সুয়ারেজের ব্রাজিল অভিযান: ‘যেন মানুষের সঙ্গে ভিনগ্রহের কেউ খেলছে’

গ্রেমিওতে শেষ ম্যাচটা খেলার পর দর্শক অভিবাদনের জবাবে লুইস সুয়ারেজছবি: এএফপি

এমনকি বৃষ্টিও তাঁর অশ্রু লুকাতে পারেনি।

ম্যাচ ততক্ষণে শেষ। কিন্তু লুইস সুয়ারেজ সচল। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে মাঠের চারপাশ প্রদক্ষিণ করলেন, হাত নাড়লেন দর্শকদের প্রতি, ফোঁপালেন। পেছনে তাঁর সতীর্থরা চোখে ভক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী ও সন্তান দৌড়ে মাঠে ঢুকে জড়িয়ে ধরলেন সুয়ারেজকে। আর গ্যালারিতে প্রায় ৫০ হাজার দর্শক চিৎকার করছিলেন তাঁর নামে।

আরও পড়ুন

মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে একটি ভিডিও দেখানো হলো। ১১ মাস আগে ব্রাজিলের ক্লাব গ্রেমিওতে যোগ দিয়েছিলেন সুয়ারেজ। এ সময়ে তাঁর আলোকিত মুহূর্তগুলোর সংকলন করে ভিডিওটি বানানো হয়। পাস, গোল উদ্‌যাপন—যেসব মিলিয়ে এই অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রেমিও ‘আইকন’ হয়ে উঠেছেন সুয়ারেজ। গত রোববার ক্লাবটির হয়ে নিজের শেষ ম্যাচেও গোল করে জিতিয়ে বিদায় বলছিলেন অ্যারেনা গ্রেমিওর দর্শকদের, ‘এই মুহূর্ত আমি ভুলব না।’ উরুগুয়ে তারকার চোখেমুখে আবেগের প্রলেপটা তখন স্পষ্ট, ‘এ আমার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি।’

গ্রেমিওর হয়ে শেষ ম্যাচেও গোল করেছেন সুয়ারেজ
ছবি: এএফপি

সুয়ারেজের নিখাদ আবেগের ঢেউ গ্রেমিওর সঙ্গে জড়িত সবার হৃদয়ই ভিজিয়ে দেবে। ক্লাবটি ব্রাজিলের শীর্ষ লিগে ফিরেছে এক বছর আগে। এখন দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষ ক্লাব প্রতিযোগিতা কোপা লিবার্তোদোরেসের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুবাস পাচ্ছে। সে জন্য সুয়ারেজকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। গ্রেমিওতে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এ বছর ২৭ গোল করার পাশাপাশি ১৭টি গোলও বানিয়েছেন। কিন্তু গ্রেমিওতে সুয়ারেজ যে ছাপ রেখে গেলেন, পরিসংখ্যানে তার গভীরতা ঠাহর করা যায় না। পোর্তো অ্যালেগ্রের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘জিরো হোরা’র সংবাদকর্মী—গ্রেমিওর প্রতিবেদক—লিওনার্দো অলিভেইরার মুখেই শুনুন, ‘কিছু ম্যাচে মনে হতো সে ভিনগ্রহের খেলোয়াড়। যেন মানুষের সঙ্গে ভিনগ্রহের কেউ খেলছে।’

আরও পড়ুন

সুয়ারেজকে সই করিয়ে গ্রেমিও একটি বার্তা দিতে চেয়েছিল। ব্রাজিলের অন্যতম ঐতিহাসিক এই ক্লাবের আগের দুই বছর বাজে কেটেছে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল। সুয়ারেজের মতো তারকা এলে দর্শক বাড়বে, এমনটা অনুমিতই ছিল। সেটাই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যেদিন তাঁকে বরণ করে নিতে গ্রেমিওর স্টেডিয়ামে এসেছিলেন প্রায় ৩০ হাজার সমর্থক। তবে সুয়ারেজকে নিয়ে কিন্তু তখনই সবাই উচ্ছ্বাসে ভেসে যাননি। তখন ৩৬–এ তাঁর পা পড়েছে, খেলে এসেছেন নিজ দেশ উরুগুয়ের ঘরোয়া ফুটবল; অনেকের তখন মনে হয়েছিল, গ্রেমিও বুঝি মাঠের পারফরম্যান্সকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ডের ইমেজ বাড়াতেই বেশি মনোযোগী! ব্রাজিলের খ্যাতিমান কলামিস্ট পাওলো ভিনিসিয়ুস কোয়েলো তখন লিখেছিলেন, ‘বিপণনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাজটা দুর্দান্ত কিন্তু খেলাধুলার জায়গা থেকে প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত।’

