ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে কি সুযোগ পাবেন নেইমার

সান্তোসের ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার জুনিয়ররয়টার্স

২০১০ সালের কথা। নেইমার তখন সান্তোসে। দরিভাল জুনিয়র ক্লাবটির কোচ। একটি ম্যাচে মাঠ থেকে নেইমারকে তুলে নেন দরিভাল। বেঞ্চে বসে সবার সামনেই কোচের ওপর ক্ষোভ উগরে দেন নেইমার। ১৮ বছর বয়সী নেইমার তখন মাঠে প্রায় অপ্রতিরোধ্য ও তুখোড় ফুটবলার। ব্রাজিলিয়ানরা তাতে মজেছিলেন। সে কারণে নেইমার নয়, দরিভালকে তাঁর সিদ্ধান্তের কারণে দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়।

১৫ বছর পরের কথা।

মারাকানায় গত সোমবার ফ্ল্যামেঙ্গো-সান্তোস ম্যাচ চলছিল। দৃশ্যপটে খানিকটা পরিবর্তন। নেইমার সেই আগের মানুষটি আর নেই। ৩৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের শরীর আগের চেয়ে আরেকটু ভারী ও গতি কমেছে। অতীতের সেই ঝলকও আগের মতো আর পায়ে ফোটে না। কিন্তু সান্তোস কোচ হুয়ান পাবলো ভয়ভোদা তাঁকে বদলি হিসেবে তুলে নিতেই বাধল বিপত্তি। নেইমার রেগে কাঁই। কোচ তাঁকে তুলে নেওয়ায় রাগটা ঝাড়লেন সবার সামনেই।

তখন দেখে মনে হয়েছে, নেইমার আসলে কোচ নয়, সান্তোস নয়, লড়ছিলেন এমন এক বাস্তবতার সঙ্গে যেটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বয়স! ৩৩ বছর বয়সী নেইমার মানতেই পারছিলেন না, তাঁর এখন বয়স হয়েছে। অবনমনের শঙ্কায় পড়া একটি ক্লাবের জন্য তাঁকে নিষ্ফলা হিসেবে পুরো সময় খেলানো বিলাসিতা। ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্যও কি এই মুহূর্তে ব্যাপারটি খুব মিথ্যা?

জাতীয় দলের প্রসঙ্গে আসার আগে সেই ম্যাচে নেইমারের দুটি মন্তব্য উল্লেখ না করলেই নয়। বিরতির সময় সতীর্থদের বলেছেন, ‘ফাইনাল থার্ডে (আক্রমণভাগ) আমাকে বেশি বেশি খুঁজতে হবে। গোল করার এটাই একমাত্র পথ।’

কথাটি ভাঙলে বোঝা যায় বিষয়টি আসলে এমন—সান্তোসকে গোল পাইয়ে দেওয়ার একমাত্র পথ হলো অ্যাটাকিং থার্ডে নেইমারকে বেশি বেশি পাস দেওয়া। এই কথার আরেকটি অর্থ হতে পারে এমন, প্রতিপক্ষের বক্সের চারপাশে খেলার আগের সেই ধার ও শারীরিক সামর্থ্য আর নেই নেইমারের। এ কারণে গোল বানানো ও গোল করার দায়িত্ব তাঁর যতটা, সতীর্থদের তাঁকে খুঁজে বের করে গোল করানোর দায়িত্বটা আরও বেশি। বিশ্বাস হয় এটা নেইমারের কথা!

বদলি হয়ে উঠে আসার সময় কোচকে নেইমার বলেছেন, ‘আমাকে তুলে নিচ্ছ নাকি?’ তখন ম্যাচের ৮৫ মিনিট। সান্তোস ৩-০ গোলে পিছিয়ে। কাগজে-কলমে দলের সেরা তারকাকে এমন সময়ে কোচ যদি তুলে নেন, তাহলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় গোলের জন্য সান্তোস কোচ আর নেইমারের ওপর ভরসা রাখেন না। সান্তোস ম্যাচটি হারলেও নেইমার উঠে যাওয়ার পর দুই গোল করেছে।

