৯ গোলের মহানাটকীয় ম্যাচে শেষ হাসি বার্সার, লিভারপুলের সাতে সাত

বার্সেলোনার জয়ের নায়ক রাফিনিয়াকে ঘিরে সতীর্থদের উল্লাসছবি: এক্স

ফুটবল নিয়ে রোমাঞ্চকর সিনেমা বানাতে বললে হলিউডের খ্যাতিমান কোনো পরিচালকও নিশ্চয় এমন স্কোরলাইন কল্পনা করতেন না! লিসবনের এস্তাদিও দা লুজে যা ঘটে গেল, তা যে অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য–অভাবনীয় মনে হতে পারে।

গ্রিসের স্ট্রাইকার ভাঙ্গেলিস পাভলিদিসের হ্যাটট্রিকে প্রথমার্ধেই ৩–১ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল বেনফিকা। মনে হচ্ছিল গ্রিক রূপকথায় বার্সেলেনার বিপক্ষে স্মরণীয় এক জয়ই পেতে যাচ্ছে পর্তুগিজ ক্লাবটি।

কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য গল্প লিখল বার্সা। মহানাটকীয় ম্যাচটা তারা জিতে নিল ৫–৪ ব্যবধানে। এমন স্কোরলাইন চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে প্রথম! এ জয়ে সরাসরি শেষ ষোলোতে খেলাও নিশ্চিত হলো হান্সি ফ্লিকের দলের।

আরেক ম্যাচে লিলকে ২–১ গোলে হারিয়েছে লিভারপুল। আগেই শেষ ষোলো নিশ্চিত করে ফেলা আর্নে স্লটের দল এ নিয়ে টানা সাত জয়ে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষেই রয়ে গেল। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে এখন পর্যন্ত একমাত্র অপরাজিত দলও তারা।

লিসবনে বহু বাঁক বদলের ম্যাচে বার্সেলোনার জয়ের নায়ক রাফিনিয়া। প্রবল বর্ষণের রাতে ব্রাজিলিয়ান এই উইঙ্গার জয়সূচক গোলটি করেছেন যোগ করা সময়ের ষষ্ঠ মিনিটে, রেফারি শেষ বাঁশি বাজানোর ঠিক আগমুহূর্তে।

যোগ করা সময়ে জয়সূচক গোলের পর রাফিনিয়া
ছবি: এক্স

সেই গোল নিয়েও হয়ে গেছে একপ্রস্থ নাটক। না, রাফিনিয়ায় গোল করায় কোনো ত্রুটি নেই। বরং বদলি ফেরান তোরেসের কাছ থেকে বল পেয়ে ডান প্রান্ত দিয়ে চিতার বেগে বক্সে ঢুকে, বেনফিকা ডিফেন্ডার আলভারো কারেরাসকে কাটিয়ে গোলকিপার আনাতোলি ত্রুবিনকে যেভাবে ফাঁকি দিলেন, তা ব্রাজিলিয়fনদের সোনালি সময়ের একক নৈপুণ্যের গল্পগুলোই মনে করিয়ে দেয়।

কিন্তু বিতর্ক সৃষ্টি হয় এর ঠিক আগে। বদলি লিয়ান্দ্রো বারেইরো বার্সার দুই খেলোয়াড়ের ধাক্কায় বক্সে পড়ে গেলে পেনাল্টির আবেদন জানায় বেনফিকা। কিন্তু স্বাগতিকদের আবেদনে সাড়া দেননি ডাচ রেফারি ড্যানি মাক্কেলি।

এ নিয়ে প্রতিবাদ জানালে বেনফিকার ডাগ আউটে গিয়ে আর্থার কাবরালকে লাল কার্ড দেখিয়ে আসেন রেফারি। বেনফিকার খেলোয়াড়দের সঙ্গে তর্কে জড়ানোয় হলুদ কার্ড দেখতে হয় বার্সার ফেরমিন লোপেজকেও। এ ঘটনার কয়েক সেকেন্ড পর রেফারি শেষ বাঁশি বাজালে জয়ের আনন্দে ভাসে বার্সা।

ঘটনাবহুল ম্যাচে রেফারি মাক্কেলির আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দুই দলের গোলকিপার ও ডিফেন্ডারদের ভুলগুলোও ছিল দৃষ্টিকটু। সেসব ভুলেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন পাভলিদিস। মাত্র ৩০ মিনিটেই তিন গোল করে বার্সাকে স্তব্ধ করে দেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে ম্যাচের শুরু থেকে হিসাব করলে এটি তৃতীয় দ্রুততম হ্যাটট্রিক। ২০২২ সালে সালজ্‌বুর্গের বিপক্ষে রবার্ট লেভানডফস্কির ২৩ মিনিটের মধ্যে হ্যাটট্রিকটাই দ্রুততম।

