সাগরিকার মা–বাবা আজ আনন্দে আরও কাঁদবেন

লিটন আলী ও আনজু বেগম। পাশে তাঁদের মেয়ে সাগরিকাপ্রথম আলো

মেয়ের খেলা দেখবেন। লিটন আলী ও আনজু বেগম তাই সারা রাত ট্রেনে দাঁড়িয়ে এসেছেন।

সেই মেয়ের নাম মোসাম্মাৎ সাগরিকা। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৯ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় আসাটা সহজ কিছু নয়, অনেক লম্বা পথ। বসার জায়গা না পেলে এই যাত্রা আরও দীর্ঘ হয়ে যায়। তার ওপর আনজু বেগম একটু অসুস্থও। এক সহযাত্রীকে অনুরোধ করে চালের বস্তার ওপর একটু বসার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে রক্ষা।

আমি আমার মেয়েকে খেলতে দিতে চাইনি। আমরা যে পরিবার, তাতে ফুটবল খেলা একটা বিলাসিতাই মনে হয়েছিল। তা ছাড়া আমার একটা শঙ্কা ছিল, ফুটবল খেললে সবাই কী বলবে! মেয়ের তো বিয়ে দিতে হবে! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমি পুরোপুরি ভুল ছিলাম। মেয়ে এখন শুধু আমাদের নয়, পুরো দেশের। আমার মেয়ে দেশের হয়ে খেলছে—এই গর্ব আমি কোথায় রাখি!
লিটন আলী, সাগরিকার বাবা

আজ সন্ধ্যা ৬টায় কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে ভারতের। এ ম্যাচে আফঈদা, স্বর্ণা, স্বপ্না, পূজা, উমহেলা, ইতি, সাগরিকারা লড়বেন মেয়েদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে সাফ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে। নির্দিষ্ট করে বললে, সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ ফুটবলের শিরোপা ধরে রাখার জন্য। এ টুর্নামেন্টের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন যে বাংলাদেশই।

সাগরিকার গোলেই গত মঙ্গলবার সাফের ফাইনাল নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। সে ম্যাচে ৯১তম মিনিটে অধিনায়ক আফঈদার একটি লম্বা থ্রু ধরে দারুণ এক গোল। প্রথম ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে ৩–১ গোলের জয়েও সাগরিকার আছে জোড়া গোল। ২ ম্যাচে ৩ গোল করে এরই মধ্যে দেশের নারী ফুটবলের আগামী দিনের তারকা হিসেবে নিজেকে চিনিয়েছেন সাগরিকা। অথচ তাঁর ফুটবলই খেলার কথা ছিল না। যে মা–বাবা সুদূর ঠাকুরগাঁও থেকে সাগরিকার ফাইনাল খেলা দেখতে এসেছেন, তাঁরাই একসময় মেয়ের ফুটবল খেলার তীব্র বিরোধী ছিলেন।

নারী ফুটবলের আগামী দিনের তারকা হিসেবে বেড়ে উঠছেন সাগরিকা
প্রথম আলো

আজ সাগরিকার বাবা লিটন আলী সেই কথা মনে করছিলেন আর তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছিল, ‘আমি আমার মেয়েকে খেলতে দিতে চাইনি। আমরা যে পরিবার, তাতে ফুটবল খেলা একটা বিলাসিতাই মনে হয়েছিল। তা ছাড়া আমার একটা শঙ্কা ছিল, ফুটবল খেললে সবাই কী বলবে! মেয়ের তো বিয়ে দিতে হবে! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমি পুরোপুরি ভুল ছিলাম। মেয়ে এখন শুধু আমাদের নয়, পুরো দেশের। আমার মেয়ে দেশের হয়ে খেলছে—এই গর্ব আমি কোথায় রাখি!’

আরও পড়ুন

মা আনজু বেগম গত শুক্রবার মেয়ের সঙ্গে একটু কথা বলেছেন। ১৭ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে কত দূরে আছে! সে কী করছে, কী খাচ্ছে—এসব নিয়ে ভেবে ভেবে অস্থির তিনি। আর দশজন মা মেয়ের জন্য যেমন চিন্তিত হন, তিনিও ঠিক সে রকমই চিন্তিত।

আনজু বেগমও অশ্রুসিক্ত নয়নে সাগরিকার ফুটবলার হয়ে ওঠার সময়টার কথা বললেন, ‘আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে। আমাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে খেলতে হয়েছে। তবে ও ফুটবলার হওয়ার জন্য জেদ ধরেছিল। ওকে কিছুই দিতে পারিনি, সে আমাদের কাছে একটা বুট চেয়েছিল, আমরা দিতে পারিনি। বুটের অনেক দাম। সেই টাকা খরচের সামর্থ্য আমাদের ছিল না।’

