ইন্টার পরীক্ষায় যেভাবে ফেল করল বার্সা
ইউরোপিয়ান ফুটবলে ধ্রুপদি এক রাত। বিশেষজ্ঞদের চোখে, ‘ওয়ান অব দ্য অলটাইম ক্ল্যাসিক’—বিবিসির ভাষায়, কেউ–ই চায়নি ম্যাচটা শেষ হোক। কিন্তু শেষ বাঁশি তো বাজবেই আর হার–জিতও ঠিক হবে, যেখানে জয়ী দলটির নাম ইন্টার মিলান। সান সিরোয় কাল সেমিফাইনাল ফিরতি লেগ ৪–৩ গোলে জিতেছে ইন্টার। দুই লেগ মিলিয়ে বার্সেলোনাকে ৭–৬ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে ইতালিয়ান ক্লাবটি।
প্রথম লেগের মতো ফিরতি লেগেও ২–০ গোলে পিছিয়ে পড়া থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বার্সা। এরপর ৮৭ মিনিটে রাফিনিয়ার গোলে বার্সা ভেবেছিল দারুণ এক ‘কামব্যাক’–ই হচ্ছে। কিন্তু যোগ করা সময়ে ফ্রান্সেসকো আচেরবির গোলে সমতায় ফেরার পর অতিরিক্ত সময়ে (৯৯ মিনিট) দাভিদ ফ্রাত্তেসির গোলে অবিশ্বাস্য এক জয় তুলে নেয় ইন্টার।
বার্সা ম্যাচটি কোথায় হারল আর ইন্টার কোথায় জিতল—তার বিশ্লেষণ করেছে দ্য অ্যাথলেটিক।
ইন্টার যেভাবে জিতল
সিমোন ইনজাগির দল ভেবেছিল বিদায় নিশ্চিত। ৫৪ থেকে ৮৭ মিনিটের মধ্যে তারা তিনটি গোল হজম করেছে, প্রতিউত্তরে এ সময় কিছুই করতে পারেনি। আবারও ২–০ গোলে এগিয়ে গিয়েও লিড ধরে রাখতে পারেনি। চ্যাম্পিয়নস লিগে টিকে থাকা দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক এই স্কোয়াডকে ঘুরে দাঁড়াতে অলৌকিক, অবিশ্বাস্য কিছুই করতে হতো।
সেই অলৌকিকত্বের শুরু একটা দূরপাল্লার পাসে। তখন বিপদ আঁচ করা যায়নি। কিন্তু ডেনজেল ডামফ্রিসের হার না মানা মানসিকতায় বার্সার বিপদের দ্বার খুলে যায়। ইন্টার উইং–ব্যাকের ক্রস থেকে গোল করেন সেন্টার ফরোয়ার্ডের ভূমিকা নেওয়া ফ্রান্সেসকো আচেরবি। স্কোরলাইন ৩–৩, দুই লেগ মিলিয়ে যেটা ৬–৬ এবং নিরপেক্ষ দর্শকদের মনের ইচ্ছা পূরণ করে ম্যাচটি গড়ায় অতিরিক্ত আরও আধা ঘণ্টায়। দ্বিতীয়ার্ধে ইন্টারের খেলোয়াড়দের খেলা দেখে মনে হয়েছে, বার্সাকে বিদায় করা, সম্ভব এটা তারা ভাবতে পারেনি—শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোয় খেলোয়াড়দের এ জায়গাটায় মাফ করে দিতে পারেন ‘নেরাজ্জুরি’ সমর্থকেরা।
দুই বদলি মেহদি তারেমি ও ফ্রাত্তেসির সমন্বয়ে ইন্টারের পাওয়া এই জয় আসলে ব্যাখ্যাতীত। বাকিটা সেরেছেন গোলকিপার ইয়ান সমার। সান সিরোয় যে হাতে তিনি লামিনে ইয়ামাল–রাফিনিয়াদের একের পর এক শট ঠেকালেন, কে জানে মিউনিখে ওই হাতেই হয়তো শিরোপা উঠতে পারে!
