লাওতারো রিভেরো: ফুটপাতের বিস্কুট বিক্রেতা থেকে আর্জেন্টিনা দলে মেসির সতীর্থ
বয়স এখনো ২১ হয়নি। কিন্তু এ অল্প বয়সেই জীবন যেন সব রং, সব স্বাদ দেখিয়ে দিয়েছে লাওতারো রিভেরোকে। গতকাল রাত পর্যন্তও আর্জেন্টিনার বাইরে তেমন কেউ চিনত না এ নামটি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন রিভেরো। তাঁকে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডেকেছেন কোচ লিওনেল স্কালোনি। আর দলে ডাক পাওয়ার পর সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে গেছে তাঁর জীবনের গল্পটা—সংগ্রাম, বঞ্চনা আর ফিরে আসার লড়াইয়ের গল্প।
কয়েক মাস আগেও ধারে খেলছিলেন সেন্ট্রাল কর্দোবার হয়ে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে রিভার প্লেট তাঁকে ফিরিয়ে নেয় দলে। এই সেন্টারব্যাক রিভেরোকে ফেরাতে তারা কার্যকর করে তাঁর বাই-আউট ক্লজ, যাতে তিনি ক্লাব বিশ্বকাপেও খেলতে পারেন।
সেই সুযোগে এখন তিনি রিভার প্লেটের রক্ষণের নির্ভরযোগ্য মুখ। আর আন্তর্জাতিক বিরতিতে আর্জেন্টিনার হয়ে ভেনেজুয়েলা ও পুয়ের্তো রিকোর বিপক্ষে খেলার ডাকও পেয়েছেন। তবে তাঁর সাফল্যের এই অধ্যায়ের আগে আছে এক কঠিন, কণ্টকাকীর্ণ পথচলা। কয়েক বছর আগেও তাঁর বাস্তবতা ছিল একেবারে অন্য রকম।
আরও অনেক আর্জেন্টাইন ফুটবলারের মতোই দারিদ্র্যের মধ্যেই কেটেছে রিভেরোর শৈশব। পাঁচ ভাই-বোনের সংসারে প্রতিদিনই ছিল টানাপোড়েন। ঘরে খাবার জোগাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলফাখোরস (একধরনের মিষ্টি জাতীয় বিস্কুট) বিক্রি করতেন তিনি। শুধু নিজের পেটের দায়ে নয়, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতেও।
২০২২ সালে রিভার প্লেটের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে নিজের সেই দিনগুলোর কথা বলেছিলেন রিভেরো, ‘আমরা খুব সাধারণ ও পরিশ্রমী পরিবার। আমার প্রথম লক্ষ্য সব সময় ছিল, পরিবার যেন ভালো থাকে—মা-বাবা আর ভাইবোনেরা যেন কিছুতে কষ্ট না পায়। তাদের জন্যই আমি এখানে। কঠিন সময় পার করতে হয়েছে, কিন্তু ওরাই আমাকে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে।’
দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে লড়তেও ফুটবলকে ধরে রেখেছেন শক্ত করে। বাড়ির পাশের ক্লাব লস আলকোনেসে তাঁর ফুটবলে হাতেখড়ি। এরপর খেলেছেন ভিলা লুরো নর্তে ও লা ভিক্টোরিয়ায়। সেখান থেকে ১৪ বছর বয়সে পৌঁছে যান রিভার প্লেটে।
শুরুতে তিনি ছিলেন মিডফিল্ডার। কিন্তু ১.৮৫ মিটার উচ্চতার কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁকে নামানো হয় ডিফেন্সে। সেখানেও নজর কাড়েন দ্রুত। বয়সভিত্তিক দলে ছিলেন অধিনায়ক। ২০২১ সালে ওঠেন রিজার্ভ দলে। ২০২৩ সালের শেষে যখন তিনি ফ্রি এজেন্ট হতে যাচ্ছিলেন, তখনই সই করেন প্রথম পেশাদার চুক্তিতে।
এরপর ২০২৪ সালে ধারে যান সেন্ট্রাল কর্দোবাতে। জুনে তায়েরেসের বিপক্ষে হয় তাঁর পেশাদার অভিষেক। শুরুতে কোচ লুকাস গনসালেস ভেলেজ প্রায় নিয়মিত তাঁকে খেলালেও পরের কোচ ওমর দে ফিলিপ আসার পর বেঞ্চে চলে যেতে হয়। কোপা আর্জেন্টিনার ফাইনালেও সুযোগ পাননি। কিন্তু ভাগ্য ঘুরে দাঁড়ায় যখন সেবাস্তিয়ান ভালদেজ ও জনাথন রাক দল ছাড়েন। তখনই সুযোগ পান রিভেরো, আর সেই সুযোগ কাজে লাগান দারুণভাবে।
২০২৫ সালেই তিনি হয়ে ওঠেন কর্দোবার অন্যতম সেরা সেন্টারব্যাক। মারাকানায় ফ্লামেঙ্গোর বিপক্ষে কর্দোবার ঐতিহাসিক ২-১ জয়ে অসাধারণ খেলেন—যে ম্যাচটি বদলে দেয় তাঁর ক্যারিয়ারের গতিপথ।
রিভার প্লেটে ফিরে মার্সেলো গালার্দোর অধীনে হয়ে রিভেরো উঠেছেন রক্ষণের ভরসা। সম্প্রতি রেসিংয়ের বিপক্ষে কোপা আর্জেন্টিনা ম্যাচেও দুর্দান্ত খেলেছেন। রেসিংয়ের আক্রমণভাগের বিপজ্জনক ফরোয়ার্ড মারাভিয়া মার্তিনেসকে পুরো ম্যাচে কার্যত অচল করে রাখেন। রিভার প্লেট সমর্থকেরাও এখন মুগ্ধ তাঁর দৃঢ়তা ও লড়াকু মানসিকতায়।
এমন এক তরুণ, যার জীবনের শুরুটা হয়েছিল সিগন্যালের পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টি বিক্রি করে—এখন সেই রিভেরোই মাঠে নামবেন লিওনেল মেসি ও তাঁর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সতীর্থদের পাশে।
ফুটবল কখনো কখনো সত্যিই রূপকথার চেয়েও সুন্দর গল্প লিখে দেয়।