ইতালি কেন টানা দুবার বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি, এবার কি পারবে
ইতালির ফুটবলের সংকট কি তবে চিরস্থায়ী হয়ে গেল! দুই দশক ধরে টালমাটাল একটা দল যখন টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে জায়গা না পাওয়ার শঙ্কায় থাকে, তখন প্রশ্নটা উঠবেই।
ফুটবলের ইতিহাসে ইতালির অবদান অনন্য। যে কটি দেশ ফুটবলকে নিজস্ব দর্শনে সমৃদ্ধ করেছে, ইতালি তাদের অন্যতম। শুধু চারবার বিশ্বকাপ জেতাই নয়, খেলাটিকে তারা দিয়েছে নিজস্ব এক ভাষা। দূর থেকে দেখলেও বোঝা যেত—এটা ইতালির ফুটবল। অথচ সেই ঐতিহ্য এখন প্রায় ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। দর্শন নেই, ভাষা নেই, খেলার ছন্দও নেই। পড়ে আছে শুধু ছাই।
২০২৬ বিশ্বকাপের জন্য ইউরোপিয়ান অঞ্চলের বাছাইয়ে গ্রুপ ‘আই’তে ইতালি আছে ২ নম্বরে। ৪ ম্যাচে তাদের পয়েন্ট ৯। শীর্ষে থাকা নরওয়ের পয়েন্ট ৫ ম্যাচে ১৫। ৩ নম্বরে থাকা ইসরায়েলের পয়েন্টও ইতালির সমান ৯। ফলে এস্তোনিয়া ও ইসরায়েলের বিপক্ষে আসছে দুটি ম্যাচ ইতালির জন্য বাঁচা-মরার লড়াই। কাঙ্ক্ষিত ফল না এলে আরও একবার বিশ্বকাপের স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত ইতালি বিশ্বকাপে খেলতে পারবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে প্রশ্ন উঠছে—যে দেশ একসময় বিশ্ব–ফুটবলের দিশারি ছিল, তাদের এই দশা হলো কেন?
এর উত্তর খুঁজতে ফিরতে হবে ২০০৬ সালে। সেবার কুখ্যাত ‘ক্যালসিওপোলি’ কেলেঙ্কারি কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইতালিয়ান ফুটবলকে। জুভেন্টাস, এসি মিলান, ফিওরেন্তিনা, লাৎসিও, রোমা—সব বড় ক্লাব জড়িয়ে পড়ে ফিক্সিংয়ে। শাস্তিও পেতে হয়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে সেই বছরই ইতালি বিশ্বকাপ জিতে সংকটকে আড়াল করে দেয়।
দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ২০১০ সালে। উয়েফার ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে চালুর পর আর্থিক সংকটে পড়ে মিলান, ইন্টার, জুভেন্টাসের মতো জায়ান্টরা। ইউরোপে প্রভাব হারায়, সিরি ‘আ’র মানও পড়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় দলে। ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়, এরপর টানা দুবার বাছাইপর্বই পেরোতে পারেনি তারা। আক্রমণভাগে নতুন তারকার অভাবও ছিল বড় সমস্যা।
রক্ষণভাগে অবশ্য ঐতিহ্য ধরে রেখেছে ইতালি। বুফন থেকে দোন্নারুম্মা, বোনুচ্চি থেকে কিয়েল্লিনি—সবাই ছিলেন বিশ্বমানের। মিডফিল্ডেও ভেরাত্তি, জর্জিনিও, টোনালি, বারেল্লাদের মতো খেলোয়াড় এসেছে। কিন্তু আক্রমণভাগে? রসি, বাজ্জো, টট্টি, দেল পিয়েরো কিংবা ইনজাগির পর আর তেমন নাম নেই। এখন ভরসা রাখতে হচ্ছে মাতেও রেতেগুই বা মইসে কিনের ওপর, যাঁদের পারফরম্যান্স ওঠানামা করে রোলার কোস্টারের মতো।