আজ ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল। শেষ বাঁশি বাজার পর সাগরিকার মুখে এমন হাসিটাই দেখতে চান সমর্থকেরা
প্রথম আলো

ছোটবেলা থেকেই রানীশংকৈলের রাঙাটুঙ্গি একাডেমিতে বেড়ে উঠেছেন সাগরিকা। সেই একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলামের হাতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় সেই রাঙাটুঙ্গি একাডেমি থেকে কয়েকজন মেয়েকে ভর্তি নিতে চেয়েছিল বিকেএসপি। কিন্তু সাগরিকা সেখানে গিয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। তাজুল ইসলামই সাগরিকার বিকেএসপিতে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু ছাত্রী থাকতে না চাওয়ায় তাঁকে ফেরত নিয়ে আসেন। এরপর সেই রাঙাটুঙ্গি থেকেই সাগরিকাকে অন্য নারী ফুটবলারদের সঙ্গে দলে ভেড়ায় মেয়েদের ফুটবল লিগের দল এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

মেয়েদের লিগে সাগরিকা পাল্লা দিয়েছেন দেশের শীর্ষ নারী ফুটবলারদের সঙ্গে। সেবার ২৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন আকলিমা আক্তার। সাগরিকা গোল করেছিলেন ১০টি। এরপরই মেয়েদের ফুটবলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তাঁকে নিয়ে আসেন মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলে।

আরও পড়ুন

সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ ফুটবলে মেয়ের খেলা দেখতে পারেননি সাগরিকার মা–বাবা। বাড়িতে তাঁদের টেলিভিশনই যে নেই। তবে কথা হয়েছে সাগরিকার সঙ্গে। কী বলেছেন, তাঁরা নিজেরাই ঠিক জানেন না। একরকম ঘোরের মধ্যেই যে ছিলেন তাঁরা দুজন। পরদিন গ্রামের মানুষ পত্রপত্রিকা কিনে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। পত্রিকার পাতায় মেয়ের বড় বড় ছবি দেখে তাঁরা অবাক। এসব স্বপ্ন, না সত্যি?

এর মধ্যে সুখবরও এসেছে। বাংলাদেশের ই‌লেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন সাগ‌রিকার বাবা–মা‌য়ের হাতে এক‌টি টে‌লি‌ভিশন তুুলে দিয়েছে উপহার হিসেবে।

লিটন আলী বোঝেন, তাঁর মেয়ে নিজের স্বপ্নকেই সত্যি করেছেন। গ্রামের পাশের বাড়িতে নিজের বোন সম্পর্কের লুনার কথাও বললেন তিনি। সাগরিকার খালা লুনা মানসিক সমর্থন দিয়েছিলেন সাগরিকাকে, ‘লুনা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকেন। সাগরিকা ওকে খালা ডাকে। লুনাও সাগরিকাকে খুব ভালোবাসেন। উনি বলেছিলেন, “আপনারা যদি মেয়েকে ফুটবলার হতে না দেন, তাহলে ওকে আমাকে দিয়ে দিন। আমি ওকে ফুটবলার বানাব।”’

সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ ফুটবলে মেয়েদের মুখে এমন হাসিই দেখতে চায় বাংলাদেশ। সাগরিকা কি পারবেন শেষ বাঁশি বাজার পর সেই হাসি এনে দিতে
প্রথম আলো

লুনা খালার কথা নেপালের বিপক্ষে জোড়া গোল করার পরপরই বলেছিলেন সাগরিকা। আনজু বেগম বললেন, ‘লুনা আমাদের গ্রামের শিক্ষিত মেয়ে, ওর মনমানসিকতাই অন্য রকম। সে আমার মেয়েকে খুব আদর করে। সে আমাদের বুঝিয়েছে, মেয়ের ইচ্ছাকে সম্মান দেওয়াটা কত জরুরি।’

লিটন আলী আর আনজু বেগম মেয়েকে ফুটবলার হতে দিয়েছেন। সারা দেশ এখন তাঁর মেয়েকে চেনে। আজ কমলাপুর স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে মেয়ের খেলা দেখবেন তাঁরা। জাতীয় সংগীতের সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে নামবে তাঁদের কন্যা। সারা দেশ তাঁদের মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে একটা গোলের জন্য।

আজ সন্ধ্যায় খুব কাঁদবেন তাঁরা। সেই কান্না আনন্দের। সেই কান্না তৃপ্তির।

আরও পড়ুন