সৌদি আরবে গিয়ে ইংলিশ ফুটবলকে যে ধাক্কা দিলেন হেন্ডারসন

লিভারপুল ছেড়ে হেন্ডারসন এখন আল ইত্তিফাকেরছবি: টুইটার

জনপ্রিয়তা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বরাবরই দাপুটে। অন্য লিগগুলোয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটা যেখানে দুই–একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ইংলিশ লিগে লড়াইটা সেখানে চতুর্মুখী, কখনো কখনো আরও বেশি দলের। এমনকি লিভারপুলের মতো শীর্ষ সারির দলকেও অনেক সময় থাকতে হয় সেরা চারের বাইরে। এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরপুর রোমাঞ্চের মঞ্চ ছেড়ে ইংল্যান্ডের তারকা খেলোয়াড়দেরও বাইরে যাওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন পড়েনি।

নিজ লিগ খেলেই বিশ্বসেরার তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন তাঁরা। ডেভিড বেকহাম, মাইকেল ওয়েনের মতো দু–একটি ব্যতিক্রম উদাহরণ বাদ দিলে যাঁরা গেছেন, তাঁরা ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে গিয়েই ইংল্যান্ডের বাইরের লিগে খেলেছেন। বেশির ভাগই তখন পাদপ্রদীপের বাইরে।

আরও পড়ুন

ইংলিশ ফুটবলারদের ইল্যান্ডের বাইরে গিয়ে না খেলা নিয়ে কথা বলেছিলেন খোদ ইংল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। ভিন্ন দল, সংস্কৃতি ও পরিবেশে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকা নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্নই ছিলেন সাউথগেট। বিশেষ করে নিজেদের পরিচিত গণ্ডিতে ভালো অঙ্কের বেতনে ইংলিশ ফুটবলাররা কেন আটকে যাচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই কোচ। তাঁর সেই উদ্বেগ কিছুটা হলেও কি কমিয়েছেন জর্ডান হেন্ডারসন? ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সহ–অধিনায়ক নিজেই এখন ইংল্যান্ডের বাইরে গিয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কিন্তু ইংল্যান্ডের বাইরে যে দেশকে এবং যে ক্লাবকে হেন্ডারসন নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তা বোধ হয় সাউথগেটকে স্বস্তি দেওয়ার বদলে তাঁর উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে। ইংল্যান্ড দলের সহ–অধিনায়ক এবং লিভারপুল অধিনায়ক যে নিজের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন সৌদি প্রো লিগের ক্লাব ইত্তিফাককে।

আল ইত্তিফাকে স্টিভেন জেরার্ডের অধীন খেলবেন হেন্ডারসন
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

সাউথগেট যে ভিন্ন স্টাইলের ফুটবলের কথা বলেছেন, সেটা কিন্তু সৌদি আরবে ঠিকই পাবেন হেন্ডারসন, এমনকি ভিন্ন জীবনধারার স্বাদও পাবেন এই মিডফিল্ডার। কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অভিজ্ঞতা পেতে কদিন আগেও আলোচনার বাইরে থাকা একটি লিগের সাত নম্বরে থাকা দলকে কেন বেছে নিতে হলো তাঁকে? অথচ হেন্ডারসন শুধু মাঠের খেলায়ই নয়, মাঠের বাইরেও নিজের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের কারণে ইংলিশ ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আরও পড়ুন

আর এমন নয় যে বয়সও তাঁর পক্ষে নেই। গত জুনেই ৩৩ পেরিয়েছেন আর লিভারপুলের সঙ্গে তাঁর এখনো ২ বছরের চুক্তি বাকি আছে। হ্যাঁ, পুরোনো ধার যে হারিয়েছেন, তা মিথ্যা নয়। কিন্তু সেটা এমনও নয় যে তাঁকে এখনই সৌদি ফুটবলকে বেছে নিতে হবে। কেউ চাইলে এখন প্রশ্ন করতে পারেন, সপ্তাহপ্রতি সাত লাখ পাউন্ড বেতনের লোভেই কি এই সিদ্ধান্ত নিলেন হেন্ডারসন? তবে আসল কারণ যা–ই হোক, হেন্ডারসনের এই সিদ্ধান্ত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং করিম বেনজেমার সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

রোনালদো সৌদি আরবে গেছেন ৩৮ বছর বয়সে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে বিষিয়ে ওঠা সম্পর্কের ইতি টানতে এই পথ বেছে নেন পর্তুগিজ মহাতারকা। আর বেনজেমাও সৌদি আরবে গেছেন ৩৫ পেরোনোর পর। তাঁর সঙ্গে রিয়াল মাদ্রিদের চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এমনকি ‘বিদায়’ বলে দিয়েছেন জাতীয় দলকেও। চাইলে তাই নানাভাবে এ দুজনের সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা খুঁজে বের করা যায়। কিন্তু হেন্ডারসনের ক্ষেত্রে বিষয়টা মোটেই তেমন নয়।

জর্ডান হেন্ডারসন
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

আগেই বলা হয়েছে যে হেন্ডারসন সাধারণ কোনো খেলোয়াড় নন। তিনি একই সঙ্গে লিভারপুলের অধিনায়ক এবং ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সহ–অধিনায়ক। এ ছাড়া ফুটবলের বাইরে সামাজিক নানা অন্যায় ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর হিসেবেও পরিচিতি আছে তাঁর। সমকামিতাবিরোধী, বৈষম্য এবং যেকোনো অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় কথা বলতে দেখা গেছে তাঁকে। যে কারণে তাঁর সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনেককেই হতাশ করেছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চলমান নানা উদ্বেগের মধ্যে হেন্ডারসনের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি মানতে পারছেন না অনেকেই।

