পেলের রেকর্ড ছুঁয়েছেন এনদ্রিক, পেলেকে কি ছাড়িয়ে যেতে পারবেন

গোল করে জার্সি খুলছেন এনদ্রিকএএফপি

২০২২ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার পর তলানিতে নেমে গিয়েছিল ব্রাজিলের ফুটবল। একদিকে চলছিল কোচ নিয়ে টানাপোড়েন আর অন্য দিকে মাঠের পারফরম্যান্সে দেখা যাচ্ছিল ভয়াবহ অবনমন। নিজেদের ফুটবল ঐতিহ্যও যেন হারিয়ে বসেছিল তারা। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, ব্যর্থতায় হাবুডুবু খেতে থাকা দলটি অন্ধকার এই টানেল থেকে বোধহয় আর বেরোতেই পারবে না।

কিন্তু দলটির নাম ব্রাজিল আর ফুটবল তাদের আত্মপরিচয়ের অংশও বটে। খুব বেশি দিন পড়ে পড়ে মার খাওয়ার অভ্যাসও যে তাদের নেই। ফলে ঝিনুকের মতো ভেতরে বিষের বালি নিয়ে মুক্তো ফলানোর স্বপ্নটা ঠিকই দেখে যাচ্ছিল ব্রাজিলিয়ানরা। দরিভাল জুনিয়রের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর সেই স্বপ্নটাই যেন এখন ডানা মেলছে। আর যাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দরিভাল, তাঁদের অন্যতম এনদ্রিক। কিছু দিন আগেও যাঁকে বলা হচ্ছিল ‘বিস্ময়বালক’, তিনিই যেন এখন ব্রাজিলের ফুটবলের বর্তমান, যাঁর পায়ে ঝিমিয়ে পড়া ব্রাজিলের ফুটবল আবার তারুণ্যের উদ্দীপনায় জেগে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

দরিভালের অধীন এখন পর্যন্ত মাত্র তিন ম্যাচ খেলেছে ব্রাজিল। তিনটি ম্যাচেই এনদ্রিক খেলেছেন বদলি হিসেবে। সব মিলিয়ে মাত্র ৯৩ মিনিটে মাঠে ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা এ তরুণ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মাত্র একটি ম্যাচের সময় মাঠে থাকার সুযোগ পেয়েছেন ১৭ বছর বয়সী এই ফুটবলার। আর এ সময়ের মধ্যেই তিনি করেছেন তিন গোল, যার সর্বশেষটি করেছেন আজ মেক্সিকোর বিপক্ষে। এর আগে ইংল্যান্ড ও স্পেনের বিপক্ষে গোল করেই ফুটবল সম্রাট পেলের একটি রেকর্ড স্পর্শ করেছিলেন এনদ্রিক। পেলের পর এনদ্রিকই ছিলেন একমাত্র ফুটবলার, যিনি ১৮ বছর হওয়ার আগেই পরপর দুটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করেন।

তিন বিশ্বকাপজয়ী পেলে এই কীর্তি গড়েছিলেন ১৯৫৭ সালে। সে সময় আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে গোল করেছিলেন তিনবার বিশ্বকাপজয়ী এ মহাতারকা। পেলে অবশ্য এই মাইলফলক গড়েছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ১৭ বছর বয়সে টানা তিন ম্যাচে ওয়েলস (কোয়ার্টার ফাইনাল), ফ্রান্স (সেমিফাইনাল) এবং সুইডেনের (ফাইনাল) বিপক্ষে গোল করেছিলেন পেলে। সেই তিন ম্যাচে ফুটবল–রাজা গোল করেছিলেন ৬টি।

এনদ্রিকের গোল উদ্‌যাপন
এএফপি

১৯৫৯ সালের মার্চে পেলে যখন কোপা আমেরিকায় গোল করেন, তখন তাঁর বয়স হয়ে যায় ১৮। ফলে বয়স ১৮ হওয়ার আগে টানা তিন ম্যাচে গোল করায় পেলেকে ছুঁতে হলে, আজ এনদ্রিককে গোল করতেই হতো। জুলাইয়ের ২১ তারিখেই যে ১৭ পেরিয়ে ১৮তে পৌঁছে যাবেন এ তরুণ ফুটবলার। আর শেষ মুহূর্তে গোল করে পেলের সেই কীর্তিকে ঠিকই ছুঁয়ে ফেলেছেন এনদ্রিক। এখন তাঁর সামনে সুযোগ আছে টানা চার ম্যাচে গোল করে আরও ওপরে ওঠার, পেলেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। আগামী ১৩ জুন ব্রাজিল পরের ম্যাচ খেলবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে।