ইতালিয়ান বিশ্লেষক ম্যাসিমো ফ্রাঞ্চি মনে করেন, সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। তাঁর ভাষায়, ‘আমি একবার তুরিনে আট বছরের শিশুদের ম্যাচ দেখেছিলাম। এক ড্রিবলার ছেলেকে বদলি নামানো হয়, সে বল হারায়, কোচ গালাগালি শুরু করে। এই মানসিকতা থেকেই সমস্যা শুরু। আমরা আট বছর বয়স থেকেই ভয় শেখাচ্ছি। ইতালির রক্ষণভিত্তিক সংস্কৃতি এখন এক প্রজন্মের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
১৯৫০-এর দশকে উদ্ভাবিত ‘কাতেনাচ্চিও’ কৌশল ইতালিকে দিয়েছে বারোসি, মালদিনির মতো রক্ষণশিল্পী। কিন্তু একই ধারায় আক্রমণভাগ বিকশিত হয়নি। ফ্রাঞ্চির মতে, বড় শহরে স্কুল ও যুব ক্লাব থাকলেও শিশুদের অল্প বয়সেই ছাঁচে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রতিভা বিকাশের আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ফুটবলের ইতিহাসে ইতালির অবদান অনন্য। যে কটি দেশ ফুটবলকে নিজস্ব দর্শনে সমৃদ্ধ করেছে, ইতালি তাদের অন্যতম। শুধু চারবার বিশ্বকাপ জেতাই নয়, খেলাটিকে তারা দিয়েছে নিজস্ব এক ভাষা।
গত ১৫ বছরে ইতালির সম্ভাবনাময় ফরোয়ার্ডরা কেউই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দিতে পারেননি। গিউসিপ্পে রসি, মারিও বালোতেল্লি, এল শারাউই, ইনসিনিয়ে, কিয়েসা, ইম্মোবিলে—সবাই ছিলেন আলোচনায়, কেউই আলো জ্বালাতে পারেননি দীর্ঘ সময়। ইনসিনিয়ে, কিয়েসা, ইম্মোবিলে ছিলেন ২০২০ সালের ইউরোজয়ী দলের সদস্য, কিন্তু সেই সাফল্যও ফুটবলে স্থায়ী কোনো ছাপ রাখতে পারেনি।
গত দশকে মাত্র দুজন ইতালীয় খেলোয়াড় সিরি ‘আ’তে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন—চিরো ইম্মোবিলে (৩ বার) ও ফাবিও কোয়াগলিয়ারেলা। অথচ একবিংশ শতকের প্রথম দশকে সেই সংখ্যা ছিল সাতজন। ফ্রাঞ্চির মতে, স্থানীয় ক্লাবগুলোতে বিদেশি খেলোয়াড়ের আধিক্য তরুণ ইতালীয়দের পথ আটকে দিচ্ছে।
ইন্টার মিলান ২০১০ সালে শেষবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল। কিন্তু সেই একাদশে একজনও ইতালিয়ান ছিল না। জাতীয় দলও একই পথে হাঁটছে। গত এক দশকে নাগরিকত্ব দিয়ে দলে ভিড়িয়েছে একঝাঁক ব্রাজিলিয়ান বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়কে। এদের, লুইজ ফেলিপে, জোয়াও পেদ্রো, জর্জিনিও, এমারসন, রাফায়েল তোলোই—নামের তালিকাটাই বলে দেয় অনেক কিছু।
কাতেনাচ্চিও আঁকড়ে ধরে ইতালি আধুনিক ফুটবলের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। বারবার কোচ বদলানোয় কৌশলগত বিবর্তনও হয়নি। ফলে দলটা যেন এক অন্ধকার গলিতে আটকে গেছে।
এখন দায়িত্ব গাত্তুসোর হাতে। একসময় বিশ্বকাপজয়ী মিডফিল্ডার হলেও কোচ হিসেবে এখনো নিজের দর্শন দাঁড় করাতে পারেননি। ফ্রাঞ্চির মন্তব্য, ‘গাত্তুসোর হৃদয় বিশাল, কিন্তু সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি আনচেলত্তি বা ক্যাপেলো নন, বরং ছায়া-প্রশিক্ষক।’
সব মিলিয়ে, হয়তো এবার কোনোভাবে বিশ্বকাপের টিকিট মিলবে। কিন্তু ইতালিয়ান ফুটবল যে অন্ধকার টানেলে ঢুকে পড়েছে, সেখান থেকে আলোয় ফেরার পথ এখনো অনেক দূর।