পালাতে চেয়েও কি ফিরেছিলেন পেলেরা

ডেথ ম্যাচ।

সাবেক সোভিয়েত ইতিহাসবেত্তাদের দেওয়া নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কিয়েভে রুটি তৈরির কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে একাধিক ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল জার্মান নাৎসি বাহিনী। ডেথ ম্যাচ—এই ম্যাচগুলোরই আরেক নাম।

দিনামো কিয়েভ ও লোকোমোটিভ কিয়েভের সাবেক ফুটবলারদের জার্মান সৈন্যদের জন্য রুটি তৈরি করতে কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করেছিল নাৎসি বাহিনী। তাঁদের সঙ্গে ১৯৪২ সালের ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট দুটি ফুটবল ম্যাচ খেলে নাৎসিদের দল ফ্লাকেল্ফ। দুই ম্যাচেই হারের পথে মাত্র ৪ গোল দেওয়ার বিপরীতে ১০ গোল হজম করেছিল ফ্লাকেল্ফ।

যুদ্ধকালীন প্রপাগান্ডা ও সোভিয়েত মিথ অনুযায়ী, দুটি ম্যাচেই হারের পর কিয়েভ সিটি দলের কিছু কিংবা সব ফুটবলারকে গ্রেপ্তার করে মেরে ফেলা হয়। কারণ? জার্মানদের বাজে হার। ডেথ ম্যাচ নামকরণের এটাই শিকড়।

রুপালি পর্দায় এই ডেথ ম্যাচের গল্প অবলম্বনে কিংবা গল্পের রূপরেখা ঈষৎ পাল্টে দুটি বিখ্যাত সিনেমাও বানানো হয়। ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া জোলতান ফাব্রির ‘টু হাফ টাইমস ইন হেল’। হাঙ্গেরিয়ান এই সিনেমায় অবশ্য সোভিয়েত-ইউক্রেনিয়ান নয়, হাঙ্গেরিয়ান শ্রমিকদের খেলতে দেখা যায়।

পেলে ও ববি মুরের সঙ্গে কোলবি চরিত্রে কেইন (বাঁ থেকে তৃতীয়)
আইএমডিবি

২০ বছর পর হলিউডের কিংবদন্তি পরিচালক জন হিউস্টন মুক্তি দেন হাঙ্গেরিয়ান সিনেমাটির রিমেক ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’। যা শুধু ‘ভিক্টরি’ নামেও পরিচিত। আমেরিকান লেখক ও পরিচালক ইয়াবো ইয়াবলোনস্কি ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’ নামেই বই লিখেছেন। ‘ফিউনারেল ইন বার্লিন’–এর চিত্রনাট্যকার জ্যামাইকান লেখক ইভান জোনস ও ইয়াবলোনস্কি মিলে লেখেন ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’র চিত্রনাট্য। গল্পে একটু পরিবর্তনও আনেন তাঁরা। মিত্র বাহিনীর বন্দিশিবিরে বিভিন্ন দেশের বন্দীরা মিলে একটি দল বানিয়ে জার্মানির বিপক্ষে খেলেন এই ফুটবল ম্যাচ, যেটা ছিল নাৎসি বাহিনীর যুদ্ধকালীন প্রপাগান্ডার অংশ।

আরও পড়ুন

বন্দিশিবিরের প্রধান মেজর কার্ল ফন স্টেইনার বন্দীদের ফুটবল খেলতে দেখে প্রস্তাবটা দেন ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট হামের সাবেক ফুটবলার জন কোলবিকে। বন্দীদের সঙ্গে একটি ফুটবল ম্যাচ খেললে কেমন হয়! অনেক কথাবার্তা, আলাপ–আলোচনার পর রাজি হন কোলবি। বন্দিশিবিরেই নিয়মিত অনুশীলন করে গড়ে তোলেন একটি ফুটবল দল।

কিন্তু বন্দিশিবির মানেই তো যুদ্ধবন্দীদের মাথায় পালানোর চিন্তাটা থাকবে। যুদ্ধের প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে একটি ফুটবল ম্যাচ, যেটা আবার বন্দীদের জন্য আত্মসম্মান ধরে রাখার লড়াইও এবং পালানো—এ দুটি পথ ধরে এগিয়েছে সিনেমার গল্প।

বন্দী থেকে ফুটবলার হয়ে ওঠা কিংবা ফুটবলে ফেরা সেই মানুষগুলো কি শেষ পর্যন্ত পালাতে পেরেছিল?

