দলবদলে খেলোয়াড় বেচাকেনার লড়াইয়ে কে জিতল আর কে হারল
শেষ হয়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের দলবদলের সময়সীমা। আপাতত জানুয়ারির আগে খেলোয়াড় কেনাবেচা করতে পারবে না কোনো ক্লাব। তবে এবারের দলবদলে যা হয়েছে, তাকে রীতিমতো পাগলামিই বলা যায়। যেখানে প্রিমিয়ার লিগ আবারও সর্বকালের সর্বোচ্চ খরচের রেকর্ড গড়েছে।
এবার গ্রীষ্মে দুটি ট্রান্সফার উইন্ডো ছিল। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের কারণে অতিরিক্ত নিবন্ধন সময় (১ জুন থেকে ১০ জুন) অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় উইন্ডো শেষ হয়েছে গতকাল রাতে। দলবদল শেষে এখন ক্লাব, খেলোয়াড়, কোচ ও এজেন্টদের মূল্যায়নের সময়। কেউ হয়তো কাঙ্ক্ষিত চুক্তি পেয়েছে, কেউ পায়নি। কেউ দুর্দান্তভাবে গ্রীষ্ম পার করেছে, আবার কেউ হারানো সুযোগ নিয়ে করছে আক্ষেপ।
এবার দেখা যাক, এবারের দলবদলে কারা জিতল, কারা হারল? আর কারা হারেওনি, জেতেওনি।
জিতল যারা
লিভারপুল
শুরু করা যাক এবারের দলবদলে সবচেয়ে বেশি খরচ করা ক্লাব লিভারপুলকে দিয়ে। অনেকের দাবি, এটাই ক্লাবটির ইতিহাসের সেরা ট্রান্সফার উইন্ডো। এটা সত্যিই লিভারপুলের সেরা দলবদলের ঘটনা কি না তা হয়তো সময়ই বলবে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে এবারের দলবদলে অবিশ্বাস্য সব চুক্তি করেছে তারা।
এই গ্রীষ্মেই দুবার ব্রিটিশ ট্রান্সফার রেকর্ড ভেঙেছে লিভারপুল। প্রথমে তারা বায়ার লেভারকুসেন থেকে ফ্লোরিয়ান ভির্টৎসকে দলে নিয়েছে ১০ কোটি পাউন্ডে, সঙ্গে ছিল আরও ১ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ডের ‘অ্যাড-অনস’। এরপর ডেডলাইনের অর্থাৎ দলবদলের শেষ দিনে নিউক্যাসল ইউনাইটেড থেকে আলেকজান্ডার ইসাককে কিনতে গিয়ে আবারও রেকর্ড ভেঙেছে তারা। ইসাকের জন্য লিভারপুলের খরচ ১২ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড।
এই দুটি বিশাল চুক্তির বাইরেও তারা হুগো একিতিকে (৬ কোটি ৯০ লাখ পাউন্ড), মিলোস কেরকেজ (৪ কোটি পাউন্ড), জেরেমি ফ্রিমপং (২ কোটি ৯০ লাখ পাউন্ড) এবং জিওভান্নি লিওনি (২ কোটি ৬ লাখ পাউন্ড) দলে ভিড়িয়েছে। সব মিলিয়ে শুধু অর্থের দিকেই নয়, মানের দিক থেকেও এবারের দলবদলের সেরা দল লিভারপুল। এখন মোহাম্মদ সালাহ-ভার্জিল ফন ডাইকদের সঙ্গে দলে আসা নতুন তারকাদের জ্বলে ওঠার অপেক্ষা।
শুধু খেলোয়াড় কেনায় নয়, বিক্রির দিকেও দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছে লিভারপুল। লুইস দিয়াজ, জারেল কুয়ানসাহ, দারউইন নুনিয়েজসহ অন্যান্য খেলোয়াড় বিক্রি করে ২০ কোটি পাউন্ডের বেশি আয় করেছে তারা। এর সঙ্গে অবশ্য ছোট একটি ব্যর্থতাও ছিল।£৩ কোটি ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডে ক্রিস্টাল প্যালেস থেকে মার্ক গেহিকে আনার ব্যাপারে সবকিছু চূড়ান্ত করেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি আর্নে স্লটের দল।
