২০২৬ বিশ্বকাপ: মেসি-রোনালদো-নেইমার, কে থাকবেন কে থাকবেন না
২০২২ কাতার বিশ্বকাপের আগেও আলোচনা ছিল এ নিয়ে। তখনো চলছিল জাতীয় দলের জার্সিতে লিওনেল মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর এপিটাফ লেখা। বয়সে পিছিয়ে থাকায় বাকি দুজনের মতো না হলেও চোটের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক পাতানো নেইমারও ছিলেন এ আলোচনায়।
মনে করা হয়েছিল, কাতার বিশ্বকাপ শেষেই হয়তো জাতীয় দলের জার্সিটা তুলে রাখবেন তাঁরা তিনজন। সেই বিশ্বকাপের আগেই মেসি বলে দিলেন, বিশ্বকাপে ব্যর্থতা মানে সেখানেই ইতি। নিজেরা কিছু না বললেও রোনালদো-নেইমারের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনার ধারাটা ছিল এমনই।
এরপর যথারীতি শেষ হলো বিশ্বকাপ। ৩৬ বছর পর মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনা জিতল বিশ্বকাপ। অমরত্বকে আলিঙ্গনের পর ট্রফি নিয়ে উদ্যাপন করতে করতে মেসি ফিরে গেলেন বুয়েনস এইরেসে। আর্জেন্টাইনদের হর্ষধ্বনিতেই বাতাসে মিলিয়ে গেল মেসির অবসর-আলাপও। মেসির ঠিক উল্টো দিকে ছিল রোনালদো-নেইমারের অবস্থান। ব্যর্থতা নিয়ে কান্নাভেজা বিদায়ের পর হতাশাই তখন এই দুজনের সঙ্গী।
কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর কাছে হেরে রোনালদো যখন টানেল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, এটাকে বিশ্বমঞ্চে তাঁর বিদায়ী ছবি হিসেবেই দেখেছে ফুটবল–বিশ্ব। বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁর জন্য বিদায়-অর্ঘ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সবখানেই শেষটা রাঙাতে না পারার আক্ষেপ। রোনালদো অবশ্য নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মুখে কুলুপ দিয়ে রেখেছিলেন। আর শেষ আট থেকে বিদায়ের পর নেইমার বলেছিলেন, বিশ্বকাপ দূরের ব্যাপার, আর কখনো ব্রাজিলের হয়ে না–ও খেলতে পারেন তিনি।
ওপরের গল্পগুলো অবশ্য এখন দূর অতীতের। বিশ্বকাপের উত্তেজনা, সাফল্য-ব্যর্থতার তাৎক্ষণিক প্রভাব এবং বয়স—ছন্দের প্রভাব এসব আলাপে বেশ স্পষ্ট ছিল। ফলে জাতীয় দলের জার্সিতে এই তিনজনের ভাগ্য জানতে আরেকটু অপেক্ষা করতেই হচ্ছিল।
তবে এ মুহূর্তে, অর্থাৎ ২০২৬ বিশ্বকাপের এক বছর বাকি থাকতে তিনজনের বিশ্বকাপ-ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। অতীতে যাঁর যেমনই অবস্থান থাকুক, তাঁরা তিনজনই যে ২০২৬ বিশ্বকাপে চোখ রেখেছেন, বলাই যায়।
বয়স বিবেচনায় এই তিনজনের মধ্যে সম্ভাবনা কম ছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ২০২৬ সালের ১১ জুন যখন বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে, তখন রোনালদোর বয়স ৪১ বছর ৪ মাস ৬ দিন।
এই বয়সে রোনালদোর বিশ্বকাপে খেলাটা বড় ঘটনাই হবে। শেষ পর্যন্ত খেললে সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপ খেলাদের তালিকায় রোনালদোর অবস্থান হবে চতুর্থ। গোলরক্ষকদের হিসাব থেকে বাদ দিলে তাঁর অবস্থান থাকবে ২ নম্বরে। আর ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তিনিই হবেন সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার।
কাতার বিশ্বকাপের পর রোনালদো খেলার বাইরে ছিলেন মোট ৪১ দিন এবং মিস করেছেন মাত্র ১ ম্যাচ।
