ভাইকে লেখা চিঠিতে এনদ্রিকের জীবনের গল্প

এনদ্রিকের কাঁধে তাঁর ভাই নোয়াইনস্টাগ্রাম

অল্প বয়সে তোলপাড় করা অনেক ফুটবলারই এসেছেন ব্রাজিলের ইতিহাসে। তবে তাঁদের সবাই যে পরে পেলে, জিকো, রোমারিও, রোনালদো, রোনালদিনিও, নেইমারদের মতো মহাতারকা হতে পেরেছেন, এমন নয়। কেউ কেউ হারিয়ে গেছেন ঝলক দেখিয়েই। ১৭ বছর বয়সী এনদ্রিক কোন পথে হাঁটবেন, সেটা সময়ই বলবে।

তবে ব্রাজিলের জার্সিতে তাঁর শুরুটা হয়েছে দারুণ, ওয়েম্বলিতে গত শনিবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো এক গোল দিয়ে। প্রবল সম্ভাবনা দেখেই ব্রাজিলিয়ান এই স্ট্রাইকারকে এরই মধ্যে কিনে রেখেছে রিয়াল মাদ্রিদ। তবে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যোগ দিতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে বয়স ১৮ হওয়া পর্যন্ত। বার্নাব্যুতে খেলার অপেক্ষা অবশ্য তাঁর আজই ফুরাচ্ছে।

আজ বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ৩০ মিনিটে রিয়ালের মাঠে ব্রাজিল মুখোমুখি হবে স্পেনের। তার আগে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের নতুন উঠতি তারকা এই ‘প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’-এ নিজের ভাইকে একটি চিঠি লিখেছেন এনদ্রিক। ভীষণ আবেগমাখা সেই চিঠিতে উঠে এসেছে এনদ্রিকের জীবনের গল্পও—

আরও পড়ুন

প্রিয় নোয়া,

আমি তোমাকে ভালোবাসি। সবকিছু ছাপিয়ে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সেই প্রথম দিন থেকেই এটা বুঝতে পারি, তোমার-আমার বন্ধনটা বিশেষ কিছু। তোমাকে কখনো এ কথা বলিনি—যেদিন তুমি জন্মালে, আমার মনে হয়েছিল, মায়ের পেটে থাকতেই তুমি আমার গোল করার অপেক্ষায় ছিলে।

ভাই, এই গল্প সত্যি। তখন আমার বয়স ১৩ বছর। সেদিন গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ খেলছিলাম। আর তুমি কেন জানি মায়ের পেট থেকে বের হতে চাইছিলে না। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছিল টিক টিক করে। মা-বাবার তো খুব ভাবনা হচ্ছিল—তোমার অপেক্ষাটা কিসের! হঠাৎই বাবাকে তাঁর এক বন্ধু ফোন করলেন, যে সেই ম্যাচে ছিল। বাবাকে তিনি বললেন, ‘ডগলাস! ডগলাস! এনদ্রিক এই মাত্র গোল করল!’

ভাইকে ভীষণ ভালোবাসেন এনদ্রিক। পালমেইরাসের জার্সিতে ছবিটি তোলা
ইনস্টাগ্রাম

ঠিক সে মুহূর্তেই হাসপাতালে কান্নার রোল উঠল, ‘ওয়ায়ায়ায়া!’ ভাই, শেষ পর্যন্ত তুমি এলে আমার সঙ্গে গোল উদ্‌যাপন করতে।

হাসপাতালে গিয়ে তোমাকে জন্মদিনের উপহার দিয়েছিলাম। একটা খেলনা কেনার পয়সাও ছিল না। টুর্নামেন্টে যে সোনালি বলটা জিতেছিলাম, সেটাই তোমাকে দিয়েছি। তোমার মনে আছে? পরিবারে আমরা সোনা-রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। ফুটবলের যে জন্মস্থান, আমরা জন্মেছি সেখানে।

আরও পড়ুন

জানি না এই চিঠি তুমি কখন পড়বে। চার বছর বয়স হয়ে গেল তোমার। আমাদের জীবনটাও দ্রুত পাল্টাচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যে আমি স্পেনে যাব, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলব—হ্যাঁ, ওই দলটাই, প্লে স্টেশনে খেলার সময় যে দলটাকে আমি সব সময় বেছে নিয়েছি, তুমি সেটা দেখেছ। আমি জানি, পৃথিবী আমাদের পরিবারের গল্প শুনতে চায়। ভাই, গল্পটা কী অবিশ্বাস্য!