আর্সেনাল
এবারের দলবদলে স্কোয়াড শক্তিশালী করতে আটজন খেলোয়াড়কে দলে টেনেছে আর্সেনাল। লন্ডনের ক্লাবটি মূলত পজিশন ধরে ধরে দলের শক্তি বাড়িয়েছে। ফরোয়ার্ড লাইন উন্নত করতে তারা দলে ভিড়িয়েছে ভিক্টর ইয়োকেরেস, এবেরেচি এজে এবং ননি মাদেউকেকে। মিডফিল্ডে তারা এনেছে মার্টিন জুবিমেন্ডি ও ক্রিশ্চিয়ান নরগার্ডকে। ডিফেন্সকে দৃঢ় করতে দলটিতে যোগ দিয়েছেন ক্রিসথিয়ান মোস্কেরা ও পিয়েরো হিনকাপিয়ে। আর গোলপোস্টের নিচে ডেভিয়ার রায়ার দক্ষ সহায়ক হিসেবে এসেছেন কেপা আরিজাবালাগা। বলা যায়, সব মিলিয়ে স্কোয়াডের গভীরতা অনেকটাই বাড়িয়েছে আর্সেনাল। এখন মাঠের খেলাতে এই গভীরতার ঠিকঠাক প্রতিফলন দেখা গেলেই হয়।
রিয়াল মাদ্রিদ
২০২৪-২৫ মৌসুমে হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর দলবদলে রিয়াল মাদ্রিদ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় সেদিকেই চোখ ছিল সবার। এর মধ্যে জাবি আলোনসোকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েই বড় পরিবর্তনের বার্তা দেয় তারা। কোচ বদলের প্রভাব দেখা যাচ্ছে রিয়ালের পারফরম্যান্সেও। শুধু কোচ কিংবা কৌশলেই নয়, গ্রীষ্মের দলবদলে খেলোয়াড় কেনার দিক থেকেও দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছে রিয়াল।
নামমাত্র খরচে লিভারপুল থেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেকসান্দার আরনল্ডকে নিয়ে আসা ছিল রিয়ালের সবচেয়ে বড় দান। এরপর আর্জেন্টিনার উদীয়মান তরুণ ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুয়োনো, স্প্যানিশ ডিফেন্ডার ডিন হুইসেন এবং আলভারো কারেরাসকে দলে টানাও দীর্ঘ মেয়াদে উপকৃত করবে রিয়ালকে। অন্যদিকে খেলোয়াড় ছাড়ার দিক থেকে লুকা মদরিচ এবং লুকাস ভাসকেজের মতো ফুটবলাররা তরুণদের জায়গা করে দিয়ে ক্লাব ছেড়েছেন। নিয়মিত তারকাদের মধ্যে রদ্রিগোর ক্লাব ছাড়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। সব মিলিয়ে দলবদলে রিয়াল ভালো সময়ই পার করেছে এবার।
যারা হারেওনি, জেতেওনি
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
দীর্ঘ সময় ধরে সাফল্যের খোঁজে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবারের দলবদলে চেষ্টা করেছে দল গোছাতে। দলবদলে বেশ কজন পরীক্ষিত খেলোয়াড়ও দলে ভিড়িয়েছে তারা। তবে মাতেউস কুনিয়া (৬ কোটি ২৫ লাখ পাউন্ড) এবং ব্রায়ান এমবেউমোর (৬ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড) জন্য খরচটা বোধহয় একটু বেশিই করেছে তারা। এ ছাড়া সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে নতুন কোনো খেলোয়াড় না কেনাও ভোগাতে পারে ইউনাইটেডকে।
তবে দলবদলে ভালো কিছু কাজও করেছে ইউনাইটেড। স্ট্রাইকার বেনজামিন সেসকো এবং গোলকিপার সেনে ল্যামেন্স দলকে তারুণ্যের শক্তিতে উজ্জ্বীবিত করেছেন। পাশাপাশি আন্তনি এবং আলেহান্দ্রো গারনাচো কিছু খেলোয়াড়কে বিক্রি করে আর্থিক বোঝাও কমাতে পেরেছে তারা। সব মিলিয়ে অম্লমধুর দলবদলই পার করেছে ইউনাইটেড।