আরও পড়ুন

এবার ১৫ বছর আগে-পরের দৃশ্যপটে ফেরা যাক। ২০১০ সালের সেই সময়ে গোটা ব্রাজিল ছিল নেইমারের পক্ষে। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে নেইমারের পক্ষে প্রায় কেউ নেই। ব্রাজিলজুড়ে তাঁর অমন আচরণের তুমুল সমালোচনা হয়েছে। নির্মম বাস্তবতা হলো, ব্রাজিলিয়ানরা তাদের সোনার ছেলেটির ওপর আস্থা রাখেন না। কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর আপনার জানা থাকলেও ব্রাজিলিয়ান খ্যাতিমান সাংবাদিক জুকা কাফুরির মুখে শুনতে পারেন, ‘আমার ৫৫ বছরের ক্যারিয়ারে নেইমার প্রতিভার সবচেয়ে বড় অপচয়।’

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে ফেরা যাক।

ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বশেষ ২০২৩ সালে খেলেছেন নেইমার
রয়টার্স

ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে নেইমার সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছেন ২০২৩ সালের অক্টোবরে। অর্থাৎ জাতীয় দলের বাইরে রয়েছেন দুই বছরের বেশি সময়। এর মধ্যে নেইমার যে ফেরার চেষ্টা করেননি, তা নয়। কিন্তু তাঁর ক্যারিয়ারে ‘ট্রেডমার্ক’ যে দুটি বিষয়—চোট এবং মাঠের বাইরে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড—সেসব কারণে ব্রাজিল জাতীয় দল দূরের কথা সান্তোসের হয়েই নিয়মিত খেলার সুযোগ পাননি। ২০২৬ বিশ্বকাপ ওদিকে কড়া নাড়ছে দুয়ারে। সাত মাসের কম সময় বাকি। ব্রাজিলের কোচ কার্লো আনচেলত্তি নেইমারেরর জন্য জাতীয় দলের দরজা খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও শর্ত বেঁধে দিয়েছেন, ‘পূর্ণ ফিট হতে হবে।’

এই ফিটনেস যে শুধু শারীরিক নয় খেলার দক্ষতার ব্যাপারটিও অর্ন্তনিহিতভাবে লুকায়িত—তা ব্রাজিলের ফুটবল বোদ্ধারা আগেই বিশ্লেষণ করেছেন। এখন নেইমারের ফিটনেসের কী অবস্থা, তা তো সান্তোসের সর্বশেষ ম্যাচেই টের পাওয়া গেল। এই অবস্থায় ২০২৬ বিশ্বকাপ ভুলে যান, জাতীয় দলে ফেরাটাই তাঁর জন্য বেশ কঠিন। কারণ, আনচেলত্তি বিশ্বকাপের জন্য ঘর (দল) গুছিয়ে নেওয়ার শেষ পর্যায়ে। আর সেনেগালের বিপক্ষে গত পরশু রাতের প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিলের ২-০ গোলের জয়কে বিশেষজ্ঞরা দেখছেন আনচেলত্তির অধীনে এস্তেভাও-ভিনিসিয়ুসদের সেরা ম্যাচ হিসেবে।

আরও পড়ুন

অর্থাৎ নেইমারকে ছাড়াই একটু একটু করে বেশ ভালোই দল গুছিয়ে নিচ্ছেন আনচেলত্তি। সেই দলে নেইমারকে ফিরতে হলে সবার আগে সান্তোসের হয়ে ফর্মে ফিরতে হবে। তারপর জাতীয় দলের কথা ভাবার সুযোগ আসবে। চলতি মৌসুমে সান্তোসের হাতে সব মিলিয়ে আর পাঁচ ম্যাচ বাকি। জানুয়ারিতে শুরু হবে নতুন মৌসুম। নেইমারকে যা করার এ সময়েই করতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, যত দিন যাচ্ছে কাজটা তাঁর জন্য খুব খুব কঠিন হয়ে উঠছে।

ব্রাজিল জাতীয় দলের সূচিতে তাকালে ব্যাপারটা অসম্ভবও মনে হতে পারে। আগামী ১৯ নভেম্বর তিউনিসিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলার পর ব্রাজিল ২০২৬ বিশ্বকাপের আগে তাদের পরবর্তী ম্যাচ খেলবে আগামী মার্চে। তখনই মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে বিশ্বকাপের দল। অর্থাৎ জাতীয় দলে ফিরে থিতু হতে নেইমারের হাতে আসলে সময় নেই। ধরে নেওয়া যাক, ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলে আগামী মৌসুমে খুব ভালো করলেন নেইমার। কিন্তু দলে তাঁর জায়গা হবে কোথায়?