তুমি জানো আমাদের পরিবারে সবকিছুর শুরু ও শেষ বল দিয়ে। ঠিক তোমার মতোই—ছোটবেলায় আমি খেলনা পেলে সর্বোচ্চ পাঁচ সেকেন্ডের জন্য হাতে রেখেছি। এরপর বক্সে তুলে রেখেছি। সব সময় শুধু একটা জিনিসই চেয়েছি—‘বল! বল! বল!’

সেটা যেকোনো বল। টেপ দিয়ে প্যাঁচানো, মোজা দিয়ে বানানো কিংবা বাস্কেটবল। বলটা বর্গাকৃতির হলেও লাথি মারতে চাইতাম। ২০১৪ বিশ্বকাপের বল যখন হাতে পেয়েছিলাম (বাবার মারফত), মুগ্ধ হয়ে বলের রং-টা দেখেছি। রাতে বলটা জড়িয়ে ধরে ঘুমোতাম। এই জিনিস আমাদের রক্তে ভাই!

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গোলের পর এনদ্রিকের উদ্‌যাপন
এএফপি

তুমি মাকে জিজ্ঞেস করতে পারো, লোকে আমার নাম জিজ্ঞেস করলে কী বলতাম, ‘এনদ্রিক ফেলিপে মোরেইরা দে সউসা, ফরোয়ার্ড।’ লোকে শুনে হাসত। কিন্তু আমি খুব সিরিয়াস থাকতাম। আমি জানতাম, আমি পারব (লক্ষ্য পূরণ করতে)। মা সেসব দিন স্মরণ করে এখনো কাঁদেন। বলেন, শব্দ কী শক্তিশালী!

এখন আমরা যে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে থাকি, তখন কিন্তু এমন কিছুই ছিল না। ভিয়া গুয়েইরায় একটা পাহাড়ের ওপর থাকতাম। জীবন তখন অন্য রকম ছিল। অবিশ্বাস্য এক শৈশব আমি পেয়েছি। সে জন্য মা-বাবা, সৃষ্টিকর্তা এবং অবশ্যই ফুটবলকে ধন্যবাদ।

সেই সময়টা আমি মিস করি। মনে পড়লে ভালোর সঙ্গে খারাপও লাগে। কিন্তু দুঃখের স্মৃতিও তো কখনো কখনো মিষ্টি লাগে, তাই না?

আরও পড়ুন

তুমি আরেকটু বড় হলে লোকের মুখে শুনবে, আমরা খুব গরিব ছিলাম। ঠিকমতো খেতে পেতাম না। কিন্তু এসব মিথ্যা কথা। আমার মাকে তাঁরা জানে না। মা বলেন, ‘সন্তানদের খাবার ছাড়া রাখব, এমন নারী আমি নই।’

সত্যিটা হলো, একদিন বাবাকে সোফায় বসে কাঁদতে দেখেছিলাম। সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের (আর্থিক) অবস্থা তেমন একটা ভালো না। হ্যাঁ, খাবার টেবিলে মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণ হয়েছে। কিন্তু সবার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না কখনোই। এই পার্থক্য কি তুমি বুঝতে পারো? আমরা সব সময় টানাটানির মধ্যে থেকেছি। বাবার পাশে বসে বলেছিলাম, ‘ভেবো না, ফুটবল দিয়ে আমি পরিবারের সবার জীবন পাল্টে ফেলব।’