কিন্তু অনেকের মনে জেঁকে বসা সেই ভয়টা সুয়ারেজ তা মাঠ পর্যন্ত টেনে আনেননি। অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন এবং পারফরম্যান্সে স্কোয়াডের বাকিরা তাঁর চেয়ে প্রমাণ ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন। গ্রেমিও জিতে নেয় রিও গ্রান্দে দো সুল রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপ। ক্যাম্পেনেতো ব্রাসিলিরোয় (ব্রাজিলের প্রধান প্রতিযোগিতা) শুরুর গল্পটাও একই রকম। রেড বুল ব্রাজান্তিনো ও ক্রুজেইরোর বিপক্ষে মনে রাখার মতো ফিনিশ, ইন্টারন্যাসিওনালের বিপক্ষে ডার্বিতে একক প্রচেষ্টায়ও গোল করেছিলেন। আরও আছে। গত নভেম্বরে বোটাফোগোর বিপক্ষে ১৯ মিনিটের মধ্যে সেই হ্যাটট্রিক, যার মহিমায় হারের মুখ থেকে ৪–৩ গোলের অবিশ্বাস্য জয় পেয়েছিল গ্রেমিও।

ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবো এসপোর্তে’র প্রতিবেদক ডগলাস সেকোনেল্লো লিখেছিলেন, ‘চিরকালীন পারফরম্যান্স, যা লিগের ইতিহাসে জায়গা পাওয়ার দাবিদার। গ্রেমিওর সমর্থকেরা তাঁদের নাতি–নাতনিদের গল্প বলবেন, সুয়ারেজকে তাঁরা তেরঙ্গা জার্সিতে খেলতে দেখেছেন।’

গ্রেমিওর কোচ রেনাতো পোর্তালুপ্পিও কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ঝরিয়ে বলেছিলেন, ‘সে আলাদা। তাকে খেলতে দেখাটা আনন্দের ব্যাপার।’

আরও পড়ুন

সুয়ারেজকে নিয়ে এমন মূল্যায়নের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তর্ক করা কঠিন। লিভারপুল ও বার্সেলোনায় যেমন গতি ও বিস্ফোরক পারফরম্যান্স ছিল, সে তুলনায় গ্রেমিওতে আসতে আসতে তাঁর গতি কমেছে। বক্সেও আগের মতো অতটা বিধ্বংসী নন। কিন্তু এরপরও তাঁর খেলায় প্রশংসা করার মতো অনেক কিছুই বাকি ছিল। গোলের গন্ধ পাওয়ার অভ্যাসটা হারাননি। সে জন্য সব সময় যে চাতুর্যপূর্ণ বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতার প্রয়োজন হয়, সেসব তো হারাননি! ফিনিশ করার ক্ষমতাও যথেষ্ট। পাশাপাশি লড়াইয়ের স্পিরিট তো আছেই। এসব মিলিয়েই সুয়ারেজ এখনো কঠিন প্রতিপক্ষ। আর যদি ক্লাবের জন্য নিজের সবটুকু নিংড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে, সেখানেও তাঁকে লেটার মার্কস দিতে হবে।

দক্ষিণ আমেরিকার অনেক তারকা ফুটবলারই ইউরোপে খেলার পর নিজ মহাদেশে ফিরে ক্লাবের ব্যাপারে অতটা গা করেন না। সুয়ারেজ কতটা ব্যতিক্রম, শুনুন অলিভিয়েরার মুখে, ‘কৌশলগতভাবে সে অনেক এগিয়ে থাকলেও দলের জন্য কখনো দৌড়ানো থামায়নি। দলের জন্য সে নিজের শেষ ঘামটুকুও নিংড়ে দিয়েছে।’
ব্রাজিলিয়ান সিরি আ–তে ৭ ডিসেম্বর ফ্লুমিন্সের বিপক্ষে নিজেদের শেষ ম্যাচ খেলবে গ্রেমিও। সুয়ারেজ ম্যাচটি খেললে সেটি হবে এ বছর ক্লাবটির হয়ে তাঁর ৫৪তম ম্যাচ। এক মৌসুমে এর আগে সুয়ারেজ কখনো এত ম্যাচ খেলেননি। বছরের বেশির ভাগ সময় হাঁটুর চোটে ভুগেছেন, অনুশীলনও সেভাবে করতে পারেননি—এসব শোনার পর ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আরও অসাধারণ মনে হয়!