ফুটবলে ফেরার কথা বলা হচ্ছে; কারণ, জার্মানদের হাতে ধরা পড়ার আগে অনেকেই ফুটবলার ছিলেন। বন্দিদশা থেকে আর কখনো ফুটবল মাঠে ফিরতে পারবেন কি না, সেটা তাঁরা জানতেন না। মেজর স্টেইনার ও কোলবির ম্যাচ তাঁদের সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনেই তাই এ সিনেমায় দেখা গেছে কিংবদন্তি কিছু ফুটবলারকে।

১৯৬৬ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড অধিনায়ক ববি মুর, ১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি অসভালদো আর্দিলেস, পোলিশ কিংবদন্তি কাজিমিরেজ দেইনা, বেলজিয়ান কিংবদন্তি পল ফন হিমস্ট, নরওয়ের হ্যালভার থোরেনসনরা চিত্রনাট্যে ফুটবলারদের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

কিন্তু সবচেয়ে বড় তারকা তাঁদের কেউ নন। পেলে! ব্রাজিলের হয়ে তিনবার বিশ্বকাপজয়ী পেলে আছেন ত্রিনিদাদের করপোরাল লুইজ ফার্নান্দেজ চরিত্রে। সিনেমার শেষ দিকে বাইসাইকেল কিকে গোলটি করা ছাড়া পেলের চরিত্রটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা কোলবি চরিত্রে অভিনয় করা ব্রিটিশ কিংবদন্তি অভিনেতা মাইকেল কেইন ও হ্যাচ চরিত্রে অভিনয় করা সিলভেস্টার স্ট্যালোন। আর আছেন সে সময় ইপসউইচ টাউন ক্লাবে খেলা বেশ কিছু ফুটবলার।

আরও পড়ুন

পেলেকে সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশে অবশ্য দেখা গেছে। কোলবি যখন ব্ল্যাকবোর্ডে খেলার কৌশল বোঝাচ্ছিলেন, সেসবে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে চকটা নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে ফার্নান্দেজ চরিত্রের পেলে আঁকাবাঁকা রেখাচিত্র এঁকে বুঝিয়ে দেন, কিছুই করার দরকার নেই, শুধু বলটা তাঁকে দিলেই চলবে, তিনি ওভাবে গোল করবেন।

সিনেমাটির যে নাম, তার সার্থকতা প্রমাণের মুহূর্তেও গুরুত্বপূর্ণ একটি সংলাপ রয়েছে পেলের। পালাতে চাওয়া হ্যাচকে টানেলে যখন বলছিলেন, যেয়ো না, আমরা না খেললে শুধু এই ম্যাচটাই হারব না, আরও অনেক কিছুই হারাব। পেলের সেই অনুরোধ বাকিদের মনে সঞ্চারিত হওয়ায় বিশ্বাস জন্মায়, একাধিক গোলে পিছিয়ে থাকার পরও ম্যাচটা জেতা সম্ভব। এরপর কি তাঁরা পালিয়েছিলেন, নাকি মাঠে ফিরে গিয়েছিলেন? পালানোর পথ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মাঠে ফিরে জিততে পারলে সেটাই তো এসকেপ টু ভিক্টরি! মানে পালানোর পথে নেমে জয় তুলে নেওয়া।

অনুশীলনে ফার্নান্দেজ চরিত্রে অভিনয় করা পেলের শট
আইএমডিবি

ফুটবলের জন্য যদি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়, তাহলে খেলাটিও তো কিছু না কিছু ফিরিয়ে দেয়। সেই ফিরিয়ে দেওয়ায় সবচেয়ে বড় ‍ভূমিকা দর্শকের, যেটা রয়েছে সিনেমার একদম শেষ অংশে।

