লিভারপুলের দুর্দশার চার কারণ
মৌসুমের শুরুতে প্রিমিয়ার লিগে টানা ৫ এবং সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৭ ম্যাচ জিতে রীতিমতো উড়ছিল লিভারপুল। মনে হচ্ছিল, এবারও হয়তো দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে লিগ শিরোপা ধরে রাখবে তারা। ভাগ্যও তখন ছিল লিভারপুলের পক্ষে। প্রথম ৭ ম্যাচের ৬টিতে লিভারপুল জিতেছিল শেষ মুহূর্তে (৮০ মিনিটের পর গোল দিয়ে) ঘুরে দাঁড়িয়ে। তবে মুদ্রার উল্টো পিঠে যে দুঃসময় চোখ রাঙাচ্ছিল, তা হয়তো অনেকেই ধারণা করতে পারেননি।
অষ্টম ম্যাচ থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে ভাগ্য। যে লিভারপুল শেষ মুহূর্তে গোল দিয়ে ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিচ্ছিল, তারা নিজেরাই এবার সে ফাঁদে পড়তে শুরু করে। প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল যে তিন ম্যাচে হেরেছে, তার মধ্যে দুটিতে তারা গোল খেয়েছে ৯০ মিনিটের পর এবং একটিতে ৮০ মিনিটের পর। সর্বশেষ লিভারপুল হারে গতকাল রাতে। ঘরের মাঠে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে ২–১ গোলে হেরেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা।
এর ফলে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে লিভারপুল হারল টানা চার ম্যাচে। এর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বরে ব্র্যান্ডন রজার্সের অধীনে টানা চার ম্যাচ হেরেছিল লিভারপুল। অথচ এবার টাকার বস্তা নিয়ে নেমে (৪৮ কোটি ১৯ লাখ ইউরো) খেলোয়াড় কিনেছিল দলটি। নতুন করে চুক্তি নবায়ন করেছিলেন মোহাম্মদ সালাহও। প্রশ্ন হচ্ছে, সব পক্ষে থাকার পরও কেন লিভারপুলের এমন দুর্দশা? আর্নে স্লটের দলের দুর্দশার সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
১. ভির্টৎস–ইসাকদের জ্বলে উঠতে না পারা
এবারের দলবদলে একাধিক তারকা খেলোয়াড় দলে ভেড়ায় লিভারপুল। বায়ার লেভারকুসেন থেকে ফ্লোরিয়ান ভির্টৎস ও জেরেমি ফ্রিমপং, আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে হুগো একিতিকে এবং নিউক্যাসল থেকে রেকর্ড দামে আলেক্সান্দার ইসাককে দলে টানে তারা। মৌসুমের শুরুতে যেসব বিষয় আলোচনায় ছিল, লিভারপুলের আক্রমণভাগ তার মধ্যে অন্যতম। তবে হুগো একিতিকে খানিকটা আলো ছড়ালেও ভির্টৎস ও ইসাক এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ব্যর্থ।
ইসাক এখন পর্যন্ত ৭ ম্যাচ খেলে মাত্র এক গোল করেছেন, তা–ও প্রিমিয়ার লিগে নয় (লিগ কাপে)। লিগের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগেও এখন পর্যন্ত গোলের খাতা খুলতে পারেননি এই সুইডিশ স্ট্রাইকার। ভির্টৎসের অবস্থা আরও শোচনীয়। লেভারকুসেনের প্রথম ট্রফিজয়ের অন্যতম এই নায়ক ১১ ম্যাচ খেলে এখন পর্যন্ত গোলের দেখা পাননি। আক্রমণভাগে এই দুজনের জ্বলে উঠতে না পারা লিভারপুলের বাজে ফলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তাই ঘুরে দাঁড়াতে হলে দলে নতুন আসা এই তারকাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
২. সালাহর ছন্দহীনতা
লম্বা সময় ধরে লিভারপুলের আক্রমণভাগে নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ সালাহ। এর মধ্যে শুধু লিভারপুলেরই নন, প্রিমিয়ার লিগের সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই মিসরীয় ফরোয়ার্ড। গত মৌসুমেও দলের সেরা তারকা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন এই উইঙ্গার, ভূমিকা রাখেন লিভারপুলের লিগ জয়ে।
কিন্তু এবার সেই সালাহকে যেন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিমিয়ার লিগে ৮ ম্যাচে করেছেন ২ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট। অথচ গত মৌসুমে প্রথম ৮ ম্যাচে সালাহ ৫ গোলের পাশপাশি ৫টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন। ২০২৩–২৪ মৌসুমেও প্রথম ৮ ম্যাচে তাঁর গোল ছিল ৫টি, অ্যাসিস্ট ৪টি। সালাহ সর্বশেষ এমন বাজে শুরু দেখেছিলেন ২০২২–২৩ মৌসুমে। সেবার প্রথম ১০ ম্যাচে সালাহ ২ গোল ও ৩টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন। আর মৌসুমটা লিভারপুল শেষ করেছিল ৫ নম্বরে থেকে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সালাহর পারফরম্যান্সের সঙ্গে লিভারপুলের ভাগ্যও জড়িয়ে আছে। তাই লিভারপুলকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে ছন্দে ফিরতে হবে সালাহকে।
৩. নড়বড়ে রক্ষণ
লিভারপুলের ধারাবাহিক ব্যর্থতার অন্যতম কারণ দলটির রক্ষণভাগ। চলতি মৌসুমে প্রতিপক্ষের প্রেসিং ও আক্রমণের সামনে বারবার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে দলটির রক্ষণ। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত খেলা ১১ ম্যাচের মাত্র একটি ক্লিনশিট (গোল না খাওয়া) রাখতে পেরেছে তারা। যেখানে প্রিমিয়ার লিগেই তারা শুধু হজম করেছে ৮ ম্যাচে ১১ গোল। যা কি না শীর্ষ আটে থাকা দলগুলোর মধ্যে যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি।
চার নম্বরে থাকা লিভারপুলের সমান ১১ গোল হজম করেছে তিনে থাকা বোর্নমাউথও। আর সব মিলিয়ে ১১ ম্যাচে লিভারপুল গোল খেয়েছে ১৫টি। এই পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, লিভারপুল রক্ষণে কতটা ভুগছে। রক্ষণে অবশ্য লিভারপুলের বিকল্প খেলোয়াড়ও কম। ক্রিস্টাল প্যালেস থেকে সেন্টার ব্যাক মার্ক গেহিকে আনার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি তারা। রক্ষণ নিয়ে সব মিলিয়ে বাজে অবস্থাতেই আছেন স্লট। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করতে না পারলে লিভারপুলের সংকট আরও গভীর হতে পারে।
৪. ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা
লিভারপুলের ধারাবাহিক হারের আরেকটি বড় কারণ ম্যাচ নিয়ন্ত্রণের অভাব। লিভারপুল সমর্থকেরা হয়তো ভাবতে পারেন, শেষ মুহূর্তে দুর্ভাগ্যজনক গোল খাওয়াই বুঝি সমস্যা। যদিও সমস্যা আরও বড়। ফেবারিট হিসেবে ম্যাচ শুরু করেও কোনোটিতে ম্যাচ লিভারপুলের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে মনে হয়নি।
বিশেষ করে শেষ দিকে ম্যাচে যখন টানটান উত্তেজনা চলতে থাকে, তখনই নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে দলটি এবং গোল হজম করছে। লিভারপুলকে লড়াইয়ে ফিরতে হলে দ্রুতই কৌশল বদলে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ওপর জোর দিতে হবে। নয়তো সামনের ম্যাচগুলোয় আরও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে দলটিকে।