ব্রাজিল কোচ কার্লো আনচেলত্তি
ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন ওয়েবসাইট (সিবিএফ)

আনচেলত্তি এর আগে বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, এখন ওর (নেইমার) খেলা উচিত ডান-বাঁ প্রান্তে নয়, বরং কেন্দ্রে। কারণ, আধুনিক ফুটবলে উইঙ্গারদের শুধু আক্রমণ নয়, রক্ষণেও সাহায্য করতে হয়। মাঝখানে খেললে সেই চাপটা অনেক কমে যায়।’

ব্রাজিল কোচের এই কথার মধ্যেই ফাঁক আছে। ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া নেইমারের শারীরিক বিষয়টি মাথায় রেখে এই কথা বলেছেন আনচেলত্তি। অর্থাৎ শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষায় আগে পাস করতে হবে। ওদিকে পরিসংখ্যান বলছে, নেইমার ক্লাবের হয়ে সর্বশেষ এক মৌসুমে অন্তত ৪০ ম্যাচ খেলেছেন ২০১৬-১৭ মৌসুমে। নিয়মিত মাঠে না থাকা কাউকে কি পজিশন বদলে (ফলস নাইন) বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে খেলাবেন আনচেলত্তি?

এই প্রশ্নটি এখনই উঠছে কারণ, পজিশন বদলে নেইমারকে খেলতে হলে সবার আগে ওই পজিশনে তাঁকে খাপ খাওয়াতে হবে। এখন পর্যন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, নতুন পজিশনে খাপ খাওয়ানো দূরে থাক, নিয়মিত তো মাঠেই নামতে পারছেন না নেইমার। আরও বড় প্রশ্ন হলো, বিশ্বকাপে ব্রাজিল তাঁর কাছ থেকে সেরাটা পেতে চাইলে নতুন পজিশনে সেটা কতটা সম্ভব? আনচেলত্তির কথাটা তাই নেইমারকে দেওয়া সান্ত্বনা মনে হতে পারে।

কারণ, আক্রমণভাগের বিভিন্ন পজিশনে এস্তেভাও-ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগো-রাফিনিয়াদের এ সময়ে তৈরি করেছেন আনচেলত্তি। এর মধ্যে নেইমারকে নতুন পজিশনে খেলানো আনচেলত্তির ফুটবলীয় প্রজ্ঞার সঙ্গে ঠিক যায় না। তাঁর মতো কোচ গোছানো দলের মধ্যে কারও জন্য নতুন পজিশন তৈরি করে কেন বিশ্বকাপের মতো আসরে খেলানো এবং তাঁর কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনার ঝুঁকি নেবেন সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। এত দিন ধরে একজন খেলোয়াড় যে পজিশনে খেলে অভ্যস্ত, বিশ্বকাপে সেই পজিশনে খেলালেই তো তাঁর থেকে সেরাটা আদায়ের নিশ্চয়তা বেশি? আনচেলত্তির মতো প্রজ্ঞাবান কোচের ব্যাপারটি নিশ্চয়ই অজানা নয়।

সেনেগালের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে দারুণ খেলে জিতেছে ব্রাজিল
এএফপি

একটু অতীতে ফেরা যাক।

নেইমার নিশ্চয়ই রোমারিও, রোনালদো ও রোনালদিনিওর চেয়ে বড় তারকা হয়ে উঠতে পারেননি এখনো।

