আর্সেনালকে ‘বার্নিশ’ করতে চেয়ে ‘লা রেমোনটা–টা’ পেল রিয়াল

সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে হারের পর বিমর্ষ রিয়াল তারকা জুড বেলিংহামরয়টার্স

সব খেলাতেই এমন হয়। বিভিন্ন দলের ভয়ের একটি জায়গা থাকে। ক্রিকেটে ভারতের ক্ষেত্রে যেমন ট্রাভিস হেড, জিম্বাবুয়ের বাবর আজম, নিউজিল্যান্ডের আইসিসির নিয়ম, দক্ষিণ আফ্রিকার নকআউট ম্যাচ এবং বাংলাদেশের জন্য সম্ভবত ক্রিকেট খেলাটাই। ফুটবলেও এমন আছে। এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিকতা বিচারে আপাতত একটি উদাহরণই দেওয়া উচিত। রিয়াল মাদ্রিদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। এ মাঠে নামার আগেই ঘুম হারাম হয় প্রতিপক্ষ দলের।

আরও পড়ুন

আর আগেই ভয় দেখানো শুরু করলে তো কথাই নেই। দুই এলাকার ছেলেপুলের মধ্যে ঝামেলা লাগলে যেটা হয়—প্রতিপক্ষের এলাকায় গিয়ে মার খেয়ে আসার পর নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙানি দেওয়া, অনেকটাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খেলাধুলা নিয়ে পরিচিতি পাওয়া কমিক বই ‘নন্টে-ফন্টে’র সেই সংলাপের মতো, ‘পাড়ায় আসিস, বার্নিশ করে ছেড়ে দেব!’

রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থাও হয়েছিল ঠিক তাই। গত সপ্তাহে আর্সেনালের মাঠ এমিরেটস স্টেডিয়ামে কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত হয় গতবারের চ্যাম্পিয়নরা। সেই হারের পর থেকেই শুরু হয়েছিল আর্সেনালকে চোখ রাঙানি।

ঘরের মাঠেও হার। মোটেও ঘুরে দাঁড়ানোর মতো খেলা খেলতে পারেনি রিয়াল
রয়টার্স

ফিরতি লেগে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়—সেই অঙ্ক কষার চেয়ে সম্ভবত মুখের তোড়ে গানারদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার কৌশলটাই বেশি পছন্দ ছিল রিয়ালের খেলোয়াড়দের। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র তাতে এক কাঠি সরেস। দূরে থেকে হুমকি দেওয়ার নিরাপদ জায়গা হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জুড়ি মেলা ভার। ভিনি সে মাধ্যমের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডলে ম্যাচের তিন দিন আগেই লেখেন, ‘এখনই বুধবার (ম্যাচের দিন) নিয়ে ভাবছি...বার্নাব্যুতে আমরা তোমাদের অপেক্ষায় থাকব।’

আরও পড়ুন

কিলিয়ান এমবাপ্পে কোনো রাখঢাকে যাননি। ইতিহাস ছুড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে সোজাসাপ্টা বলেছেন, ‘অবশ্যই আমরা পারব।’ থিবো কোর্তোয়াও পাত্তা দেননি, ‘কেউই বলতে পারবে না আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য নেই।’ সে তো আছেই। অতীতে বহুবার এভাবে দাঁড়িয়েছে রিয়াল। আরেকবার তেমন কিছু করার নেশায় সম্ভবত তাঁরা আসল কাজটা করতেই ভুলে গিয়েছিল। অলংকার হিসেবে যা যা গড়া দরকার সবই করেছে তারা।

মুখের কথার তোড়ে থরহরি কম্পমান দশা করে ছেড়েছে আর্সেনাল সমর্থকদের। প্রেরণামূলক ভিডিও বানানো হয়েছে, ফিরতি লেগ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে বার্নাব্যুর ছাদ বন্ধ করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। ১৮ বছরের নিচে এবং ৪০ বছরের ওপরে কাউকে স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হবে না, সেটাও বলা হয়েছে। যেন অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নরম মনের মানুষদের জন্য এ ম্যাচ দেখতে মানা! ভাবখানা এমন ছিল যে রিয়াল এই ম্যাচে ফুটবল খেলবে না, কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে!

