৭ ম্যাচে মাত্র ২ জয়: রিয়াল মাদ্রিদের সমস্যা কোথায়, আলোনসোর কী করতে হবে
খুব বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই।
গত এক-দুই দশকে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি পরা খেলোয়াড়দের নামগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে আসুন। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, সের্হিও রামোস, লুকা মদরিচ, করিম বেনজেমা, মার্সেলো, টনি ক্রুস—আরও কত কত বিখ্যাত নাম! তাঁরা শুধু রিয়াল মাদ্রিদেরই নন, ফুটবল ইতিহাসেরও সেরাদের মধ্যে থাকবেন। একেকজন কিংবদন্তি।
সেটা কীভাবে হয়েছেন? শুধুই একের পর এক ম্যাচ জিতিয়ে? নাহ্, এঁরা রিয়াল মাদ্রিদের ডিএনএ ধারণ করতে পেরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়ার ডিএনএ। ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে হার না মানার ডিএনএ। প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্দান্ত নেতা।
উদাহরণ চান? আচ্ছা, খুব বেশি আগের স্মৃতি ঘাঁটতে হবে না। ২০২৩ অ্যানফিন্ডের ম্যাচটাই মনে করে দেখুন। রিয়াল ২-০ গোলে পিছিয়ে, তখনো কী শান্ত বেনজেমা। সতীর্থদের জড়ো করে কী যেন বললেন। ঠিক কী বলেছিলেন, সেটা কেউ জানে না। কিন্তু এরপর মাঠে রিয়ালের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষাই বদলে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা তারা জিতেছিল ৫-২ গোলে!
এই রিয়াল মাদ্রিদ দলে এমন নেতা কে? গত পরশু রাতে রিয়াল মাদ্রিদ যখন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেল্তা ভিগোর কাছে ১-০ গোলে পিছিয়ে, তখন নিশ্চয়ই এমন প্রশ্ন জেগেছে দলটির সমর্থকদের মনে। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত তাঁরা উত্তর খুঁজে পেয়েছেন বলে মনে হয় না। পেলে রিয়াল মাদ্রিদের ২-০ গোলের হার দেখে মাঠ ছাড়তে হতো না। যে হারে ১৬টি করে ম্যাচ শেষে এখন বার্সেলোনার (৪০) চেয়ে ৪ পয়েন্টে পিছিয়ে পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ (৩৬)।
আচ্ছা, যদি বলা হয়, এই রিয়াল মাদ্রিদ দলে ও রকম কোনো নেতা নেই, তাহলে কি সেটা ভুল হবে? সম্ভবত না। প্রতিভার অভাব নেই রিয়াল মাদ্রিদে, কখনোই ছিল না। প্রতিটি পজিশনে দুর্দান্ত খেলোয়াড়। সমস্যা অন্য জায়গায়—তাদের একটা দল হিসেবে খেলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কখনো নিজেদের ওপর বিশ্বাস জাগানোও!
চোটের সমস্যা তো আছেই এবং সেটা ইদানীং যেন রিয়ালের জন্য চিরস্থায়ী সমস্যা হয়ে উঠছে। অর্ধেক ডিফেন্স চোটে পড়ে বাইরে। তার ওপর সেল্তার বিপক্ষে দুই অকারণ লাল কার্ডে ফুল–ব্যাক পজিশন আরও দুর্বল হয়ে গেল। কিন্তু এগুলো রিয়ালের মূল সমস্যা নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা মানসিকতায়।
এই দলে নেতা নেই। কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে তাই দলটা সামলাতে পারে না। ম্যাচে পিছিয়ে পড়লে কেউ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন না। ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই খেলোয়াড়দের চোখেমুখে হাল ছেড়ে দেওয়ার ছাপ। অগোছালো, হতাশ, দিশাহীন। গত মৌসুমে আনচেলত্তির অধীনেও প্রায় একই রকম অবস্থা ছিল।
জাবি আলোনসো এসেছেন তারপর। শুরুতে বেশ কিছু পরিবর্তনের আভাসও দেখা গেছে। কিন্তু তারপর মনে হচ্ছে, তিনিও খেই হারিয়েছেন।
আলোনসোর অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। একাদশ নির্বাচন, অদ্ভুত বদলি, অতিভাবনা। একই সঙ্গে এটাও সত্যি, খেলোয়াড়েরা নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারছেন না।
রিয়াল মাদ্রিদ কোচিং করানোর জন্য খুব কঠিন জায়গা। এভাবে বেশি দিন চলতে দেওয়ার অভ্যাস রিয়ালের হর্তাকর্তাদের নেই।
আচ্ছা, আলোনসোকে যদি সরিয়ে দেওয়া হয়, কাকে আনা হবে তাঁর জায়গায়? জিনেদিন জিদান? ইয়ুর্গেন ক্লপ?
দুজনই কঠোর পরিশ্রম চান খেলোয়াড়দের কাছ থেকে। ড্রেসিংরুমে ঐক্য চান। কোচের পরিকল্পনার ওপর আস্থা চান। তো কয়েক ম্যাচ পরই যদি খেলোয়াড়েরা সেই পরিকল্পনা না মানেন, তখন কি আবার বদল আসবে ডাগআউটে?
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন—তাঁরা আদৌ এই অবস্থায় রিয়ালের দায়িত্ব নিতে চাইবেন? জিদান কি বিশ্বকাপের পরই ফ্রান্সের কোচ হওয়ার সম্ভাব্য সুযোগ ছেড়ে বার্নাব্যুতে ফিরবেন? কিংবা ক্লপকে কীভাবে রাজি করানো হবে? তাঁর দর্শন তো সবারই জানা। আলোনসোর হাই-প্রেসিং কাজ না করলে ক্লপের হাই-প্রেসিং হঠাৎ ম্যাজিক দেখাবে কীভাবে?
