কানের ফিসফিসানি বদলে দিল জীবন

রুপালি পর্দার এ গল্প আপনার, আমার; আমাদের মতো খেলাপ্রেমী সবার। এ গল্প ছোটবেলায় শোনা খেলার জগতে মস্ত বড় সব তারকাকে বাড়ির পাশে নামিয়ে আনার। এ গল্প বাবা-ছেলেরও; খেলার মোহনায় মন মিলিয়ে পাঁজরায় টান লাগার। গল্পের ভেতরের গলি-ঘুপচিগুলো আপনি দেখবেন অপলক চোখে, কেমন চেনা চেনা লাগে! কখনোসখনো চোখ দুটো ভিজে এলে, পলক ফেলার মাঝে মনে হবে, গল্পটা আসলে আমার।

অথচ আপনার না–ও হতে পারে। সব খেলাপ্রেমীর গল্প কি এক হয়! কিন্তু খেলার প্রতি টানটা তৈরি হয় একই বুনটের ভালোবাসায়। কারও কারও সেই ভালোবাসার শুরু শৈশবে বাবার কাছে খেলার কিংবদন্তিদের গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে।

রে কিনসেলার বাবাও ছিলেন বেসবলের মস্ত ভক্ত। নিজে খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলেন। যেতে পেরেছিলেন মাইনর লিগ অবধি। ছেলে তো সেটুকুও মাড়াননি। ষাটের দশকে রক ও হিপ্পিদের সময়ে কোনোমতে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে কৃষক হয়েছেন। বউয়ের বুদ্ধিতে লোন নিয়ে কয়েক একর জমি কিনে ভুট্টার চাষ করেন আইওয়ায়। ফুটফুটে একটা মেয়েকে নিয়ে কিনসেলার সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন কানের পাশে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে! এভাবে পরের দিন, প্রতিদিন!

কিনসেলার ভাষায়, তাঁর আগে তিনি কোনো দিন পাগলাটে কিছু করেননি।

সেই পাগলামিটা বেসবল নিয়ে। তবে সিনেমাটা দেখতে বেসবল সম্পর্কে কিছু না জানলেও চলবে। যাঁর যে খেলা পছন্দ, বেসবলের জায়গায় মনে মনে সেই খেলাটি বসিয়েও অনায়াসে দেখতে পারেন।

রে কিনসেলার চরিত্রে অভিনয় করেন কেভিন কস্টনার। খেতের ভেতর ফিসফিস কণ্ঠটি শুনতে পায় কিনসেলা
আইএমডিবি

দেখতে দেখতে মনে হবে, আরে, শৈশবে বাবার সঙ্গে খেলে এবং তাঁর কাছে পেলে-ম্যারাডোনার গল্প শুনে এমন সব কল্পনার রথ তো আমিও ছুটিয়েছি। আমার মনের ভেতরও তো একটি মাঠ আছে! যেমনটা অন্য সব খেলার ভক্তদেরও থাকে। মনের খেয়ালেই সেখানে সময়ে-অসময়ে নেমে পড়েন আমাদের কিংবদন্তিরা। কী নাম হতে পারে সেই মাঠের? স্বপ্নের মাঠ? তেমনই এক গল্প নিয়ে সিনেমার নামও ‘ফিল্ড অব ড্রিমস।’

‘যদি তুমি এটা বানাও, সে আসবে।’

কানের কাছে সেই ফিসফিসানি কিনসেলাকে ঠিক এ কথাই বলেছিল। কী বানাতে হবে, সেটা বুঝতে কিনসেলার কেটে গেছে কয়েক দিন। বাবা তাঁকে শিকাগো হোয়াইট সক্স কিংবদন্তিদের গল্প শোনাতেন। ‘শুলেস জো’র (জোসেফ জেফারসন জ্যাকসন) ভীষণ ভক্ত ছিলেন বাবা। বেসবল অজানা থাকলে ভদ্রলোকের পরিচয়টা দিতেই হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ বেসবলের (এমএলবি) ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের (.৩৫৬) মালিক। অনেকের কাছেই বেসবলের শেষ কথা বেব রুথ তাঁর হিটিং অ্যাপ্রোচের অনুসারী ছিলেন। জুতা ছাড়াই ব্যাটিংয়ের অভ্যাস ছিল বিধায় ওই নাম। বিশ শতকের শুরুর দিকে খেলে নাম কামানো কিংবদন্তি।

