১৮ বছর বয়সেই ইয়ামাল খেলেছেন ১৩০ ম্যাচ, অতিরিক্ত খেলার চাপই কি চোটের আসল কারণ
একই দৃশ্য বারবার ফিরে আসছে। বার্তাটাও ক্রমেই আরও স্পষ্ট হচ্ছে—ফুটবল নিজেই এখন খেলোয়াড়দের ‘শত্রু’! ফুটবলারদের কোণঠাসা হয়ে পড়ার কারণও এখন অতিরিক্ত ম্যাচ খেলা। যেখানে সর্বশেষ সতর্কবার্তাটি এসেছে লামিনে ইয়ামালের কাছ থেকে। গত মাসে স্পেন জাতীয় দলের হয়ে অনুশীলনে চোট পান ইয়ামাল। এর পর থেকেই তাঁর চোট নিয়ে বার্সেলোনা ও স্পেন ফুটবল ফেডারেশন একে অপরের দিকে অভিযোগের তির ছুড়তে শুরু করে।
বর্সা কোচ হানসি ফ্লিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এটা লজ্জাজনক। সে ব্যথা নিয়েই জাতীয় দলে গেছে, খেলেছেও... এটা খেলোয়াড়দের যত্ন নেওয়া নয়।’ স্পেন কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তে অবশ্য দলের চিকিৎসাব্যবস্থাকে রক্ষা করে পাল্টা জবাব দেন।
তবে এই জবাব ও পাল্টা জবাবের মধ্যে বাস্তবতা হচ্ছে, ইয়ামাল তিন সপ্তাহের মতো মাঠের বাইরে থাকবেন। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। ভেতরের সত্যটা বোধ হয় আরও বড়। ইয়ামালের এই ঘটনা এমন চিত্রকে সামনে এনেছে, যা অনেকে দেখেও দেখছেন না। সেটি হচ্ছে, অতিরিক্ত খেলার চাপ তারকাদের রীতিমতো শেষ করে দিচ্ছে।
ফিফপ্রোর (বিশ্ব ফুটবলার ইউনিয়ন) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ফুটবলারদের অতিরিক্ত চাপের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনে ইয়ামাল হচ্ছেন সেই নিখুঁত উদাহরণ যা দেখায়, ফুটবল কোথায় পৌঁছাবে যদি কেউ এখনই লাগাম না টানেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই বার্সার এ উইঙ্গার খেলেছেন ১৩০টি পেশাদার ম্যাচ, মাঠে ছিলেন ৯,৭৭২ মিনিট—যা একই বয়সে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জাভি হার্নান্দেজ এবং সেস ফ্যাব্রেগাসের ম্যাচসংখ্যা কিংবা মাঠে থাকার সময়ের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ!
একই বয়সের জুড বেলিংহামের চেয়েও ৩১ শতাংশ সময় বেশি মাঠে ছিলেন ইয়ামাল, অথচ বেলিংহামকেই অনেকে ‘অতিরিক্ত ব্যবহারের’ উদাহরণ হিসেবে সামনে আনতেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান প্রজন্মের তরুণ ফুটবলাররা আগের প্রজন্মের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সময় মাঠে কাটাচ্ছে।
ইয়ামালের মতো বলা যায় উরুগুয়ে ও রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ফেদে ভালভের্দের কথাও। ২০২৪-২৫ মৌসুমে তিনি খেলেছেন ৭২টি ম্যাচ ও মাঠে ছিলেন মোট ৬,৬৭৬ মিনিট, যা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ৮১ শতাংশ ম্যাচই তিনি খেলেছেন পরপর, অর্থাৎ দুই ম্যাচের মাঝে পাঁচ দিনেরও কম বিশ্রাম পেয়েছেন। মাসের পর মাস, তিন-চার দিন পরপর মাঠে নেমে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। চিকিৎসকদের মতে, এই ছন্দ ও গতি ধরে রাখা অসম্ভব।
রদ্রির গল্পও একই রকম। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রদ্রি খেলেছেন ১৩৫টি ম্যাচ—যা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশকৃত বছরে সর্বোচ্চ ৫৫ ম্যাচের সীমার অনেক বেশি। ইউরো ২০২৪-এর ফাইনালে স্পেনের হয়ে খেলার পরই রদ্রি হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে পড়েন। প্রাক্-মৌসুমে যথেষ্ট বিশ্রাম না পাওয়ায় তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠে ফেরেন। ফলটা সবারই জানা। কয়েক সপ্তাহ পর রদ্রির হাঁটুর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় এবং ২৩৫ দিন মাঠের বাইরে থাকতে হয়। আর্সেনাল কোচ মিকেল আরতেতা এ নিয়ে সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘গত দুই মৌসুমে আমাদের এমন খেলোয়াড় আছে যারা ১৩০ ম্যাচ খেলেছে। বারবার অতিরিক্ত ম্যাচ খেলে দুর্ঘটনা ঘটবেই।’
একই ফাঁদে পড়েছেন পেদ্রিও। ২০২৪-২৫ মৌসুমে বার্সেলোনার এই মিডফিল্ডার খেলেছেন ৬৯ ম্যাচ ও মাঠে ছিলেন ৫,৫০৩ মিনিট। এর মধ্যে ৫৫টি ম্যাচ টানা খেলেছেন পর্যাপ্ত বিশ্রাম ছাড়া। মাত্র ২২ বছর বয়সে পেদ্রি এমন চাপের বোঝা কাঁধে নিয়েছেন, যা এক দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল।
২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রদ্রি খেলেছেন ১৩৫টি ম্যাচ—যা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশকৃত বছরে সর্বোচ্চ ৫৫ ম্যাচের সীমার অনেক বেশি।
বায়ার্ন মিউনিখের সেন্টারব্যাক কিম মিন-জে গত মৌসুমে খেলেছেন ৭৩ দিনে ২০ ম্যাচ, অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩.৬ দিনে একটি করে ম্যাচ খেলেছেন। একই মৌসুমে ৩৯ বছর বয়সে লুকা মদরিচ ৭৬ ম্যাচে ৪,৩৭৬ মিনিট মাঠে ছিলেন। আশরাফ হাকিমি খেলেছেন ৬৯ ম্যাচ, ৬,৩৭১ মিনিট। বার্সার ডিফেন্ডার জুলেস কুন্দে বিষয়টি বুঝিয়েছেন এভাবে, ‘যখন এত বেশি ম্যাচ হয়, তখন সেটা জীবনের মতো হয়ে যায়। অতিরিক্ত ব্যবহারে মূল্য হারায়। ফলে একসময় খেলার প্রতি আগ্রহও কমে যাবে।’
১ হাজার ৫০০ ফুটবলার ও ৭০ জন স্বাধীন চিকিৎসকের ওপর ভিত্তি করে তৈরি ফিফপ্রোর এই প্রতিবেদন ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মৌসুম শেষে খেলোয়াড়দের কমপক্ষে ২৮ দিনের পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু ইউরো ২০২৪–এর পর কজন সেটা পেয়েছেন? মাত্র ১৪ শতাংশ!