ম্যানচেস্টার সিটি
‘নয়-ভালো নয়-খারাপ’জোনে আছে ইউনাইটেডের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটিও। এই গ্রীষ্মে সত্যিই কিছু ভালো চুক্তি করেছে তারা। কিন্তু কিছু প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তিও আছে। ভালোর দিক দিয়ে শুরু করলে তিজানি রেইন্ডার্স ইতিমধ্যেই তাঁর প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন। পাশাপাশি রায়ান আয়ত-নুরিকে উলভস থেকে চমকপ্রদভাবে কম দামে কিনতে পেরেছে তারা। কিন্তু রায়ান শেরকি এবং জিয়ানলুইজি দোন্নারুম্মা পেপ গার্দিওলার কৌশলের সঙ্গে কতটা মাননসই, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এখন এ দুজনকে গার্দিওলা কীভাবে ব্যবহার করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
হেরেছে যারা
বায়ার্ন মিউনিখ
বায়ার্ন মিউনিখের জন্য গ্রীষ্মের দলবদলের সময়টা কঠিন ছিল। কারণ বেশিরভাগ চুক্তি সম্পন্ন করতেই বেগ পেতে হয়েছে তাদের। এতে অনেক প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি নাটাকীয় পরিবেশও তৈরি হয়েছে। এমনকি প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়াড়দের পেছনে অতিরিক্ত খরচ করতেও দেখা গেছে জার্মান চ্যাম্পিয়নদের, যা একরকম অপ্রত্যাশিতই বলা যায়।
জুনে লেভারকুসেন থেকে তারা জোনাথান তাহকে কেনে, যিনি ছিলেন বায়ার্নের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। ফ্রি ট্রান্সফার হিসেবে তাকে কিনলেও তাহকে বড় অঙ্কের বেতনই দিচ্ছে তারা। এরপর তারা উইঙ্গার কেনায় মনোযোগ দেয়, যেখানে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিকো উইলিয়ামস। যদিও শেষ পর্যন্ত উইলিয়ামসকে কিনতে পারেনি তারা। এরপর তারা চেষ্টা করে মার্কাস রাশফোর্ডকে কিনতে, কিন্তু ইংলিশ স্ট্রাইকার চলে যান বার্সেলোনায়।
অন্যদিকে বায়ার্ন ছেড়ে লেরয় সানে চলে যান গ্যালাতাসারাইতে, টমাস মুলার পাড়ি জমান ভ্যানকুভার হোয়াইটক্যাপসে এবং কিংসলি কোমান নতুন ঠিকানা খুঁজে নেন আল নাসরে। পরিস্থিতি খারাপ হয়, জামাল মুসিয়ালা ক্লাব বিশ্বকাপে গুরুতর আঘাত পেলে। এর ফলে বায়ার্ন এখন আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়ের সংকটে ভুগছে।
দলবদলে তাদের উল্লেখযোগ্য সংযোজন লিভারপুলের ২৮ বছর বয়সী উইঙ্গার লুইস দিয়াজ। অনেকেই দিয়াজের বায়ার্নের ৭ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডকে অতিরিক্তই মনে করছেন। এ ছাড়া অবশ্য আর কোনো উপায়ই ছিল না। এরপর নানা নাটকীয়তা শেষে ডেডলাইন ডেতে তারা দলে ধারে দলে টানে নিকোলাস জ্যাকসনকে। যদিও বায়ার্নে জ্যাকসন কতটা ভালো করতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকেরই।
বায়ার্ন ছাড়াও সংবাদমাধ্যম ইএসপিএন হারার তালিকায় রেখেছে নিউক্যাসল ইউনাইটেড, বায়ার লেভারকুসেন এবং অ্যাস্টন ভিলাকেও।