তবে রোনালদো নিশ্চিতভাবেই শুধু এমন একটি রেকর্ডের জন্য বিশ্বকাপ খেলতে যাবেন না। আরও বড় কিছুতে চোখ রেখেই যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকো বিশ্বকাপে জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে যাবেন ‘সিআর সেভেন’। সেই বড় কিছু যে বিশ্বকাপ শিরোপা, তা বোধ হয় আলাদা করে না বললেও চলে। বিশেষ করে কাতার বিশ্বকাপ জিতে শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে ইতি টানা মেসিকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ জানানোর এই সুযোগ নিশ্চিতভাবেই হাতছাড়া করতে চাইবেন না রোনালদো।
রোনালদোর ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার কথা উঠলে প্রাসঙ্গিকভাবে সবার আগে আসে ফিটনেসের আলাপ। ৪১ পেরোনো রোনালদো শারীরিকভাবে ফিট থাকবেন তো? এ প্রশ্ন শুনলে রোনালদো নিজেই হয়তো একটা মুচকি হেসে পাশ কেটে হেঁটে চলে যাবেন। বয়সের পাশাপাশি ফিটনেসেও তিনি বাকি দুজনের চেয়ে এগিয়ে। শুধু এগিয়ে বললে অবশ্য ভুল হবে। মেসি ও নেইমার আসলে রোনালদোর আশপাশেও নেই।
এমনকি ৪০ পেরোনো রোনালদো ফিটনেসে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন যেকোনো তরুণকেও। ট্রান্সফারমার্কেটের দেওয়া তথ্য বলছে, কাতার বিশ্বকাপের পর থেকে রোনালদো খেলার বাইরে ছিলেন তিনবার। যদিও কোনোবারই বড় কোনো চোট নয়। আর এ সময়ে পর্তুগিজ মহাতারকা খেলার বাইরে ছিলেন মোট ৪১ দিন এবং মিস করেছেন মাত্র ১ ম্যাচ। একজন তরুণ খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেও এই পরিসংখ্যান রীতিমতো অবিশ্বাস্য!
ফিটনেস নিয়ে রোনালদোর অতি সতর্কতার কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা অবশ্য এটা দেখে বিস্মিত হবেন না। নিজেকে ফিট রাখার জন্য একজন মানুষের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, সবটাই রোনালদো করেন। পাশাপাশি প্রকৃতিগতভাবেও রোনালদো কখনো চোটপ্রবণ ছিলেন না, এটিও রোনালদোর দীর্ঘ ক্যারিয়ারের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। এখন বাকি এক বছরে বড় কোনো অঘটন না ঘটলে পর্তুগালের জার্সিতে রোনালদোকে ষষ্ঠ বিশ্বকাপে খেলতে দেখা সময়ের ব্যাপারই বলা যায়।
কাতারেই বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরার স্বপ্ন পূরণ করেছেন মেসি। বিশ্বকাপ জেতার পর একাধিকবার বলেছেন, ফুটবল থেকে তাঁর আর কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। কিন্তু মেসিকে যত দিন সম্ভব খেলতে দেখার ইচ্ছা ভক্তদের। আরেকটি বিশ্বকাপে হলে তো কথাই নেই! আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড় ও কোচদের চাওয়াও মেসি ২০২৬ বিশ্বকাপ খেলুন। তাই কাতার জয়ের পর থেকেই মেসির ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে। মেসি নিজেও অবশ্য সে সম্ভাবনা কখনো উড়িয়ে দেননি।
তবে মেসির বিশ্বকাপ খেলার আলোচনায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে চোট প্রসঙ্গ। কাতার বিশ্বকাপের পর, অর্থাৎ ২০২৩ সাল থেকে হঠাৎ করেই যেন চোটপ্রবণ হয়ে পড়েন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। একের পর এক চোটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করেন ৮ বারের ব্যালন ডি’অরজয়ী ফুটবলার। ট্রান্সফারমার্কেটের দেওয়া হিসাবটাও বেশ হতাশাজনক। ২০২২ বিশ্বকাপের পর বিশ্রাম ছাড়া এখন পর্যন্ত ৭ দফা চোটে পড়েছেন মেসি। যেখানে সব মিলিয়ে মেসি মাঠের বাইরে ছিলেন ১৩০ দিন, আর ম্যাচ মিস করেছেন ২৭টি।
