একটি ফুটবল ম্যাচের চেয়ে বেশি কিছু

মরক্কো আজ খেলতে নামবে তাদের ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্সের বিপক্ষেছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশ সময় আজ রাত একটায় কাতারের আল বায়ত স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে ফ্রান্স ও মরক্কো। বেলজিয়াম, স্পেন ও পর্তুগালের মতো ফুটবল পরাশক্তিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে ‘অ্যাটলাস সিংহরা’। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে এই প্রথম আফ্রিকার কোনো দল সেমিফাইনালে উঠল। মরক্কোর এই সাফল্যে পুরো আফ্রিকা এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা উত্তর আফ্রিকার অভিবাসীদের মধ্যে অন্য রকম আবেগ কাজ করছে।

আরও পড়ুন

ফুটবল বিশ্লেষকদের অনেকেই মরক্কোর উদ্দেশে বলছেন, ‘অনেক হয়েছে ভাই, এবার বাড়ি ফেরার এন্তেজাম করো।’ অর্থাৎ এরা ধরেই নিয়েছেন এমবাপ্পে-জিরু আর গ্রিজমান, এই ফরাসিত্রয়ীর সামনে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগই পাবেন না ওয়ালিদ রেগরাগুইয়ের শিষ্যরা, যিনি ‘মরক্কোর গার্দিওলা’ নামে এরই মধ্যেই পরিচিতি পেয়েছেন।

এই দিনটা তাদের। এই দিনটা মরক্কোর। ২-০ গোলে বেলজিয়ামকে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দিয়েছে মরক্কো।
ছবি: এএফপি

ইতিমধ্যে আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠেছে, শক্তিশালী ক্রোয়েশিয়াকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে। মেসির দলকে হারাতে হলে ফাইনালে ফ্রান্সকে দরকার, এমন সমীকরণ থেকেও অনেকে দিদিয়ের দেশমের দলকে এগিয়ে রাখছেন। আর শক্তির বিচারে তো ফ্রান্স এগিয়ে রয়েছেই। তাঁদের মতে, আর্জেন্টিনার সামনে মরক্কো হবে একেবারেই ‘দুধভাত’।

তবে ফ্রান্স-মরক্কো ম্যাচের ফল কী হবে, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু এরই মধ্যে এই দুই দলের খেলা নিয়ে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত হাজির করা হচ্ছে। সামনে আসছে ঔপনিবেশিক ইতিহাসও। সেসব জায়গা থেকে বলা হচ্ছে, ফ্রান্স-মরক্কো সেমিফাইনাল খেলা কেবল একটি ম্যাচই নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু।

ফরাসি সাহিত্য-সংস্কৃতি, খাদ্য-পানীয়, পোশাক—সবখানেই মরক্কোর প্রবল উপস্থিতি
ছবি: রয়টার্স

এবার দেখা যাক, কেন এমন কথা বলা হচ্ছে।

একসময় মরক্কোর কিছু অংশ শাসন করত স্পেন। সেই ঔপনিবেশিক শক্তিকে শেষ ষোলোর ম্যাচে মরক্কো টাইব্রেকারে হারিয়ে দেয় গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনুর অসামান্য নৈপুণ্যে। এরপর আরেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স, যারা মরক্কো শাসন করেছে ১৯১২-৫৪ সাল অবধি। আজ তাদের সঙ্গে হিসাব চুকানোর পালা।

ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কারণেই ফ্রান্স যেন এক টুকরা মরক্কোই। ফরাসি সাহিত্য-সংস্কৃতি, খাদ্য-পানীয়, পোশাক—সবখানেই মরক্কোর প্রবল উপস্থিতি। হবেই না বা কেন। উত্তর আফ্রিকান দেশটির ৩৮ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৮০ মানুষের মধ্যে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ মানুষই তো ফ্রান্সকে তাদের ঘরবাড়ি বানিয়েছে। ফ্রান্সে যত অ-ইউরোপীয় অভিবাসী বসবাস করে, এর মধ্যে আলজেরীয়দের পরে সবচেয়ে বেশি মরোক্কানরাই, সংখ্যার হিসাবে যা ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। তারা মূলত ফ্রান্সের খনি ও কারখানায় কাজ করে। সে দেশের অর্থনীতিতে এদের বড় অবদান রয়েছে।

আরও পড়ুন

বর্তমান টিমের তিনজন, কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই, অধিনায়ক রোমান সাইস এবং সোফিয়ান বুফাল, যাদের জন্ম ফ্রান্সে।

ওয়ালিদ গতকাল বলেছেন, ‘আমি দ্বৈত নাগরিক। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খেলা একই সঙ্গে সম্মান ও আনন্দের। কিন্তু এটি কেবলই ফুটবল। আমরা যখন মরক্কোর জন্য খেলি, তখন আমরা মরোক্কান।’