আরও পড়ুন

‘ব্ল্যাক সক্স’ স্ক্যান্ডালের কলঙ্কিত নায়কও। ১৯১৯ সালে হোয়াইট সক্সের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ছেড়ে দেওয়ার কলঙ্ক নিয়ে এক বছর পর বিচারে তিনিসহ হোয়াইট সক্সের মোট আটজন পেশাদার বেসবল থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হন। ‘এইট মেন আউট’ সিনেমার গল্প এ ঘটনা নিয়ে। কিন্তু সে আরেক গল্প। ১৯৫১ সালে মারা যাওয়া শুলেস জো এই গল্পে কিনসেলার কাছে ধরা দেন অন্যভাবে।

রে কিনসেলার স্ত্রী অ্যানির চরিত্রে অভিনয় করেন অ্যামি ম্যাডিগান
আইএমডিবি

ভুট্টার খেতের পাশে দাঁড়িয়ে কিনসেলা একদিন দেখেন, চারপাশের সবুজ হঠাৎ করেই বেসবলের মাঠ হয়ে গেছে। শুলেস জো একটা ব্যাট হাতে মাঝখানে দাঁড়িয়ে! কিনসেলার বিশ্বাস হয় না। জো মারা গেছেন কত বছর আগে, তিনি ফেরেন কীভাবে! কিনসেলা হঠাৎ ফিসফিস স্বরে সেই কণ্ঠের আর্তির মানেটা ধরতে পারেন। বউকে বলতে তিনিও রাজি। পরের দিন থেকেই পাগলামির শুরু।

ট্রাক্টর দিয়ে ভুট্টার খেত উজাড়! কিনসেলা বেসবলের মাঠ বানানোর কাজে নেমে পড়েন। তাহলে ওই আটজন আসবেন, বাবা যাঁদের মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছেন। কিনসেলাও শৈশবে যাঁদের গল্প শুনে বড় হয়ে কিংবদন্তির আসন দিয়েছেন, নিষিদ্ধ হওয়ায় যাঁরা অকালেই ঝরে গেছেন। তাঁদেরও তো খেলতে মন চায়! এলাকার লোক কিনসেলাকে পাগল ঠাওরায়। ব্যাংকে লোন শোধের চোখরাঙানি। কিন্তু কিনসেলা সবকিছু উপেক্ষা করে মাঠ বানিয়ে ছাড়েন। তারপর অপেক্ষার শুরু। কবে তাঁরা আসবেন!

লোকে টিটকিরি দেয়। শ্যালক বুদ্ধি দেয়, দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচতে চাইলে জমি বেচে দাও। ওসব বেসবল-ফেসবল স্রেফ অলীক কল্পনা! কিন্তু কিনসেলা পরিবার অনড়। দিন যায়, বছর ঘুরে বড়দিনও এসে চলে যায়। শুলেস জো ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা কি খেলতে আসবেন?

আরও পড়ুন

তাঁরা কিন্তু এসেছিলেন। তবে তাঁরা আসার পরই কিনসেলা বুঝতে পারেন, মাঠটা আসলে তাঁদের জন্য বানাতে বলা হয়নি। এই মাঠের কারণ অন্য কেউ! শুলেস জো-রা স্রেফ তাঁর আসার উপলক্ষ। সিনেমার চরিত্র টেরেন্স মান নামের এক লেখক কিনসেলাকে বুদ্ধিটা বাতলে দেন, যিনি আসলে বাস্তবেরই লেখক জেডি স্যালিঞ্জার। তাঁকে অবলম্বন করেই চরিত্রটি বানানো। আইনি কারণে সিনেমায় নামটা বদলে দেওয়া হয়।

রে কিনসেলার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন ডিওয়্যার ব্রাউন। সিনেমায় তাঁর উপস্থিতি নাটকীয়
আইএমডিবি

কিনসেলাকে পরিবার নিয়ে তাঁর স্বপ্নের নায়কদের স্বপ্নের মাঠে যখন খেলতে দেখবেন, তখন আপনারও মনে হতে পারে, ইশ্‌! এই জীবনটা আমার হলো না কেন! কিন্তু এটা স্রেফ গল্পের উপরিভাগ। ভেতরে বেসবল খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকে শৈশব ফেরানোর অলৌকিকত্ব।