স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গ্রেমিও ভক্তদের সামনে সুয়ারেজ
ছবি: এএফপি

গত জুনে শোনা গিয়েছিল, হাঁটুর চোটে অবসর নিয়ে নিতে পারেন সুয়ারেজ। কুরিতিবার বিপক্ষে এক ম্যাচে ব্যথা সইতে না পেরে কোচের কাছে বদলির আবেদন করেছিলেন। গ্রেমিও সভাপতি আলবার্তো গুয়েরা তখন বলেছিলেন, ‘ব্যাপারটা মারাত্মক। সে নিজের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে।’

সুয়ারেজ অবসর নিতে চেয়েছেন, এ ব্যাপারটি গ্রেমিওর তরফ থেকে অস্বীকার করা হয়। তখন সুয়ারেজের অবসরসংক্রান্ত খবর অতটা গুঞ্জন তোলেনি। কারণ, তত দিনে তাঁকে ঘিরে আরেকটি গুঞ্জন চাউর হয়ে গিয়েছিল। সুয়ারেজ আগেভাগে গ্রেমিও ছেড়ে ফ্রি এজেন্ট হিসেবে ইন্টার মিলানে যোগ দিতে চান!

আরও পড়ুন

গ্রেমিও কয়েক সপ্তাহ এ নিয়ে চুপচাপ ছিল। এরপর দুই পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছায়—সুয়ারেজ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবেন এবং গ্রেমিও তাঁর সঙ্গে চুক্তির দ্বিতীয় বছর কার্যকর করবে না। সুয়ারেজ তখন বলেছিলেন, ‘গ্রেমিও আমার কাছে যেমনটা প্রত্যাশা করে, আগামী বছর তা পূরণ করতে পারব না। কারণ, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রচুর ম্যাচ। ক্লাবের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে সম্মত হয়েছি। তারা ব্যাপারটা বুঝেছে এবং সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’ গ্রেমিওর সমর্থকেরাও সুয়ারেজের থেকে যাওয়ার আশায় ছিলেন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই তাঁর জন্য গলা ফাটিয়েছেন সমর্থকেরা। শুধু সমর্থক কেন, তাঁর সতীর্থরাও আশায় ছিলেন সুয়ারেজ থাকবেন।

এই আশার পেছনে সদিচ্ছাটাও বোধগম্য। এ বছর গ্রেমিও যত গোল করেছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ গোলে প্রত্যক্ষ (গোল করা) বা পরোক্ষ (গোল করানো) অবদান সুয়ারেজের। মাঠের বাইরেও টিকিট এবং জার্সি বিক্রি থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করেছে গ্রেমিও। ক্লাবের সদস্যসংখ্যা ৬০ হাজার থেকে এ বছরের শুরুতে বেড়ে ১ লাখ ছাপিয়ে গেছে।

লুইস সুয়ারেজকে আইকন হিসেবেই মনে রাখবেন গ্রেমিওর ভক্তরা
ছবি: এএফপি

অলিভিয়েরার ব্যাখ্যা, ‘ভাবিনি যে সে এভাবে ফ্যানবেজ বানিয়ে ফেলবে।’ এই সংবাদকর্মীর মতে, মাঠের বাইরে সুয়ারেজের স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে মেশাই এই ফ্যানবেজের চাবিকাঠি, ‘কিছু খেলোয়াড় তেমন বের হন না। কিন্তু সুয়ারেজ স্কুল থেকে বাচ্চাদের নিয়েছে, স্ত্রীকে নিয়ে সিটি সেন্টারে গিয়েছে, চপ্পল পরেই গিয়েছে সুপারমার্কেটে। সে তারকা, কিন্তু এর বাতাবরণের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেনি।’ গত সপ্তাহে স্থানীয় বিধানসভা সম্মানসূচক পদক দিয়েছে সুয়ারেজকে। শহরের উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য। আর সুয়ারেজ? গত রোববার গ্রেমিওর সমর্থকদের সামনে দাঁড়িয়ে শহরবাসীর সেই ভালোবাসারই যেন প্রতিদান দিলেন, ‘মনে হচ্ছে নিজের ঘর। আমি যেখানেই যাই সব সময় গ্রেমিও–ভক্তই থাকব।’

সুয়ারেজ এরপরের অভিযানে সম্ভবত ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেবেন। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষায় নতুন রোমাঞ্চ। যোগ দেবেন বার্সেলোনা সতীর্থ ও বন্ধু লিওনেল মেসির সঙ্গে। তার আগে গ্রেমিওতে সুয়ারেজ যে ছাপ রেখে যাচ্ছেন, সেটার বিবরণ দিলেন অলিভিয়েরা, ‘৪০ বছর ধরে গ্রেমিওকে অনুসরণ করছি। তারা অসাধারণ কিছু খেলোয়াড় পেয়েছে। সুয়ারেজ বেশি দিন হয়নি ক্লাবে এসেছে। কিন্তু আমি তাকে তালিকার অনেক উঁচুতেই রাখব—রেনাতো (পোর্তালুপ্পি) ও রোনালদিনিওর পাশে। বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এখানে এসেছিল—সমর্থকেরা এটা কখনো ভুলবে না।’