ফ্রান্স দলটিকে মোটামুটি চেনা আছে মরক্কোর। কোচ ওয়ালিদ নিজেই খেলেছেন ফ্রান্সের সর্বকালের সেরা গোলদাতা অলিভিয়ের জিরুর সঙ্গে, ২০০৮ সালে। জিরু এবারও আছেন, খেলছেন দারুণ। ওয়ালিদের অন্যতম অস্ত্র আশরাফ হাকিমি, জন্ম যাঁর স্পেনের মাদ্রিদে আর খেলেন নামী ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে। সেখানে তাঁর টিমমেট রয়েছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। হাকিমি ও এমবাপ্পে দুজনই ভালো বন্ধু। এক টুইট বার্তায় হাকিমি তাঁর বন্ধুকে ম্যাচের আগে অগ্রিম শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন। কেবল ওয়ালিদ আর হাকিমি নয়, মরক্কোর জাতীয় দলে মোট ৫ জন আছেন, যাঁরা ফরাসি লিগে খেলেন। আর মোট ২৬ ফুটবলারের মধ্যে ১৪ জনের জন্মই মরক্কোর বাইরে। এঁরাই দলের শক্তির অন্যতম উৎস।

ফ্রান্সকে কি হারাতে পারবে মরক্কো
ছবি: এএফপি

ইতিমধ্যে ফরাসি ডানপন্থীরা অভিবাসীদের প্রতি এক ধরনের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তাঁরা বলছেন, বুধবারের ম্যাচ অভিবাসী ফরাসিদের জন্য দেশপ্রেমের এক কঠিন পরীক্ষা হবে। এই কোরাসে যোগ দিয়েছেন কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিবিদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এরিক জেমারও। তাঁর কথা, যেদিন ফ্রান্স জেতে, সে উৎসব না করে অভিবাসীরা কীভাবে মরক্কোর জন্য উৎসব করতে পারে। তাদের যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়া উচিত। তাঁর মতে, ওই উদ্‌যাপন দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে না।

তাঁর এ কথাটা এসেছে ১০ ডিসেম্বর কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের প্রেক্ষাপটে। ওই দিন পর্তুগালকে হারানোর পর অভিবাসী মরোক্কানরা ফ্রান্সে রাতভর পার্টি করেন। উৎসবে যোগ দেয় আলজেরীয়, ফিলিস্তিনিরাও। তারা মরক্কোর পতাকা ওড়ায়। এই উদ্‌যাপনকে ঘিরে পুলিশের সঙ্গেও তাদের সংঘাত বাধে। পুলিশের খাঁচায় বন্দী হয় প্রায় দুই শ জন। ওই রাতেই ফ্রান্স হারায় ইংল্যান্ডকে। কিন্তু অভিবাসী মরোক্কানরা ফ্রান্সের পক্ষে তেমন উদ্‌যাপন করেননি। এ বিষয়টি সামনে এনে এখন মাঠ গরম করতে চাইছে ডানপন্থীরা।

আরও পড়ুন

ফ্রান্সের প্রবাসী মরোক্কানরা বলছেন, তাঁরা সারা দিন খেটে ফরাসি অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে অবদান রাখেন। উদ্‌যাপনের সুযোগ তেমন পান না। সেদিন পেয়েছিলেন। তাই আনন্দ করেছেন।

এমনিতে ফ্রান্সের সঙ্গে মরক্কোর সম্পর্ক অতটা ভালো যাচ্ছে না। সম্প্রতি ফ্রান্স সরকার মরক্কোর নাগরিকদের জন্য ভিসা কমিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে একটা উত্তেজনা আছেই। আবার ফরাসি সংস্কৃতিতে মরক্কোর নানা উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটায় সে দেশে এক ধরনের উষ্মা রয়েছে। সব মিলে পরিস্থিতি বিশেষ ভালো না।

আজ রাতে যে দলই জিতুক, নতুন করে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় বসতে হবে ফ্রান্সের প্রবাসী মরোক্কানদের। ফ্রান্সের জনপ্রিয় স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান জামাল দেবুজেকে এই ম্যাচ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু ৪৭ বছর বয়সী এই কমেডিয়ান কৌতুক করতে পারেননি। বলেছেন, ‘ম্যাচটি আমি দেখতে চাই। কিন্তু এ নিয়ে আমি ভীতিকর অবস্থায় আছি।’

শেষ পর্যন্ত ভীতি পরাজিত হোক। বিজয়ী হোক সাম্যের খেলা ফুটবল।