১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসের একদিন। মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরগামী বিমানে বসে ছিলেন একদল তরুণ। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় দলের তকমা মাত্রই তাঁদের গায়ে লেগেছে। কোচ সাহেব আলীর নেতৃত্বে সামান্য কদিন অনুশীলন করেই মালয়েশিয়ার মাটিতে মারদেকা কাপে খেলতে গিয়েছিলেন তাঁরা। সেখান থেকেই বাংলাদেশ দল যায় সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুর তখন এশিয়ার ফুটবলে বলার মতো কোনো নাম নয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় দলের অন্যতম সদস্য ডিফেন্ডার শেখ আশরাফ আলী ৫২ বছর পেছন ফিরে বলেন, ‘সিঙ্গাপুর তখন আহামরি দল ছিল না। আমাদের মতোই ছিল। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশের মান ছিল একই পর্যায়ে। আমাদের ওপরে ছিল কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) মতো দলগুলো। তবে সে সময় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর সফরটা আমাদের জন্য বড় শিক্ষণীয় ছিল। কারণ, আমরা তখন নতুন একটা জাতির নাম বুকে নিয়ে খেলতে যাই।’
সিঙ্গাপুর অবশ্য এখনো আহামরি কোনো দল নয়। গত মার্চেই তারা ফিফা প্রীতি ম্যাচে নেপালের কাছে হেরেছে। যদিও ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে সিঙ্গাপুর এখন ১৬১, বাংলাদেশ ১৮৩। তারপরও দলটি বাংলাদেশের ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। ১৯৭৩ সালে যেমন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল না, এখনো নয়।
তবে সময়টা বদলেছে। ৫২ বছর আগে বাংলাদেশের ফুটবলারদের চোখে তখন সবকিছুই নতুন। প্রথমে মারদেকা স্টেডিয়াম, তারপর সিঙ্গাপুরের স্টেডিয়াম দেখে চোখ কপালে উঠেছিল অনেকের। সেই দলের অন্যতম সদস্য রাইটব্যাক (মূলত স্টপারব্যাক ছিলেন) শেখ আশরাফ আলীর কাছে আজ যা স্মৃতি হয়ে আছে, ‘খুব সম্ভবত মারদেকা এবং সিঙ্গাপুরে ফ্লাডলাইটেও খেলা হয়েছে। ফ্লাডলাইট তখন আমরা প্রথম দেখলাম। স্টেডিয়ামে এত আলো দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। ১৯৭৮ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে আমরা প্রথম ফ্লাডলাইট পাই। তখন দিনের আলোতেই খেলতে অভ্যস্ত ছিলাম আমরা।’
সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে মারদেকায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় বাংলাদেশের। কাজী সালাহউদ্দিনের গোলে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও ম্যাটা ১-১ গোলে ড্র হয়। তবে সেই ড্র ম্যাচের কথা এখন আর মনে নেই শেখ আশরাফ আলীর। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বলেন, ‘মারদেকায় আমরা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে খেলছি কি না আমার ঠিক মনে নেই। অনেক বছর আগের কথা। তবে এটা মনে আছে, মারদেকা শেষ করে সিঙ্গাপুর যাই আমরা। সেখানে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে দুটি ম্যাচ খেলি। প্রথমটায় জিতি আমরা (নওশেরুজ্জামান একমাত্র গোল করেন)। দ্বিতীয়টায় সম্ভবত হেরেছি ওদের যুব দলের কাছে (২-০)।’
এটা নিয়ে এত এত আয়োজন, এত হাইপ কেন বুঝি না। খেলাকে খেলা হিসেবেই রাখতে হয়। অতিরিক্ত চাপ দিলে হাইপ তুললে খেলোয়াড়েরা দুর্বল হয়ে পড়ে।সিঙ্গাপুর ম্যাচ নিয়ে শেখ আশরাফ আলী
১৯৭৩ সালের ১৩ ও ১৫ আগস্ট সেই দুটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। সেটিই বাংলাদেশের প্রথম সিঙ্গাপুর সফর। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু—আজ শুধুই এক নাম, এক স্মৃতি। তাঁর সঙ্গে খেলেছেন কাজী সালাহউদ্দিন, নওশেরুজ্জামান, শেখ আশরাফ আলী এনায়েতুর রহমান, জুনিয়র নাজিররা।
আশরাফ আলী স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে নেমে শুনি রাস্তায় থুতু ফেলতে মানা, সিগারেট খেয়ে ফেলে দিলেও জরিমানা দিতে হবে! আমরা তো চমকে গিয়েছিলাম। এত পরিচ্ছন্নতা, এত নিয়ম ছিল তখনকার সময়েই! আমরা তখন নতুন এক দেশ থেকে গিয়েছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলতে কিছুই ছিল না।’
তারপর দুই দেশের ফুটবল মাঠে দেখা হয়েছে হাতে গোনা দুবার। ২০০৭ সালে মারদেকায়, সেটি অবশ্যই দুই দেশের জাতীয় দল ছিল না। সিঙ্গাপুরের অনূর্ধ্ব-২৩, বাংলাদেশে ‘বি’ দল। ২০১৫ সালে সর্বশেষ দুই দেশের জাতীয় দল প্রীতি ম্যাচ খেলে। সেটি ছিল ঢাকায়। ১০ বছর পর গতকাল রাতে সিঙ্গাপুর আবার এসেছে ঢাকায়।
এবার এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব খেলতে। মাঠে নামবে ১০ জুন। এরই মধ্যে ম্যাচ নিয়ে বিশাল আয়োজন করেছে বাফুফে, যা দেখে শেখ আশরাফ আলী খানিক বিরক্তও, ‘এটা নিয়ে এত এত আয়োজন, এত হাইপ কেন বুঝি না। খেলাকে খেলা হিসেবেই রাখতে হয়। অতিরিক্ত চাপ দিলে হাইপ তুললে খেলোয়াড়েরা দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ দলকে শুভকামনা জানাই। তবে মনে রাখতে হবে, এটা একটা ম্যাচ, তার বেশি কিছু নয়।’