চোটপ্রবণতার কারণে বিশ্বকাপ সামনে রেখে মেসিকে বিশ্রাম দিয়ে খেলানো নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। এমনকি সামান্য চোট আশঙ্কাতেও বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তবে ইন্টার মায়ামির নতুন কোচ হাভিয়ের মাচেরানো মেসিকে সেভাবে বিশ্রাম দিচ্ছেন না। টানা ম্যাচ খেলানোর পাশাপাশি বেশির ভাগ সময় পুরো ম্যাচে মেসিকে মাঠে রাখছেন এই আর্জেন্টাইন কোচ।
২০২২ বিশ্বকাপের পর বিশ্রাম ছাড়া এখন পর্যন্ত ৭ দফা চোটে পড়েছেন মেসি। যেখানে সব মিলিয়ে মেসি মাঠের বাইরে ছিলেন ১৩০ দিন, আর ম্যাচ মিস করেছেন ২৭টি।
এর ফলে মেসির চোটে পড়ার আশঙ্কাও বেড়েছে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় বড় চোটে লম্বা সময়ের জন্য ছিটকে যেতে পারেন মেসি, যা শঙ্কায় ফেলতে পারে তাঁর পরবর্তী বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনাকেও। তাই বিশ্বকাপ মেসির রাডারে থাকলেও তাঁকে নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ইন্টার মায়ামি ও আর্জেন্টিনাকে। নয়তো সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাই যে জবাই হয়ে যেতে পারে।
নেইমারকে কেউ চাইলে এখন ‘ব্রাজিলের দুঃখ’ বা ‘ব্রাজিলের অশ্রু’ নামেও ডাকতে পারেন। রোনালদো নাজারিওর পরবর্তী সময়ে ব্রাজিলীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার নেইমার। অমিত সম্ভাবনা ও তুমুল প্রতিভা নিয়ে ফুটবলমঞ্চে আবির্ভাব নেইমারের।
পেলেকে ছাড়িয়ে ব্রাজিলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতাও এখন নেইমার। কিন্তু দলীয় সাফল্যে নেইমার এক হতাশার নাম। সর্বশেষ ২০২২ বিশ্বকাপেও ব্রাজিলের হতাশাজনক বিদায়ের সাক্ষী হয়েছেন নেইমার। তবে ২০২৬ বিশ্বকাপে শেষবার চেষ্টা করতে চান এই ফরোয়ার্ড। কিন্তু চোট শেষ পর্যন্ত নেইমারকে সেই চেষ্টা করতে দেবে তো?
চোটের ইতিহাস, পরিসংখ্যান এবং বর্তমান দশা বলছে, রোনালদো ও মেসির চেয়ে নেইমারেরই বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। কাতার বিশ্বকাপের পর নেইমারের চোটের পরিসংখ্যানও হতাশাজনক। ২০২২ বিশ্বকাপের পর ৮ দফায় চোটে পড়েছেন নেইমার।
কাতার বিশ্বকাপের পর নেইমার মাঠের বাইরে ছিলেন ৬৮২ দিন। যেখানে সব মিলিয়ে তিনি মিস করেছেন ৯৬ ম্যাচ।
যেখানে একবারে সর্বোচ্চ ৩৪০ দিন পর্যন্ত মাঠের বাইরে ছিলেন তিনি। সামগ্রিকভাবে এ সময়ে নেইমার মাঠের বাইরে ছিলেন ৬৮২ দিন। যেখানে সব মিলিয়ে তিনি মিস করেছেন ৯৬ ম্যাচ। ওহ্, নেইমার কিন্তু এখনো চোটের কারণে মাঠের বাইরেই আছেন। ফলে এই পরিসংখ্যান যে আরও খারাপ হতে যাচ্ছে, তা বলা যায়।
চোট সত্ত্বেও দুর্দশা কাটাতে ব্রাজিলিয়ানদের চোখ নেইমারের দিকেই। অনেকের বিশ্বাস, একমাত্র নেইমারই পারেন ব্রাজিলকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে। ২০২৬ বিশ্বকাপেও ব্রাজিলের ভালো কিছু করতে হলে ফিট নেইমারের দলে থাকার বিকল্প নেই। কিন্তু নেইমারের ফিট থাকাই যে একটা মিথ। সেই মিথ ভেঙে নেইমার কি আদৌ পারবেন ব্রাজিলের রক্ষাকর্তা হতে? উত্তরটা সময়ের হাতেই তোলা রইল।