চ্যাম্পিয়নস লিগের ধ্রুপদি অধ্যায়ে এই ম্যাচ থাকবে যে পাতায়
চ্যাম্পিয়নস লিগে আসলে চমকের শেষ নেই। প্রতি মৌসুমেই ধারাবাহিকভাবে এমন কিছু ম্যাচের জন্ম হয়। কাল রাতের ম্যাচটিও যেমন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। সময় যত গড়িয়েছে পেন্ডুলামের মতো দুলেছে ম্যাচের ভাগ্য। দুই লেগ মিলিয়ে এই পাগলাটে ২১০ মিনিটে একদম শেষ বাঁশি বাজার আগপর্যন্ত আসলে কিছুই নিশ্চিত ছিল না!
শুধু গোলের হিসাবেই এ ম্যাচ জায়গা করে নিয়েছে ধ্রুপদি লড়াইয়ের তালিকায়। ১৩ গোলের (দুই লেগ মিলিয়ে) এ লড়াইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে শুধু ২০১৮ সালে রোমার বিপক্ষে সেমিফাইনালে লিভারপুলের ৭–৬ গোলের জয় এবং ২০০৯ সালে স্পোর্টিং লিসবনের বিপক্ষে শেষ ষোলোয় বায়ার্ন মিউনিখের ১২–১ গোলের জয়। কিন্তু উত্তেজনা, চাপ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিচারে আগের সে দুটি ম্যাচ সান সিরো ‘ক্লাসিক’–এর ধারেকাছেও নেই।
চ্যাম্পিয়নস লিগে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানো আগেও দেখা গেছে। এই বার্সার বিপক্ষেই তিন গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়া থেকে ৪–০ গোলে জিতেছে লিভারপুল। আবার এই বার্সাই ২০১৭ সালে ৪–০ গোলের হার থেকে পিএসজির বিপক্ষে ফিরতি লেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতেছে ৬–১। ২০০৫ সালে লিভারপুলের ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুল’ প্রায় সবারই জানা। কিংবা ১৯৯৯ সালের ফাইনালে বায়ার্নের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও ইউনাইটেডের ঘুরে দাঁড়ানো। মজার বিষয় হচ্ছে, এতগুলো অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলা হলো, যেখানে চ্যাম্পিয়নস লিগের ‘কামব্যাক কিং’ রিয়াল মাদ্রিদের কিছুই বলা হয়নি! ইন্টার মিলানের কাল রাতের জয়টি ধ্রুপদি এসব ম্যাচের কাতারেই থাকবে।
ডামফ্রিেসের দুই গোল, তিন অ্যাসিস্ট
পেনাল্টি বক্সে উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ দেখা যায় সেন্টার ফরোয়ার্ডদের কাছ থেকে। ডামফ্রিস ফরোয়ার্ড নন, উইং–ব্যাক। কিন্তু বার্সার বিপক্ষে দুই লেগে এই ডাচ তারকার কাছ থেকে এমন কিছু নিয়মিতই দেখা গেছে। রক্ষণ থেকে কখনো দৌড়ে ঢুকেছেন বার্সার বক্সে অথবা ডিফেন্সচেরা পাসে ভেঙেছেন কাতালানদের রক্ষণ।
সেমিফাইনালের দুই লেগ মিলিয়ে ডামফ্রিেসের অবদান মোট পাঁচ গোলে। উইং–ব্যাকদের কাছ থেকে এতগুলো গোলে অবদান সাধারণত দেখা যায় না। সে জন্য থাকতে হয় রোমাঞ্চকর মানসিকতা, মাঠের ডান প্রান্তে ডামফ্রিেসের যেটা আছে।
গতিময় ও শক্তিশালী হওয়ায় ডান প্রান্তে ডামফ্রিসকে থামানোও কঠিন। ৩–৩ গোলে ড্র হওয়া প্রথম লেগ স্মরণ করুন। সুযোগ পেলেই ওপরে উঠেছেন আর সেটা না পেলে কোনাকুনি পাসে বার্সার হাইলাইন ডিফেন্সের রক্ষণফাঁদ ভাঙার চেষ্টা করেছেন। ফিরতি লেগে তাঁকে নিঃস্বার্থ হিসেবেও দেখা গেল। লাওতারো মার্তিনেজকে দিয়ে করানো প্রথম গোলটি স্মরণ করুন। নিজেই গোল করতে পারতেন, কিন্তু মার্তিনেজ আরও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় তাঁকে দিয়ে করিয়েছেন। অথচ প্রতিপক্ষের বক্স ডামফ্রিেসের কাছে অচেনা ভুবন। এ মৌসুমে লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সে বলই স্পর্শ করেছেন মাত্র ১৩৫ বার!