আরও পড়ুন

তা ছাড়া খেলোয়াড়দের মধ্যেও হেন্ডারসন দারুণভাবে সম্মানিত ও জনপ্রিয়। করোনা মহামারি চলাকালে প্রিমিয়ার লিগ এবং পিএফএর যখন মাঠে ও মাঠের বাইরে নেতার প্রয়োজন হয়, তখন সবাই বেছে নিয়েছিলেন হেন্ডারসনকেই। লিভারপুল অধিনায়ক অনেকের কাছেই ‘অধিনায়কদের অধিনায়ক’ হিসেবে পরিচিত। এমনকি সাউথগেটের দলেও হেন্ডারসনকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। ২০২৪ ইউরোতেও ধারণা করা হচ্ছিল যে সাউথগেট হাত বাড়াবেন হেন্ডারসনের অভিজ্ঞতার দিকে। কিন্তু এই মিডফিল্ডারের সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখন পুরো পরিস্থিতিকে কিছুটা ঘোলাটে করে তুলেছে।

শুধু সৌদি আরবই নয়, হেন্ডারসনের ক্লাব পছন্দ করার বিষয়টি নিয়েও চলছে আলোচনা–সমালোচনা। রোনালদোর আল নাসর এবং আল ইত্তিফাক মোটেই এক রকম নয়। আল নাসরের বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী আছে, রোনালদো আসার আগেই তারা শিরোপা–দৌড়ে ছিল। এমনকি তাদের সাত খেলোয়াড় বিশ্বকাপেও খেলেছেন। সামনেও শিরোপা জয়ের আশা নিয়ে দল সাজাচ্ছে তারা। অন্যদিকে গত মৌসুমে আল ইত্তিফাক মৌসুম শেষ করেছে ৭ নম্বরে থেকে, যেখানে তাদের গড় দর্শক উপস্থিতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ হাজার ৫৬১। গত মৌসুমে যাদের সবচেয়ে বড় তারকা ছিল ব্রাজিলের ভিতিনহো আর বিশ্বকাপে এই ক্লাবের কোনো প্রতিনিধিও ছিল না।

আরও পড়ুন

হেন্ডারসনের প্রিমিয়ার লিগ সতীর্থরা যেখানে সৌদি আরবের বড় ক্লাবগুলো বেছে নিচ্ছেন, হেন্ডারসনের মাপের খেলোয়াড়ের আল ইত্তিফাককে বেছে নেওয়াটা অবাক করা ব্যাপারই বটে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কেউ চাইলে স্টিভেন জেরার্ডের কথা বলতে পারেন, যিনি সম্প্রতি আল ইত্তিফাকের কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন। হেন্ডারসনের আল ইত্তিফাকে যাওয়ার পেছনে হয়তো জেরার্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

ইংল্যান্ডের বাইরে খেলতে যাওয়া খেলোয়াড়দের ব্যাপারে সাউথগেট উদারতার কথা বললেও ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন কিছুই বলছে। গ্লেন হোডেল ও ক্রিস ওয়াডলে ফ্রান্সে নিজেদের সেরা ছন্দে থাকলেও ইংল্যান্ডে একরকম নির্বাসিতই ছিলেন। স্টিভ ম্যাকম্যানামান রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে শিরোপা জয়ের ধারায় থাকলেও ইংল্যান্ড দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে পড়েছিলেন বিতর্কের মুখে। তাই সব দিক বিবেচনায় হেন্ডারসনের বিপদ সম্ভবত আরও বাড়তে যাচ্ছে। তিনি শুধু নিচের সারির লিগে নয়, বেছে নিয়েছেন নিচের সারির ক্লাবকেও, যা নিশ্চিতভাবে সাউথগেটের অস্বস্তি বাড়াবে।

সব মিলিয়ে হেন্ডারসনের সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে বার্তা দিচ্ছে, তা হলো, একটি আন্তর্জাতিক দলের অভিজ্ঞ ফুটবলার, যিনি বিশ্বের সেরা ক্লাবগুলোর একটির অধিনায়ক এবং মাঠের বাইরে নিজের কণ্ঠস্বরের কারণে অনেকের আদর্শ, সেই খেলোয়াড়ই বড় অঙ্কের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ইংলিশ ফুটবলকে ‘না’ বলে পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবের নিচের সারির এক ক্লাবে।

অথচ অন্য লিগগুলো বিভিন্ন সময় তাদের শীর্ষ খেলোয়াড়েরা ইংলিশ লিগকে বেছে নিচ্ছেন বলে হতাশা প্রকাশ করেছে। হেন্ডারসনের সিদ্ধান্ত তাই ইংলিশ ফুটবল–সংস্কৃতির জন্য বড় ধরনের এক ধাক্কাই বটে। পাশাপাশি হেন্ডারসনের সিদ্ধান্ত এই বার্তাও দেয় যে কল্পনার বাইরে থেকে আসা আর্থিক প্রস্তাব বদলে দিতে পারে কারও কারও আদর্শিক অবস্থানকেও।

দ্য অ্যাথলেটিক অবলম্বনে