সেই অলৌকিকত্বের রং সবুজ। আইওয়ার মাইলের পর মাইল সবুজ ভুট্টার খেত আপনাকে নস্টালজিক করে দিতে পারে। সিনেমাটোগ্রাফি ও আবহসংগীত ধরিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে এক ঘোর লাগা পথে, যে পথের শেষ ঠিকানাটা শৈশব। কানাডিয়ান লেখক ডব্লিউ পি কিনসেলার বই ‘শুলেস জো’ অবলম্বনে পরিচালক ফিল এইডেন রবিনসন সিনেমাটি বানানোর সময় আইওয়ার ডার্সভিলে ভুট্টার খেতে শুধু ২৫ হাজার ডলারের পানিই সরবরাহ করেছিলেন। খরায় খেতের রং হলুদ হয়ে আসছিল তাই! সিনেমার সেই স্বপ্নের মাঠ এখন পর্যটনকেন্দ্র।

আরও পড়ুন

কাকতালটা হলো, সিনেমায় গল্পের প্রয়োজনে লেখক টেরেন্স মান কিনসেলাকে বলেছিলেন, লোন নিয়ে চিন্তা কী, প্রচুর মানুষ আসবে তোমার এই ‘বল পার্ক’ দেখতে! বাস্তবে হলো ঠিক সেটাই। রে কিনসেলার স্বপ্নের সেই মাঠ এখনো প্রচুর মানুষ দেখতে যায়। কনসার্ট আয়োজন করা হয়। জায়গাটির মালিকানা হাতবদলের পর নতুন মালিকও এখন বেসবলের হল অব ফেমার ফ্রাঙ্ক টমাস। এমএলবি সেখানে নিয়মিত ম্যাচও আয়োজন করে।

কিনসেলার বাড়ির পাশে বেসবল খেলার মাঠ। এই মাঠ ঘিরেই সিনেমার গল্প
আইএমডিবি

তিনটি ক্যাটাগরিতে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল স্পোর্টস ফ্যান্টাসির ‘কাল্ট ক্লাসিক’ হয়ে ওঠা ‘ফিল্ড অব ড্রিমস’। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি ও লাইব্রেরি অব কংগ্রেস। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এই সিনেমা দেখে বাবার সঙ্গে বেসবল খেলার মুহূর্তগুলো মনে করে কেঁদেছেন। কিন্তু সেটা কি আসলে দুঃখের কান্না? এমন কান্না তো আমরা সবাই কাঁদতে চাই!

রে কিনসেলার চরিত্রে কেভিন কস্টনারের অভিনয় আপনার চোখে লেগে থাকবে। খেলাধুলার সিনেমায় কস্টনার এমনিতেই দুর্দান্ত। ‘টিন কাপ’, ‘ফর দ্য লাভ অব দ্য গেম’, ‘ম্যাকফার‌ল্যান্ড ইউএসএ’ সিনেমাতেও তা বোঝা গেছে।

২০০৮ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আয়োজন করা ভোটে ফ্যান্টাসি ক্যাটাগরিতে শীর্ষ ছয়ে উঠে এসেছিল ‘ফিল্ড অব ড্রিমস’। শুলেস জো চরিত্রে প্রয়াত রে লিওতা, টেরেন্স মান চরিত্রে প্রয়াত জেমস আর্ল জোনস এবং ‘মুন লাইট গ্রাহাম’ চরিত্রে অভিনয় করেন প্রয়াত বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার। অস্কারজয়ী ল্যাঙ্কাস্টারের এটাই শেষ সিনেমা। ম্যাট ডেমন ও বেন অ্যাফ্লেক অভিনয় করেছেন এক্সট্রার ভূমিকায়! তবে ফিসফিসানি সেই কণ্ঠস্বর কার, তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি।

সিনেমাটির পরিচালক ফিল অলডেন রবিনসন (বাঁয়ে)
আইএমডিবি

সেটাই ভালো। সবার মনেই অমন একটি ফিসফিসানি কণ্ঠের বসবাস। খেলা নিয়ে কত রকম কান পড়া দেয়, শুধু বয়স ও সময়ের কারণে সেসব ইচ্ছাপূরণে হার মানতে হয় প্রায় সবাইকেই। এভাবে হারতে হারতে যদি ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের জন্য জিততে চান, তাহলে নেমে পড়তে পারেন এই স্বপ্নের মাঠে!

ফিল্ড অব ড্রিমস (১৯৮৯)

পরিচালক: ফিল এইডেন রবিনসন

অভিনয়: কেভিন কস্টনার, জেমস আর্ল জোনস, রে লিওতা, অ্যামি ম্যাডিগান

রানটাইম: ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট

আইএমডিবি রেটিং: ৭.৫/১০