নাটকীয় ফাইনালে মোহামেডানকে হারিয়ে কিংসের ‘ট্রেবল’ জয়

ট্রফি নিয়ে বসুন্ধরা কিংসের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। আজ ময়মনসিংহেবাফুফে

ফাইনালের মতো একটা ফাইনালই হলো ময়মনসিংহে। ফুটবলপ্রেমী দর্শকদের পয়সা উশুলই বলা যায়। বসুন্ধরা কিংস ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব উপহার দিল দারুণ এক ম্যাচ। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ তো ছিলই, কমতি ছিল না রোমাঞ্চেরও। শক্তিতে এগিয়ে থাকা কিংসকে ছেড়ে কথা বলেনি মোহামেডান। ম্যাচের ৬৩ মিনিটে এগিয়েও গিয়েছিল।

কিন্তু ৮৬ মিনিটে কিংস গোল করে সমতা ফেরানোর পর অতিরিক্ত সময়ের গোল মোহামেডানকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফেডারেশন কাপ জিতল বসুন্ধরা কিংস। স্বাধীনতা কাপ, প্রিমিয়ার লিগের পর ফেড কাপের এই ট্রফি দিয়ে হয়ে গেল এই মৌসুমে কিংসের ‘ট্রেবল’ জয়ও।

এই ম্যাচে আসলে জয় হয়েছে ফুটবলেরই। জ্যৈষ্ঠের তীব্র উত্তাপের মধ্যে দুই দলই প্রত্যাশা ছাড়ানো ফুটবল খেলেছে। গ্যালারিতে বসে দর্শকেরা বারবার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। একবার মোহামেডানের আক্রমণ, তো পর মুহূর্তেই কিংস আক্রমণে। একবার মোহামেডান সুযোগ তৈরি করছে তো এর পরপরই কিংস।

মোহামেডানের সমর্থকদের আক্ষেপ হতেই পারে। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হওয়ার ৪ মিনিট আগেও যে দলটি ১-০ গোলে এগিয়ে, তারাই কি না শেষ অবধি পরাজিত। ভাগ্য সাহসী ও পরিশ্রমীদের পক্ষে থাকে। আজ সেটিই হয়েছে। ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পরও হতোদ্যম হয়নি। একের পর এক আক্রমণে উঠে খেলায় প্রথমে সমতা ফিরিয়েছে। এরপর অতিরিক্ত সময়ে বের করে নিয়েছে জয়সূচক গোলটি।

প্রথমার্ধে বসুন্ধরা কিংসের চেয়েও সুযোগ বেশি পেয়েছে মোহামেডান। ইমানুয়েল সানডে থেকে মোজাফফরভের পা ঘুরে বল পেয়ে দিয়াবাতে যে মিসটি করেছেন, সেটি নিয়ে আক্ষেপ হতেই পারে। সেটি প্রথমার্ধের ৪০ মিনিটে। কিংসের গোলকিপার মেহেদী হাসান ফিস্ট করে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন।

আরও পড়ুন

এর পরপরই রাইট উইঙ্গার আরিফ হোসেন দারুণভাবে দিয়াবাতেকে আবারও একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্লেসিং লক্ষ্য খুঁজে পায়নি। কিংসও সুযোগ পেয়েছিল। দরিয়েলতন একটি মিস করেন। তবে সবচেয়ে সহজ সুযোগটি বোধ হয় কাজে লাগাতে পারেননি সোহেল রানা জুনিয়র। মোহামেডানের বক্সের মধ্যে বল পেয়েও তাতে পা ছোঁয়াতে পারেননি তিনি।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই মোহামেডানের আধিপত্য। একের পর এক আক্রমণে কিছুটা দিশাহারাই হয়ে পড়ে কিংস। মোজাফফরভ তো ছিলেনই, ছিলেন ইমানুয়েল সানডে। তবে দ্বিতীয়ার্ধে শাহরিয়ার ইমন আশরাফুল হক আসিফের জায়গায় মাঠে নেমে মোহামেডানের খেলাই পাল্টে দেন। ম্যাচের ৬০ মিনিট থেকে ৬৫ মিনিট পর্যন্ত কিংসকে একেবারে নাজেহালই করে ফেলে সাদা–কালোরা। গোলকিপার মেহেদী হাসান পরপর তিনটি নিশ্চিত প্রচেষ্টা ঠেকান।

আরও পড়ুন

কিংসের সেই নাজেহাল অবস্থারই সুযোগটা নেয় মোহামেডান। নির্দিষ্ট করে বললে ইমানুয়েল সানডে। শাহরিয়ার ইমন কিংসের বক্সের বাইরে দারুণ একটি জায়গায় বল দেন সানডেকে। সানডে প্রায় ২০ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের দারুণ এক শটে গোলকিপার মেহেদীকে পরাস্ত করেন। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে দরিয়েলতনের একটি প্রচেষ্টা মোহামেডানের পোস্টের ওপর দিয়ে চলে যায়। তিনি ডান পায়ে ভলি মেরেছিলেন। কিন্তু সেটি পোস্টে রাখতে পারেননি।

ফেডারেশন কাপ ফাইনাল দেখতে ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে ফুটবলপ্রেমীদের ভিড়
প্রথম আলো