পেনাল্টি কি ছিল
প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে লাওতারো মার্তিনেজ বার্সার বক্সে ফাউলের শিকার হওয়ায় পেনাল্টি পায় ইন্টার, যেখান থেকে গোল করেন তুর্কি মিডফিল্ডার হাকান চালহানোলু। মাঠের রেফারি ইন্টারের পেনাল্টি আবেদন নাকচ করে দিলেও ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভিএআর) কিছুক্ষণ পর স্পটকিকের রায় দেয়। ফুটবলে ভিএআর কত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা এ মুহূর্তে বোঝা গেছে।
শুরুতে দেখে মনে হয়েছে, বার্সা ডিফেন্ডার পাউ কুবারাসি দারুণভাবে ইন্টার স্ট্রাইকার মার্তিনেজকে ট্যাকল করেছেন। কিন্তু স্লো মোশন রিপ্লেতে ভালোভাবে দেখে বোঝা গেছে, কুবারাসি বলে নয়, মার্তিনেজের ডান পায়ে আঘাত করেছেন। ভিএআর মনিটরে দৃশ্যটি দেখার পর নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করেননি পোলিশ রেফারি সিমোন মার্চিনিয়াক। বার্সার খেলোয়াড়েরা মাঠেই এ নিয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। মার্চিনিয়াক একটু সময় নিয়ে আসল ঘটনা বার্সার ইনিগো মার্তিনেজকে বুঝিয়ে বলেন।
ফিফা ও প্রিমিয়ার লিগের সাবেক অফিশিয়াল মার্ক ক্লাটেনবার্গ আমাজন প্রাইমকে বলেছেন, ‘ভিএআর এ জায়গাতেই ফুটবলকে পাল্টে ফেলেছে, আর এসব বিষয়েই অনেক বেশি বিতর্ক হয়।’ আসল বিষয় হলো, ওই মুহূর্তের স্লো মোশন ফুটেজ দেখার পর ভিএআরের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। পরিষ্কার পেনাল্টি।
ইয়ামালকে যেভাবে থামাল ইন্টার
ইন্টারের সেন্টারব্যাক আলেসান্দ্রো বাস্তোনি বলেছিলেন, প্রথম লেগের আগে লামিনে ইয়ামালকে নিয়ে প্রচুর ভিডিও বিশ্লেষণ দেখলেও মাঠে আসলে তা কাজে আসেনি। কারণ, পর্দায় বিশ্লেষণ দেখা এক বিষয় আর মাঠে মুখোমুখি হওয়া অন্য বিষয়। প্রথম লেগের এক সপ্তাহ পর ইন্টার অবশ্য সফল। ফিরতি লেগে তারা বার্সার সেরা খেলোয়াড়কে আটকে রাখতে পেরেছে প্রথম লেগে মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে।
কিন্তু সে জন্য এটা মনে করার কারণ নেই, ১৭ বছর বয়সী ইয়ামাল ফিরতি লেগে বল পায়ে ইচ্ছেমতো ছুটতে পারেননি। বেশ ভালো কিছু সুযোগ তৈরি করেছেন। প্রথমার্ধে দানি ওলমো তাঁর তৈরি করা সুযোগ নষ্ট করেছেন। ইয়ামাল নিজেও একপর্যায়ে বক্সে ঢুকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেন—শট নেবেন না পাস দেবেন!