তারপর ফুটবল হয়ে গেল আমার আরেকটু ভালো জীবন অনুসন্ধানের পথ। কয়েক সপ্তাহ পর সাও পাওলো ও পালমেইরাসের অনুশীলনে গিয়ে নিজের প্রথম লক্ষ্য হিসেবে লিখেছিলাম, ‘আমার পরিবারকে ভালো রাখতে চাই।’

পরিবারের সঙ্গে এনদ্রিক
ইনস্টাগ্রাম

পালমেইরাসে যোগ দেওয়ার পর আমি জানতাম, অনুশীলন ও স্কুল মিলিয়ে দিনে ২ থেকে ৩ বার খাবার পাব। ক্লাব থাকার জন্য আমাকে একটি ঘর দিয়েছিল। মা কোনোভাবেই আমাকে একা ছাড়বেন না। বাবা ব্রাসিলিয়া থেকে টাকা পাঠাতেন। আর ওদিকে আমি মাকে নিয়ে এবং আরও কয়েক সতীর্থকে নিয়ে একই ছাদের নিচে থেকেছি। অনুশীলনে গেলে মায়ের কথা বলার মতো কেউ থাকত না। তখন তিনি বাইবেল পড়তেন পার্কে। আমরা ঘুমাতাম বিছানায়। আর মা ঘুমাতেন মেঝেতে একটি তোশকের ওপর।

মনে পড়ে ঘুমানোর আগে মাঝেমধ্যে খিদে লাগত। মাকে বলতাম, খাওয়ার মতো কিছু আছে কি না? মা বলতেন, ‘ঘুমাও এনদ্রিক, খিদেও চলে যাবে।’ কখনো কখনো খুব টানাটানির মধ্যে পড়লে মা চাল কিংবা অর্থ ধার করতেন। একবার এমন হলো, সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। মা ভেঙে পড়লেন। বাবাকে ফোন করে বললেন, ‘ডগলাস, আমি ক্ষুধার্ত...কিন্তু কী করব বুঝতে পারছি না।’ বাবা ৫০ রিয়াল পাঠালেন। কিন্তু সেটা আমরা পেয়েছি পরের দিন। কিন্তু সেদিন সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। মা হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসলেন। এরপর চেয়ার থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে সবকিছু আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগলেন। দুটো রিয়াল বের হলো। হয়তো ব্যাগের এক কোণে পড়ে ছিল। সেটা সৃষ্টিকর্তার উপহার!

আরও পড়ুন

সত্যি বলতে আমি এসব তোমাকে বলতে চাইনি। কারণ, ক্ষুধা মোটেও ভালো জিনিস নয়। প্রার্থনা করি মা যে ক্ষুধার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তুমি যেন কখনোই এসবের সম্মুখীন না হও। কিন্তু এটা (ক্ষুধা) আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। এরপর যখন মায়ের সঙ্গে দেখা করবে, তখন তাকে জড়িয়ে ধরে বড় একটা ধন্যবাদ দিয়ো। মা না থাকলে আমরা এত দূর আসতে পারতাম না।

মা কখনো কখনো ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন। বাবাকে বলতেন, তিনি বাড়ি ফিরতে চান। তখন হয়তো আমি অনুশীলন থেকে ফিরতাম। চকচকে চোখে অনুশীলনের গল্প বলতাম। মা সেসব শুনে আশা পেতেন। মা থেকে গেলেন পরিবারের জন্য। মাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। শুধু মাঝেমধ্যে বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ থাকতে দেখেছি।

বাবাও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কয়েক মাস পর বাবাও পালমেইরাসে চলে এলেন। ক্লাবের কাছে তিনি চাকরি চেয়েছিলেন। স্টেডিয়ামের ভেতরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দলে তাঁর চাকরি হলো। সেখানে তিনি তিন বছর ছিলেন। শুরুতে স্টেডিয়ামের আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ পেয়েছিলেন। পরে ড্রেসিংরুম পরিষ্কারের দায়িত্ব পান। খেলোয়াড়দের তিনি বলতেন, ‘আমার ছেলেও একদিন তোমাদের সঙ্গে খেলবে।’