বার্নাব্যুতে এমন বিশাল তিফো প্রদর্শন করে আর্সেনালকে ঘাবড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন রিয়াল সমর্থকেরা
রয়টার্স

ওহ, আসল কাজটা কী সেটাই বলা হয়নি। ফুটবল খেলা। শুধু এই কাজটাই ঠিকমতো করতে ভুলে গিয়েছিল রিয়াল। তা ছাড়া বাকি সব ঠিকই ছিল।

বার্নাব্যুর গ্যালারি টইটম্বুর। স্বল্প পরিসরে দু-একটি জায়গায় লাল জটলা ছাড়া পুরো গ্যালারি দেখে অনেকের হয়তো নব্বই দশকের হোয়াইট প্লাস টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল মনে পড়েছে, ‘সাদা, সাদা আরও সাদা...।’ সেই সাদা গ্যালারির দু চোখ ভর্তি স্বপ্নও ছিল—‘লা রেমোন্তাদা’ ফিরিয়ে আনার অভিলাষ। কিন্তু শেষ বাঁশি বাজার পর সেই স্বপ্নই হলো লাশ! অন্য ভাষায়, রিয়ালের লা রেমোন্তাদা বা ‘কামব্যাক’ হয়ে যায় ‘লা রেমোনটা-টা’!

বুঝলেন না? স্প্যানিশ ভাষায় এই শব্দ নেই। এটা বানানো শব্দ। যেহেতু ‘রেমোন্তাদা’ হয়নি, কিন্তু যেটা ঘটেছে সেটারও তো একটা নাম লাগবে। তাই ওই শব্দের আদলে শেষে ‘টা-টা’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। টা-টা মানে তো বিদায় জানানো। আর্সেনাল ফিরতি লেগে সেটাই করল। বার্নাব্যুতেও ২-১ গোলের জয়। দুই লেগ মিলিয়ে জয়ের ব্যবধানটা ৫-১। অর্থাৎ ‘লা রেমোন্তাদা’ ফেরাতে গিয়ে ‘রেমোনটা-টা’ পেয়েছে রিয়াল!

আরও পড়ুন

আসল কাজের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। অতীতের উজ্জ্বল ইতিহাসের একটা ওজন আছে। খেলোয়াড়েরা সেই ওজন বইতে না পারলে মাঠের দৌড়টা আর থাকে না। এই দুই লেগের কথাই ধরুন। দুই লেগ মিলিয়ে আর্সেনালের তুলনায় ২১.২ কিলোমিটার কম দৌড়েছেন রিয়ালের খেলোয়াড়েরা। ফিরতি লেগে সেটা ৯.৫ কিলোমিটার। এই পরিসংখ্যান দেখে তাই প্রচলিত সে কথাটি বলাই যায়, গায়ে আগুন লাগলে সবাই দৌড়াতে বাধ্য। এমিরেটসে তিন গোলের ‘আগুন’ এর ছ্যাঁকায় গা পোড়ার পর বার্নাব্যুতে রিয়ালের খেলোয়াড়দের পড়িমরি করে দৌড়ানোর কথা ছিল, কারণ প্রতিপক্ষ একে তো ইংলিশ ক্লাব, যারা সাধারণত দৌড়ে খেলায় বিশ্বাসী। এই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দুই লেগ মিলিয়ে রিয়াল আসলে একজন খেলোয়াড় কম নিয়ে খেলেছে। না, লাল কার্ড দেখেননি কেউ।

হিসেবটি ফুটবলের, যেখানে একটি কথা প্রচলিত, প্রতিপক্ষের চেয়ে ১৪ কিলোমিটার কম দৌড়ানো মানে আপনি একজন খেলোয়াড় কম নিয়ে খেলেছেন। এখন রিয়ালের তো খেলোয়াড় কম ছিল না। তাহলে চেষ্টায় ঘাটতি ছিল? এই পরিসংখ্যানের দাবি তো সেটাই। আর এ দাবির বশেই বলা যায়, মাঠে নয় ‘মুখে মারিতং’ খেলেছে রিয়াল। নইলে তিন গোলে পিছিয়ে থাকা একটি দল, তাও বিশ্বের অন্যতম সেরা আক্রমণভাগ যাদের, তাঁরা কীভাবে ম্যাচের ৫৬ মিনিট পর্যন্ত প্রতিপক্ষের পোস্ট তাক করে একটি শটও নিতে পারে না! কীভাবে গোটা ম্যাচে কীভাবে প্রতিপক্ষের পোস্টে মাত্র তিনটি শট নিতে পারে, যেখানে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের নাম কিলিয়ান এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রদ্রিগো!