২০০২ বিশ্বকাপের আগের মৌসুমে ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলে ভাস্কো দ্য গামার হয়ে ৩৯ ম্যাচে ৪০ গোল করেছিলেন ’৯৪ বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি ৩৫ বছর বয়সী রোমারিও। কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপের দলে তাঁর জায়গা হয়নি। যুক্তি দিতে পারেন, তখন দলে রোনালদো ছিলেন এবং বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণার আগে কোচ লুই ফেলিপে স্কলারির সঙ্গে রোমারিওর সম্পর্ক চরম তিক্ততায় রূপ নিয়েছিল। নেইমারের বিষয়টি এখনো সে পর্যায়ে না গেলেও তাঁর রগচটা মেজাজটা কিন্তু এখন প্রকাশিত।

আরও পড়ুন

রোনালদোর উদাহরণও দেওয়া যায়। ২০০৯ সালে রোনালদোর বয়স ছিল ৩৩ বছর। করিন্থিয়ানসের হয়ে সে বছর ৩৮ ম্যাচে ২৩ গোল ও ৪টি গোল বানিয়েও ২০১০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর। রোনালদিনিওকে স্মরণ করুন। ২০১৩ সালে তাঁর বয়সও ছিল ৩৩ বছর। সে বছর আতলেতিকো মিনেইরোকে দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ শিরোপা কোপা লিবার্তাদোরেস জেতান কিংবদন্তি। গোল করেন ১৭টি। গোল করান ১৪টি। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলে তাঁর জায়গা হয়নি।

নেইমারের বয়সও এখন ৩৩ বছর। বিশ্বকাপের আগে এ বছর তাঁর পারফরম্যান্সে তাকান—২৪ ম্যাচে ৬ গোল। গোল বানিয়েছেন ৩টি। তাঁর দল সান্তোস অবনমনের শঙ্কায়। তাহলে? ২০২৬ বিশ্বকাপ ব্রাজিল দলে কি নেইমারের জায়গা দেখেন?

নেইমার কি জায়গা পাবেন ২০২৬ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলে
রয়টার্স

অনেকেই দেখেন। কারণ, নেইমারের প্রতিভা। এই প্রতিভার বলে এত সব বাধাবিপত্তি টপকে তিনি ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলতেই পারেন। তাঁর ভক্তদের আশার মূল কারণও এ প্রতিভা। নেইমারকে নিয়ে ভক্তদের এখনো আশায় বুক বাঁধার কারণটা ব্যাখ্যা করেছেন ফ্রান্সের মনোবিদ ও মনোবিশ্লেষক জ্যাক লাকাঁ। তাঁর মতে, নেইমারকে এখনো ব্রাজিল দলে এবং বিশ্বকাপে দেখতে চাওয়ার মূল কারণ হলো তাঁকে নিয়ে তাঁর ভক্তদের বাসনা। বছরের পর বছর ধরে নেইমারকে জাতীয় দলে সবাই যেভাবে দেখতে চেয়েছেন (সেভাবে পারেননি), বিশ্বকাপে যেমন পারফরম্যান্স দেখার প্রত্যাশা করেছেন, সেসবের কিছুই তো পূরণ হয়নি। এ কারণে অবচেতন মনে একটা বিশ্বাস জন্মেছে যে ২০২৬ বিশ্বকাপে নেইমারই ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় তারকা।

সেটা অবশ্যই কাগজে-কলমে। মাঠে এখন পর্যন্ত তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। আরও একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। রোনালদো ও রোনালদিনিও বেশ ভালো পারফর্ম করেও বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়ার পর ব্রাজিলে কিন্তু এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও হয়নি। সে তুলনায় নেইমারের এখন পর্যন্ত যে পারফরম্যান্স—তাতে কী হতে পারে সেটা তো কল্পনা করে নেওয়াই যায়। আনচেলত্তি তবু যদি তাঁকে বিশ্বকাপ দলে রাখেন, সে ক্ষেত্রে ব্রাজিলিয়ান ড্রেসিংরুমে কেউ কেউ ‘হাতির উপস্থিতি’ও (বেমানান) ভেবে নিতে পারেন। তবে এই বিষয়টি সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়াই নিরাপদ।

আপাতত এখন পর্যন্ত ব্রাজিল দলে নেইমারের জায়গা কি দেখেন?

আবেগ থেকে দেখলে জায়গা আছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, নেইমারকে টিভিতে ২০২৬ বিশ্বকাপ দেখতে হতে পারে!