বকাপের পর নেইমার যখন ধুঁকছিলেন, তখন তাঁদের কাঁধেই দায়িত্ব ছিল ব্রাজিলের ফুটবলকে টেনে নেওয়ার। কিন্তু তাঁরা সেই কাজ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। তিনজনই ক্লাবের জার্সিতে যতটা উজ্জ্বল, জাতীয় দলের জার্সিতে ততটাই ম্লান।

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের চিরায়ত যে নান্দনিকতা, সেটাও তাঁদের খেলাতে অনেকটাই অনুপস্থিত। তাঁদের খেলার ধরনে লাতিন সৌন্দর্যের বদলে ইউরোপের ছোঁয়ায় বেশি। একক নৈপুণ্যে ম্যাচের গতিপথ বদলে দেওয়ার মতো জাদুও তাঁরা এখনো দেখাতে পারেননি।

নেইমারের পর কে? এই জায়গায় অনেকে হয়তো ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো কিংবা রাফিনিয়াদের নাম বলবেন। কিন্তু তাঁরা যতটা রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার তারকা, ততটা ব্রাজিলের নন।

এককথায় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের তারকা হিসেবে নিজেদের চেনাতে পারেননি নতুন এই তারকারা। এমনকি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে নতুন তারকা হিসেবে কেউ উঠে আসছেন, তেমন ইঙ্গিতও নেই। যাঁরা উঠে আসছেন, তাঁরাও মূলত ইউরোপিয়ান ছাঁচে তৈরি হওয়া ফুটবলার। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সারবত্তা তাঁদের মাঝে খুব কমই দেখা যাচ্ছে।

সম্প্রতি ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার জালমিনিয়াও বলেছেন, দেশটি এখন আর নতুন তারকা তৈরি করতে পারছে না। তাঁর মতে, ইতিহাস এখন হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রথা ভেঙে ব্রাজিল কোচও নিয়ে এসেছে ইউরোপ থেকে। বৈপ্লবিক এই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের ফুটবলকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতেও পারে কিন্তু ঐতিহ্যে যে ছেদ পড়েছে, তা স্পষ্ট।

২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে শিরোপা জেতার পর রোনালদো নাজারিও
রয়টার্স

অনেকের কাছেই ব্রাজিলের ফুটবলের মূল সমস্যা শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। ঘরোয়া ফুটবলে নেই কোনো তারকা। এনদ্রিক, এস্তেভাওয়ের মতো কিশোররা ডানা মেলার আগেই উড়ে যাচ্ছেন ইউরোপে। ফলে যাঁরা তারকা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন, তাঁরা জানেনই না ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের আসল রূপ কী কিংবা ভূমির সঙ্গে এই খেলার সম্পর্কটা কেমন! এসব খেলোয়াড়েরা ব্রাজিলের ফুটবলে স্রেফ আগন্তুক হিসেবে থেকে যাচ্ছেন। যে কারণে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে দলটির খেলা এবং ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের স্পিরিটও সেখানে এখন আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারছে না দলটি।

আরও পড়ুন

ব্রাজিলের খেলোয়াড় তৈরি বড় একটি ক্ষেত্র ‘স্ট্রিট ফুটবল’। রাস্তার পাশে কিংবা অলিগলির ফুটবল থেকেই রিভেলিনো, জিকো, রোমারিওর মতো কিংবদন্তি ফুটবলারদের উত্থান। কিন্তু এখন সেই সংস্কৃতিতে একরকম ধসে পড়েছে। এ বিষয়ে ৫২ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান লাউরো নাসিমেন্তো বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছিলেন, ‘এখন আর কেউ রাস্তায় খেলে না। আর সেই গল্প শোনা যায় না যে ফুটবল খেলতে খেলতে কেউ কারও জানালা ভেঙে ফেলেছে।’

নেইমার কি হতাশা নিয়েই বিদায় নেবেন
রয়টার্স

একই প্রতিবেদনে ক্রীড়া ইতিহাসবিদ আইরা বোনফিম বলেন, ‘আগে খেলার জন্য যেকোনো খোলা জায়গা যথেষ্ট ছিল। এখন সেই জায়গাগুলোকে আবাসন ও উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা হয়।’ বর্তমানে দরিদ্র ব্রাজিলীয় শিশুদের খেলার জন্য প্রায়ই স্কুল, সামাজিক প্রকল্প বা ফুটবল একাডেমির ওপর নির্ভর করতে হয়। ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একাডেমির মাত্র পাঁচটিতে একজন শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে খেলতে পারে। বদলে যাওয়া এসব সংস্কৃতিই ব্রাজিলের ফুটবলার তৈরি ধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।

ব্রাজিলের এই সংকটের আরেকটি বড় কারণ যোগ্য ট্যাকটিশিয়ান বা কোচ উঠে না আসা। তরুণ ফুটবলারদের তৈরি করার বড় দায় থাকে স্থানীয় কোচদের। তৃণমূল পর্যায়ে কোচরাই প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বাছাই করে সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু ব্রাজিল দলে এখন তেমন কোচের অভাব স্পষ্ট। বিশ্ব ফুটবলে দাপট দেখাচ্ছেন এমন ব্রাজিলিয়ান কোচও খুব বেশি নেই। ফলে খুব শিগগির বর্তমান চিত্র বদলাবে, এমন ইঙ্গিত নেই। তবু ফুটবলের জনপদ ব্রাজিল নতুন নায়কের খোঁজে আছে। সবার চোখ এখন নিজেদের মাটি ও ঘ্রাণ দিয়ে গড়া নতুন তারকার আগমনের দিকেই।