ব্রাজিল দলে স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলছেন এনদ্রিক, গোল করাটাই তো তাঁর কাজ। কিন্তু ম্যাচের যে পরিস্থিতি ও সময়ে তিনি দলকে গোল এনে দিচ্ছেন, সেটিই এনদ্রিককে করে তুলেছে অনন্য। আজ মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচের কথাই ধরা যাক। ম্যাচে দুই গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সমতায় ছিল ব্রাজিল। মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত ড্র নিয়েই হয়তো মাঠ ছাড়তে হবে। কিন্তু এনদ্রিক হাল ছাড়েননি, ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের অসাধারণ এক ক্রসকে হেডে জালে জড়িয়ে ঠিকই দলকে এনে দিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত জয়।

আরও পড়ুন

এর আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে মাত্র ১৯ মিনিটের জন্য মাঠে নেমে পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলেন এনদ্রিক। সেদিন ৮০ মিনিটে ব্রাজিলের জয়সূচক গোলটি এসেছিল এনদ্রিকের কাছ থেকে। এরপর স্পেনের বিপক্ষে শুরুতেই ২–০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল ব্রাজিল। বিরতির পর এনদ্রিক মাঠে নামতেই বদলে যায় ম্যাচের চিত্র। ৫০ মিনিটে তাঁর গোলেই সমতায় ফেরে ‘সেলেসাও’রা। ইংরেজিতে  ‘মেন্টালিটি মনস্টার’ বলে একটি কথা আছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে হাল না ছাড়ার মানসকিতাকে বোঝাতে এই কথাটি ব্যবহার করা হয়। এনদ্রিক যেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে সেই মানসিকতাকেই নতুন করে ফিরিয়ে এনেছেন। জাগিয়ে দিচ্ছেন ঝিমিয়ে পড়া এক ফুটবল–শক্তিকে।

অথচ ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির এই এনদ্রিককেই নাকি উচ্চতার জন্য অনেকে স্ট্রাইকার হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। টানা তিন ম্যাচে গোল করে ইতিহাস গড়ার পর এনদ্রিক বলেছেন, ‘লোকে বলে, আমি নম্বর নাইন (স্ট্রাইকার) হওয়ার জন্য নাকি খুব খাটো। কিন্তু খাটো হওয়া কোনো ব্যাপার নয়। এটা হচ্ছে পজিশনিংয়ের ব্যাপার। আর সৃষ্টিকর্তা আমাকে সেই জায়গাটিতে রেখেছেন। আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে চাই; কারণ, তিনিই সম্মান ও অর্জনের মালিক।’

হেডে দারুণ এক গোল করেছেন এনদ্রিক
এএফপি

এই ম্যাচে ম্যাচসেরার পুরস্কারও উঠেছে এনদ্রিকের হাতে। কিন্তু বয়সের তুলনায় খেলার মতো মানসিকতাতেও যেন অনেক বেশি পরিপক্ব তাগুয়াতিঙ্গাতে জন্ম নেওয়া এ স্ট্রাইকার। ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে নিয়ে এনদ্রিক বলেছেন, ‘এই দলে শুধু আমিই খেলি না। এই ট্রফিও শুধু আমার একার নয়। আমি একাই এটি জিতিনি। আমি দলকে ধন্যবাদ দিতে চাই। দরিভাল অসাধারণ কাজ করছেন। আমরা ভালোভাবে অনুশীলন করেছি। আমরা আরও পরিশ্রম করব। কারণ, আমাদের লক্ষ্য কোপা আমেরিকা। দেখা যাক কী হয়। আমি আশা করি, আমরা ব্রাজিলিয়ানদের সমর্থন নিয়ে কোপা আমেরিকা জিততে পারব।’

আরও পড়ুন

ম্যাচের পর ম্যাচে গোল করে আরও একটি দিক থেকে ব্রাজিল সমর্থকদের স্বস্তি দিচ্ছেন এনদ্রিক। দীর্ঘ সময় পর একজন প্রকৃত গোল স্কোরারের সন্ধানও যেন পেল ব্রাজিল। তবে এনদ্রিকের পথচলাটা তো কেবলই শুরু হলো। শুরুতে যে স্ফুলিঙ্গের ছটা তিনি দেখিয়েছেন, সেটাকে আরও উজ্জ্বল আলোয় রূপ দিতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।