ব্রাজিলের জার্সিতে আজ রাতেই মাঠে দেখা যাবে এনদ্রিককে
ইনস্টাগ্রাম

একদিন গোলকিপার জেইলসন খেয়াল করল, বাবা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছেন। স্যুপ ছাড়া কিছু খেতে পারছেন না। জেইলসন বাবাকে বললেন আমার মায়ের ফোন নম্বর দিতে। তিনি মায়ের কাছে জানতে চাইবেন, বাবা কেন শুকিয়ে যাচ্ছেন? মা তাঁকে বলেছিলেন আসল কারণ। ছোটবেলায় বারবিকিউ করতে গিয়ে বাবা হাত পুড়িয়ে নিয়েছিলেন। অবস্থা এমন হয়েছিল যে সংক্রমণে হাতটাই কেটে ফেলতে হচ্ছিল। চিকিৎসকেরা ওষুধ দিয়ে হাতটা রক্ষা করেছিলেন। আর সে সময় বাবার দাঁত পড়ে যাচ্ছিল। তাই স্যুপ ছাড়া কিছু খেতে পারছিলেন না। জেইলসন এরপর খেলোয়াড়দের মধ্যে চাঁদা তুলে বাবার দাঁত ঠিক করার ব্যবস্থা করে দেন। সৃষ্টিকর্তা কি অবিশ্বাস্য সব উপায়ে মানুষের ভালো করেন, তাই না ভাই!

বাবা বলতেন, ‘আমার স্বপ্ন হলো, একদিন আপেলে একটা কামড় দিতে চাই।’ সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, এখন তিনি যা খুশি তা-ই খেতে পারছেন।

বাবার জীবনেও ফুটবল এসেছিল। একবার বাড়ি ছেড়ে সাও পাওলোতে চলে গিয়েছিলেন ক্লাবগুলোয় ট্রায়াল দিতে। সারা শহর হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন ক্লাবে ধরনা দিয়েছেন। তখন এক শীতের রাতে এক নারী দেখতে পান, বাবা একটি গাছের নিচে ঘুমাচ্ছেন। সেই নারী বাবাকে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। এরপর বাবা টানা তিন রাত ঘুমিয়েছেন। এত বেশি ঘুমিয়েছেন যে পরের দিন ন্যাশনাল অ্যাথলেটিক ক্লাবে ট্রায়ালে উপস্থিত হতে পারেননি। ভাই, একবার ভাবতে পারো বাবা কত ক্লান্ত ছিলেন!

ফুটবল নিয়ে এনদ্রিকের অনেক স্বপ্ন। যেতে চান বহু দূর
ইনস্টাগ্রাম

বাবার স্বপ্নপূরণ হয়নি। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন।
ভাই, আশা করি তুমি ব্যাপারটা বুঝবে। এই যে এখন আমরা যে জীবন কাটাচ্ছি, সেটা এমনি এমনি আসেনি। অনেক পরিশ্রম ও চোখের জলে এটা অর্জন করতে হয়েছে। মা সব সময় বলেন, একটা ভুলেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে। মা ঠিক বলেন।

যে মুহূর্তে আমরা নিজেদের শিকড় ভুলে যাব, ঠিক তখন থেকেই হারিয়ে যাওয়ার শুরু! সে জন্যই আমাদের পরিবারের ইতিহাসটা তোমায় বললাম।

‘মা খাচ্ছে বাসি ভুট্টার রুটি,
বাবা ঘুমাচ্ছেন টিকিটবুথের নিচে
মা কাঁদছেন বাথরুমে,
বাবা কাঁদছেন সোফায়
সব সময় এসব মনে রাখবে।’

ভাই, তোমাকে ভালোবাসি একদম হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে।

—এনদ্রিক ফিলিপে মোরেইরা দে সউসা, ফরোয়ার্ড

আরও পড়ুন