সেই লেভার সৌজন্যেই আজ ম্যাচে ফেরার ইঙ্গিত দেয় বার্সা। ১৩ মিনিটে এই পোলিশ স্ট্রাইকার পেনাল্টি থেকে করেন দলের প্রথম গোল। ৩–১ গোলে পিছিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ফ্লিকের দল।

তবে দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন রাফিনিয়া। ম্যাচের ৬৪ মিনিটে তাঁর গোলে ব্যবধান কমিয়ে ৩–২ করে ফেলে বার্সা। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরেই রোনাল্‌দ আরাউহোর আত্মঘাতী গোলে ৪–২ ব্যবধানে এগিয়ে যায় বেনফিকা। আনহেল দি মারিয়া–নিকোলাস ওতামেন্দিদের জয় তখন নিশ্চিতই মনে হচ্ছিল।

পেনাল্টি থেকে দুই গোল করেন লেভানডফস্কি
ছবি: এক্স

কিন্তু ৭৮ মিনিটে লামিনে ইয়ামালের আদায় করা পেনাল্টি থেকে আরেকটি গোল করে খেলা জমিয়ে তোলেন লেভানডফস্কি। এই গোলে ভাগ বসান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর রেকর্ডে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে এখন পেনাল্টি থেকে যৌথভাবে শীর্ষ গোলদাতা রোনালদো আর লেভা। স্পট কিক থেকে দুজনেরই গোল ১৯টি করে।

৮৬ মিনিটে পেদ্রির দুর্দান্ত ক্রস থেকে লাফিয়ে ওঠা হেডে ৪–৪ করে ফেলেন বদলি এরিক গার্সিয়া। এরপর রাফিনিয়ার সেই শেষের জাদু—বেনফিকা ৪–৫ বার্সেলোনা।

চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে এ নিয়ে মাত্র দ্বিতীয়বার কোনো দল ৪ গোল খেয়েও ম্যাচ জিতল। প্রথমবার এমনটা হয়েছিল ২০১৬ সালের নভেম্বরে, লেগিয়া ওয়ারশকে ৮–৪ গোলে হারিয়েছিল বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ এই প্রতিযোগিতায় দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও বার্সার জয়ের ঘটনা এটাই প্রথম, বেনফিকার ক্ষেত্রে হারের দ্বিতীয় ঘটনা।

এমন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা ভুলবেন কী করে এস্তাদিও লা লুজে খেলা দেখতে যাওয়া ৬০ হাজার বেনফিকা সমর্থক? ভুলতে না পারলেও তাঁদের চোখ জল নিশ্চয় লিসবনের বৃষ্টির সঙ্গে মিশে গেছে!

লিভারপুলের সাতে সাত

নিজেদের মাঠ অ্যানফিল্ডে ফরাসি ক্লাব লিলকে হারাতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে লিভারপুলকে। ১০ জনের লিলের বিপক্ষে অলরেডদের জয় ২–১ গোলে।

৩৪ মিনিটে মোহাম্মদ সালাহর গোলে এগিয়ে যায় লিভারপুল। ৫৯ মিনিটে আইসা মান্দি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় লিল। ৩ মিনিট পরেই জোনাথন ডেভিডের গোলে সমতা আনে অতিথিরা।

লিভারপুল যেন এক সুখী পরিবার
ছবি: এক্স

তবে লিলের ম্যাচে ফেরার আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ৬৭ মিনিটে বদলি হার্ভি এলিয়টের গোলে প্রত্যাশিত জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে লিভারপুল।

এ নিয়ে তৃতীয়বার ইংল্যান্ডের কোনো ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের প্রথম সাত ম্যাচেই জিতল। ২০২১–২২ মৌসুমে ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুলও প্রথম সাত ম্যাচ জিতেছিল, পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি এই কীর্তি গড়েছিল গত মৌসুমে। আর লিল ইংলিশ ক্লাবের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের সর্বশেষ সাত ম্যাচেই হারল।

আরও পড়ুন

এ জয়ে হান্সি ফ্লিকের কীর্তিতে ভাগ বসিয়েছেন লিভারপুল কোচ আর্নে স্লট। দ্বিতীয় কোচ হিসেবে কোনো ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে নিজের প্রথম সাত ম্যাচেই জিতলেন তিনি। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফ্লিক নিজের প্রথম সাত ম্যাচ জিতেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের কোচের ভূমিকায়।