আরও পড়ুন

১৯৮১ সালের ৩০ জুলাই মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা দুবার অস্কারজয়ী কেইন করতে রাজি হয়েছিলেন শুধু পেলের সঙ্গে অভিনয় করার জন্য। পেলের পরামর্শে বুদাপেস্টে দেড় মাসের মধ্যে শুট করা সিনেমাটির চিত্রনাট্যেও পরিবর্তন আনা হয়েছিল।

সিনেমার আসল চিত্রনাট্যে শেষ দিকে হ্যাচ পেনাল্টি সেভ করার পর একাই জার্মানির সবাইকে কাটিয়ে গোল করবেন, এমন দৃশ্য ছিল। কিন্তু হ্যাচ চরিত্রে অভিনয় করা স্ট্যালোন ফুটবলের ‘অ, আ, ক, খ…’–ও না পারায় চিত্রনাট্যে পরিবর্তন আনা হয়।

হ্যাচ চরিত্রে ভালো অভিনয় করেন সিলভ্যালেস্টার স্ট্যালোন
আইএমডিবি

পরে ২০১৩ সালে বিবিসিকে ‘রকি’ তারকা স্ট্যালোন আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য জানান। সিনেমায় অনুশীলনের ‍দৃশ্যে পেলের পেনাল্টি শটে স্ট্যালোন, অর্থাৎ গোলকিপার হ্যাচের আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। যদিও শুটিংয়ের সময় স্ট্যালোনকে গোলকিপিংয়ের অভিনয়ে মানানসই করতে তাঁকে সাহায্য করেছেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গোলকিপার গর্ডন ব্যাঙ্কস।

সিনেমার চিত্রনাট্য মন্থর না হলেও কিছু কিছু জায়গায় মনে হতে পারে, গল্পটা একটু থমকে গেছে। তবে মাঠে ফুটবল খেলার দৃশ্যগুলো খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হাল আমলে বল পেছনের পায়ে ফ্লিক করে ওপরে তুলে মাথার ওপর দিয়ে সামনে নিয়ে আসার কৌশলটা সিনেমার ম্যাচে দেখিয়েছেন কার্লোস রে চরিত্রে অভিনয় করা আর্দিলেস। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনেই কিংবদন্তি এসব ফুটবলারকে একটু রোগা হতে হয়েছিল। কারণ, জার্মান বন্দিশিবিরের বন্দীদের শরীর কঙ্কালসার হবে, সেটাই প্রত্যাশিত।

ভিক্টরি সিনেমার আইকনিক দৃশ্য
আইএমডিবি

সিনেমাটি মুক্তির পর প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি সমালোচিতও হয়। আমেরিকান সিনেমা সমালোচক স্ট্যানফি কাউফম্যান বলেছিলেন, ‘…এটা অপমান ও হঠকারিতার মাঝমাঝি পর্যায়ের।’ সিনেমার ইতিহাসবেত্তা লিওনার্দ মালটিন অবশ্য মনে করেন, ‘ফুটবল খেলার দৃশ্যগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরায় বিরক্তিটা কেটে যায়।’

তবে টানেলের ভেতরে ওই দৃশ্যটি এই সিনেমার সব ত্রুটিবিচ্যুতি ভুলিয়ে দিয়ে আপনাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। যখন আপনি ফুটবলার হয়ে কয়েক গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে শুধু জীবন বাঁচানোর স্বার্থে পালাতে চাইছেন, তখন সতীর্থদের কথার মাধ্যমে আসলে ফুটবলই টেনে ধরে পেছন থেকে; প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জীবনটা আসলে পালানোর নয়; বরং তার মুখোমুখি হয়ে জিতে বের হয়ে আসার।
সেটা কীভাবে, জানতে হলে সিনেমাটি দেখার আমন্ত্রণ রইল।

এসকেপ টু ভিক্টরি

পরিচালক: জন হিউস্টন

অভিনয়: মাইকেল কেইন, সিলভেস্টার স্ট্যালোন, পেলে, ববি মুর, অসভালদো আর্দিলেস, ম্যাক্স ফন সাইদো, পল হিমস্ট

মুক্তি: ৩০ জুলাই ১৯৮১

রানটাইম: ১ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট

আইএমডিবি রেটিং: ৬.৭