দুই লেগ মিলিয়ে শ্রেয়তর ফুটবল খেলেই জয় তুলে নিয়েছে আর্সেনাল
এএফপি

আপনি বলবেন, খেলা তো তৈরি হয় মাঝমাঠ থেকে, রিয়াল সেটা পারল কোথায়? আর্সেনালের ‘এক্স ফ্যাক্টর’ ঠিক এখানেই। ডেকলান রাইস, মার্টিন ওডেগার্ড ও টমাস পার্টিকে নিয়ে মাঝমাঠ যেভাবে সামলেছেন জুড বেলিংহাম, ফেদে ভালভের্দে, চুয়ামেনিরা তা পারেননি। এমনকি কাউন্টার অ্যাটাক এ সিদ্ধহস্ত আনচেলত্তির দল এ ম্যাচে সেটাও পারেনি কিংবা তা করার গরজ দেখায়নি।

গরজের প্রশ্ন উঠছে কারণ, আর্সেনালের কর্নার কিংবা নিজেদের বক্সে বল পেয়ে রিয়াল বেশ কয়েকবার প্রতি আক্রমণে ওঠার সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু মাঝমাঠ পর্যন্ত গিয়েই দৌড়ের তোড় থামিয়েছে। দার্শনিকদের মতো ভাবুক হয়ে উঠেছে আর্সেনালের বক্সে (প্রথমার্ধের শেষ পাঁচ মিনিট বাদে)। সেটা দোষের কিছু না। কিন্তু ওভাবে খেলে গোল আদায় করতে হলে মিডফিল্ডে টনি ক্রুসের মতো একজন পাসার ও বেনজেমার মতো একটু নিচে নেমে খেলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স চেরার মতো খেলোয়াড় থাকতে হয়।

আরও পড়ুন

বেলিংহাম ভালো বল-প্লেয়ার কিন্তু আর্সেনালের মিডফিল্ডের সঙ্গে পেরে উঠতে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে খেলতে পারেননি। তাঁকে বল ধরে রাখতে হয়েছে। এমবাপ্পে গোল করায় খুব ভালো, তবে বিশেষ মুহূর্তে একদম জায়গামতো থাকায় জাত নয় নম্বর স্ট্রাইকারেরা যেমন, তেমন কতটা? রদ্রিগোকে শুধু কাট-ইন করে ঢুকতে দেখা ছাড়া আর কিছু করার দেখা গেল না। হয়তো রুচি ছিল না। এত কথা বললে রুচি কী আর থাকে!

ভাবতে পারেন, রিয়াল চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করা দল। অথচ এই টুর্নামেন্টেই তাঁরা আর্সেনালের বিপক্ষে চার ম্যাচ মিলিয়ে গোল করতে পারল মাত্র একটি! সেটাও গানার গোলকিপার দাভিদ রায়ার ভুল পাস থেকে পাওয়া ‘উপহার’। যে বার্নাব্যুতে অতীতে অনেকবার ‘রেমোন্তাদা’র নজির গড়েছে রিয়াল, সেখানে আরেকবার তেমন কিছু করার ঢাকঢোল পিটিয়ে রিয়াল যেমন খেলেছে, তার মোক্ষম শিরোনাম হতে পারে—পর্বতের মূষিক প্রসব। দুঃখিত, সেই ‘মূষিক’ও আর্সেনালের দেওয়া উপহার, অর্জন কিংবা আদায় করে নেওয়া হয়। তাহলে বুকায়ো সাকা গোল করে ঠোঁটে আঙুল রেখে বার্নাব্যুর সাদা গ্যালারিকে মুখ বন্ধ রাখতে বলবেন না কেন?

সাকা বুঝি থিয়েরি অঁরিকে দেখে শিখেছেন? ২০০৫-০৬ চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলো প্রথম লেগে রিয়ালের মাঠে চোখ ধাঁধানো এক গোল করে ফরাসি কিংবদন্তি ঠোঁটে আঙুল রেখে বার্নাব্যুর রিয়াল সমর্থকদের চুপ থাকার ইঙ্গিত করেছিলেন। সাকাও ঠিক সেটাই করে রিয়ালকে যেন বোঝাতে চাইলেন, ফুটবল খেলাটা মুখে হয় না মাঠে হয়। আর এই ম্যাচের আগে রিয়াল শিবির থেকে উড়ে আসা নানা পদের সব চোখ রাঙানিমূলক বার্তা শুনে আর্সেনাল কোচ মিকেল আরতেতাও বলেছিলেন, মুখে নয় তাঁরা মাঠে খেলা দিয়ে কথা বলতে চান।

আর্সেনাল ‘কথা’ বলেছে, রক্ষণ থেকে মাঝমাঠ এবং আক্রমণভাগের সবাই ‘কথা’ বলেই রিয়ালকে টা-টা জানিয়েছেন। লা রেমোনটা-টা!