এখন রিয়াল এমন এক দল, যে দলের একজন ফরোয়ার্ড (পড়ুন রদ্রিগো) ৩১ ম্যাচ ধরে গোল পাচ্ছেন না, কিন্তু খেলে যাচ্ছেন। মাঝমাঠ প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ক্রস বা সেট পিস হলে ডিফেন্ডারদের নিয়ে ভয়ে থাকতে হয়, এই বুঝি গোল হয়ে গেল! মানে ঝামেলা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত।
আলোনসোকে সরিয়ে দিলেই এই সব সমস্যার সমাধান হবে না। বরং ঘুরেফিরে একই জায়গায় ফিরে আসার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। আসলে এই দলের দরকার নেতৃত্ব আর মানসিক দৃঢ়তা। নেতৃত্বের ব্যাপারটার সঙ্গে অবশ্য আলোনসো জড়িত। তাঁকে ঠিক করতে হবে—রিয়াল মাদ্রিদে তিনি জিতবেন, নাকি সবাইকে খুশি রাখবেন। দুটো একসঙ্গে সম্ভব নয়।
আলোনসোকে আনা হয়েছিল পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু ক্লাব বিশ্বকাপে তিনি যেভাবে শুরু করেছিলেন, মৌসুমের শুরুতে যেভাবে খেলিয়েছিলেন, সেখান থেকে পরে সরে এসেছেন। সম্ভবত তারকা খেলোয়াড়দের বেশি সময় দিতে গিয়ে। কিন্তু রিয়ালের দর্শন এটা নয়। কোনো খেলোয়াড়ই ক্লাবের চেয়ে বড় নন। কার্যকর মনে না হলে দিনের পর দিন বেলিংহাম–ভিনিসিয়ুস–এমবাপ্পে ত্রয়ীকে খেলিয়ে যাওয়ার কী যুক্তি! সর্বশেষ সাত ম্যাচে রিয়াল জিতেছে মাত্র দুটি। লা লিগায় সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচে মাত্র এক জয়! রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এ তো ভয়ংকর পরিসংখ্যান!
আগের ৩০ ম্যাচে গোল পাননি, তারপরও সেল্তার বিপক্ষে গতকাল রদ্রিগোকেই বদলি নামানো হলো। কেন? এনদ্রিকের ওপর আলোনসোর একেবারেই আস্থা নেই। জানুয়ারিতে তাঁর লিঁওতে চলে যাওয়ার গুঞ্জন আছে। সে কারণে কি আগে থেকেই দলে ব্রাত্য হয়ে গেলেন? নাকি বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে এনদ্রিকই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন!
অথচ ডান দিকে তাঁকে খেলালে একটা বাড়তি গতি পেত রিয়াল, অপ্রত্যাশিতভাবে প্রতিপক্ষকে চমকে দিতে পারেন তিনি। এই মৌসুমে একটা ম্যাচেই এনদ্রিক খেলেছেন। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে ডান উইংয়ে কিন্তু ১১ মিনিটের ক্যামিও দিয়েই চোখ কেড়েছিলেন।
সেল্তার বিপক্ষে রাউল অ্যাসেনসিওকে রাইট ব্যাক হিসেবে খেলানো হয়। কিন্তু তিনি আসলে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার। ফলে বেশ বিপদে পড়েছেন, আক্রমণে একটুও সাহায্য করতে পারেননি দলকে। কিন্তু সামনে যদি এনদ্রিক থাকতেন, হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতেন অ্যাসেনসিও।
এমন না যে মাঠে নামালেই এনদ্রিক গোল করে দলকে জিতিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁকে নামানো মানে নতুন কিছু চেষ্টা করা। এখন তো আলোনসো একই স্ক্রিপ্টে আটকে আছেন। একই কৌশল, প্রায় একই একাদশ। এনদ্রিকই হয়তো সমাধান নয়, কিন্তু চেষ্টা না করলে জানা যাবে কীভাবে?
শুধু বড় তারকা বলেই এত দীর্ঘ গোলখরার (রিয়ালের সর্বশেষ ২০ বছরে কোনো ফরোয়ার্ডের জন্য সবচেয়ে দীর্ঘ) পরেও রদ্রিগোকে খেলিয়ে যাওয়া, বায়ার লেভারকুসেনে থাকতে কি এমনটা কখনো করতেন আলোনসো?
এমবাপ্পে-গনসালো-এনদ্রিককে নিয়ে আক্রমণভাগ কেমন খেলে, এটা জানতেই পারলেন না রিয়াল সমর্থকেরা। বেশি ঝুঁকি নিতে না চাইলে অন্তত ছোট ম্যাচগুলোতে তাঁদের একসঙ্গে খেলিয়ে দেখা যেত। কাগজে-কলমে তো এটাকে ভারসাম্যপূর্ণ আক্রমণভাগই মনে হয়। এমবাপ্পে ও এনদ্রিকের দারুণ গতি ও গোল করার সম্ভাবনার সঙ্গে গনসালোর লিংক-আপ ও হেডে দক্ষতা। আলোনসো চেষ্টাই করলেন না এখন পর্যন্ত!
মোটকথা, রিয়াল কোচকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাইকে খুশি রেখে যে সব সময় জেতা যায় না, এটা তিনি যত দ্রুত বুঝতে পারবেন, তাঁর জন্য তত সহজ হবে সমস্যা সমাধান করা। নইলে রিয়াল এই ‘মাঝে মাঝে জেতা’র অভ্যাসেই আটকে পড়ে যাবে।
আর সেল্তার মতো হয়তো অন্য কোনো দলে এসে বার্নাব্যুতে ১৯ বছর পর ম্যাচ জিতে চলে যাবে।