কোপা আমেরিকার পর আরও কম—৯ শতাংশ। লিভারপুলের ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক আলিসন বেকার ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘নতুন টুর্নামেন্ট যোগ করার সময় কেউই খেলোয়াড়দের মতামত জানতে চায় না। হয়তো আমাদের কথার কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু সবাই জানে আমরা কী ভাবি—আমরা ক্লান্ত।’
ফুটবলের সূচি এখন একেবারেই জটিল এক গোলকধাঁধা। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের কারণে এবারের গ্রীষ্মকালীন সময়টা পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। সুপারিশকৃত ২৮ দিনের বিরতি পায়নি একটি দলও। রেড বুল সালজবুর্গ বিরতি পেয়েছে মাত্র ৮ দিন, পিএসজি ৭ দিন!
অন্য খেলাগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে চিত্রটা আরও স্পষ্ট। এনবিএর ফাইনালিস্ট দল বিশ্রাম পায় ২৩ সপ্তাহ, বেসবল খেলোয়াড়েরা (প্লে–অফে না গেলে) ১৫ সপ্তাহ, এমনকি অস্ট্রেলিয়ান লিগেও থাকে ১৪ সপ্তাহের বিরতি। পেপ গার্দিওলা এ নিয়ে বলেছেন, ‘আমি সব সময় এনবিএর উদাহরণ দিই। তারা কয়েক মাসে ৮০ ম্যাচ খেলে, কিন্তু পরে চার মাস বিশ্রাম পায়। এতে শরীর পুনরুদ্ধার করতে পারে। সমস্যা হলো, এখন মৌসুমগুলো খুবই পরিশ্রমসাধ্য। অথচ বিশ্রাম মাত্র তিন সপ্তাহ।’
এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে অযৌক্তিক ভ্রমণচাপ। লেভান্তের অস্ট্রেলিয়ান গোলরক্ষক ম্যাথু রায়ান এক মৌসুমে ভ্রমণ করেছেন ১,৬৯,০০০ কিলোমিটার, বিমানে কাটিয়েছেন ২১৭ ঘণ্টা, পেরিয়েছেন ১০০-এরও বেশি টাইম জোন। ময়জেস কাইসেদো ১৪ দিনে দুটি মহাদেশে চারটি ম্যাচ খেলেছেন, ভ্রমণ করেছেন ২৫,০০০ কিলোমিটার। চিলির জাভিয়ের আলতামিরানো এক ম্যাচ শেষ করে ঠিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরের ম্যাচ খেলেছেন নিজের ক্লাবের হয়ে।
সমাধান অবশ্য আছে, বৈজ্ঞানিকভাবে তা প্রমাণিতও। সেটা হলো মৌসুম শেষে বাধ্যতামূলক চার সপ্তাহের বিশ্রাম দিতে হবে ফুটবলারদের। চার সপ্তাহের ধীরগতির প্রাক্-মৌসুম, ম্যাচের মাঝে ন্যূনতম দুই দিন বিরতি, প্রতি সপ্তাহে এক দিন ছুটি আর ২১ বছরের নিচের খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ সুরক্ষা। কিন্তু এসব প্রয়োগের ইচ্ছাশক্তি কারও নেই। ফিফা টুর্নামেন্ট বাড়াচ্ছে, উয়েফা সূচি দীর্ঘ করছে, লিগগুলো ছাড় দিতে রাজি নয়, ফেডারেশন চাইছে নিজেদের উইন্ডো। এই টানাপোড়েনের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে খেলোয়াড়দের।
আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি কোচ মার্সেলো বিয়েলসা এর আগে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘অতিরিক্ত ম্যাচ ও ভ্রমণের প্রভাব উপেক্ষা করলে যেকোনো খেলোয়াড়ই একসময় চোটে পড়বে।’ ইয়ামালের গল্পই যেন তারই জীবন্ত প্রমাণ।