মোরছালিন-রবসনের দারুণ এক যুগলবন্দীতে ম্যাচের ৭৭ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে বল পেয়ে মোহামেডানের বক্সে ঢুকে দরিয়েলতন শট নিয়েছিলেন। কিন্তু মোহামেডানের গোলকিপার সুজন হোসেন সেটি কর্নারের বিনিময়ে ঠেকিয়ে দেন। ৭৯ মিনিটে দারুণ একটি প্রতি–আক্রমণ থেকে প্রায় ফাঁকায় বল পেয়ে ডান প্রান্ত দিয়ে ঢুকে গিয়েছিলেন মোহামেডানের মিনহাজুর। ক্রসও করেছিলেন। কিন্তু জায়গামতো দিয়াবাতে ছিলেন না। তবে এই প্রচেষ্টায় কর্নারটা ঠিকই আদায় করে নেয় মোহামেডান।

এরপর কিংসের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রবসন দারুণভাবে বল নিয়ে ঢুকে আড়াআড়ি ক্রস করেছিলেন। কিন্তু বক্সের মধ্যে কেউ ছিলেন না। ৮১ মিনিটে রবসনের শট ক্রসবারে লেগে ফেরত আসে। ফিরতি বলে দিয়াবাতে একাই ঢুকে গিয়েছিলেন কিংসের বক্সে। কিন্তু গোলকিপার মেহেদী হাসান আবার ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠেন। ৮৪ মিনিটে রবসনের আরও একটি প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে দেন মোহামেডানের গোলকিপার সুজন।

৮৬ মিনিটে কিংসের আরেক ব্রাজিলিয়ান মিগুয়েল দামাসেনোকে অবশ্য ঠেকাতে পারেনি মোহামেডানের রক্ষণভাগ। প্রায় মধ্যমাঠ থেকে নিজেই একটা বল নিয়ে প্রায় একক প্রচেষ্টায় ঢুকে কিংসকে সমতায় ফেরান তিনি। ৯০তম মিনিটে সানডের শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করেন মেহেদী।

নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে ম্যাচে ১–১ সমতা ছিল
বাফুফে

অতিরিক্ত সময়ের ষষ্ঠ মিনিটে মোহামেডানের বক্সের একটু বাইরে থেকে কিংসের ফ্রি কিক। বিপজ্জনক জায়গা থেকে নেওয়া রবসনের ফ্রি কিক টি পোস্টের ওপর দিয়ে চলে যায়। রবসনের আরও একটা প্রচেষ্টাও প্রথমার্ধের ১০৫ মিনিটে মোহামেডানের পোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়।

অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে জয়সূচক গোলটি পেয়ে যায় বসুন্ধরা কিংস। ডান প্রান্ত থেকে কিংসের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড মিগুয়েল দামাসেনোর কর্নার উড়ে এল মোহামেডানের বক্সে। গোলকিপার সুজন হোসেন গ্রিপ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেটি পারেননি। ভারসাম্য হারিয়ে কিছুটা হতভম্বই হয়ে পড়েছিলেন। এই ফাঁকে কাজের কাজটি করে দেন বসুন্ধরা কিংসের বদলি ফুটবলার জাহিদ হোসেন। জটলার মধ্য থেকে তিনি বল ঠেলে দেন জালে।

আরও পড়ুন

কিংসের উন্মাতাল উদ্‌যাপনের মধ্যেই মোহামেডান দলের প্রতিবাদ। তাদের দাবি, বল যখন বাতাসে, তখন গোলকিপার সুজনকে ধাক্কা দিয়েছিলেন কিংসের কোনো ফুটবলার। তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল মাঠে। মোহামেডানের ডাগআউট থেকে মাঠে ঢুকে পড়লেন কোচিং স্টাফ ও অতিরিক্ত খেলোয়াড়েরা। রেফারি, লাইন্সম্যানও নাজেহাল হলেন। তবে কোচ আলফাজ দলকে তুলে নিলেন মাঠ থেকে। খেলা বন্ধ থাকল ১০ মিনিটের মতো। তবে অঘটন যেটি হলো, তা হচ্ছে উত্তর দিকের গ্যালারি থেকে চেয়ারের ভাঙা টুকরা ছোড়া হলো মাঠের দিকে।

এগিয়ে গিয়েও বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে পেরে ওঠেনি মোহামেডান
বাফুফে

তবে মোহামেডান শেষ পর্যন্ত মাঠে ফিরেছে। তবে বাকি সময়েও সুযোগ এসেছিল তাদের সামনে। একাধিক। অতিরিক্ত সময়ের একেবারে শেষ দিকে কিংসের বক্সের মধ্যে ঢুকে শাহরিয়ার ইমনের একটি শট বার ঘেঁষে বাইরে চলে যায়। এরপর মোজাফফরভের দূরপাল্লার প্রচেষ্টা যখন অল্পের জন্য পোস্টের ওপর দিয়ে চলে গেল, তখন মোটামুটি নিশ্চিতই হয়ে যায় ভাগ্য মোহামেডানের সঙ্গে নেই।

কিংস জিতুক আর মোহামেডান হারুক। ময়মনসিংহে শেষ পর্যন্ত জয়ী ফুটবলই। দেশের ফুটবলের আরও একটি ফাইনাল প্রমাণ করেছে, ফুটবলের রোমাঞ্চটা এ দেশের মানুষ প্রাণভরেই উপভোগ করেন।