বাস্তোনিও বক্সে বেশ কয়েকবার আটকে দেন ইয়ামালকে। একবার তো বিপদ বুঝে বক্সের একটু বাইরে ফাউলও করেছেন ইয়ামালকে। রেফারি মার্চিনিয়াক পেনাল্টির বাঁশি বাজালেও ভিএআর ভুল শুধরে দেওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ইন্টার। কিন্তু ইতালিয়ান ক্লাবটির রক্ষণকে ঠিকই তটস্থ রেখেছিলেন ইয়ামাল। পার্থক্য একটাই, ইয়ামালকে গোল করতে কিংবা করাতে দেয়নি ইন্টারের রক্ষণ। সেটাই তো অনেক কিছু!
বার্সার অপ্রত্যাশিত নায়ক
রাতটা বার্সার ‘আনসাং নায়ক’দের—আরও খোলাসা করে বললে আনসাং ফুলব্যাকদের। জেরার্দ মার্তিন ও এরিক গার্সিয়া। জুলস কুন্দে ও আলেহান্দ্রো বালদের অনুপস্থিতিতে সুযোগ পেয়ে ২–০ গোলে পিছিয়ে পড়া বার্সাকে পথে ফিরিয়েছেন তাঁরা। ৫৪ মিনিটে গার্সিয়াকে দিয়ে গোল করিয়েছেন মার্তিন। ৬ মিনিট পর দারুণ এক ক্রসে ওলমোকে দিয়েও গোল করান। প্রথম লেগে বাজে খেলায় এই মার্তিনকেই তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সান সিরোয় তাঁর খেলা দেখে মনে হয়েছে, পরিষ্কার মাথা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। কী করতে হবে জানেন।
ইন্টার যা বলছে
শেষ বাঁশি বাজার পর সিবিএসকে ফ্রাত্তেসি বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা বেরিয়ে আসবে। এমন ম্যাচ আর কখনো হবে না। পাগলাটে রাত। ভবিষ্যতে এই ম্যাচের গল্প বলব বাচ্চাদের। তৃতীয় গোল হজমের পর মার্কাস থুরামকে বলছিলাম, আমরা ফাইনালে উঠব। জানি না এরপর আমরা কীভাবে গোল করলাম।’
ইন্টার কোচ সিমোন ইনজাগি উয়েফাকে বলেছেন, ‘আমাদের কিছু সমস্যা ছিল। কিন্তু হৃদয় দিয়ে সেসব উতরে গেছি। প্রথম লেগের পর আমাদের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সবাই মিলে ত্যাগ স্বীকার না করলে এটা হতো না—ছেলেরা ভালো খেলেছে, তারা ফাইনালের যোগ্য।’
বার্সা যা বলছে
সংবাদ সম্মেলনে বার্সা কোচ হান্সি ফ্লিক বলেছেন, ‘খেলোয়াড় ও দলের সম্মান প্রাপ্য। আমরা শিরোপা জিততে চাই। লিগ জিততে চাই। আমরা রোববার (রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে) এটা খেলব এবং সে জন্য তিন দিন সময় আছে। আমরা যখন ফিরব, আয়নায় তাকিয়ে খেলোয়াড়েরা যেন গর্ব অনুভব করে। চক্রটা শুরু হয়েছে, কিন্তু আমরা এখনো সেরাটায় পৌঁছাতে পারিনি। খেলোয়াড়দের এই বার্তাটাই দিতে চাই।’