আর্জেন্টিনা দলে নতুন ম্যাক আলিস্টার-আলভারেজ-ফার্নান্দেজের খোঁজে স্কালোনি
অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার, হুলিয়ান আলভারেজ ও এনজো ফার্নান্দেজ।
ক্লদিও এচেভেরি, ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুয়োনো ও ম্যানুয়াল লোপেজ।
২০২২ সালের ১১ নভেম্বর। কাতার বিশ্বকাপ সামনে রেখে আর্জেন্টিনা দল ঘোষণা করেন লিওনেল স্কালোনি। সেদিন দল ঘোষণার পর আলোচনায় ছিল চোট নিয়েও পাওলো দিবালা ও আনহেল দি মারিয়ার দলে থাকা।
মাওরো ইকার্দির না থাকা অনুমেয় হলেও অনেকে বেদনাহত হয়েছিলেন চোটের কারণে জিওভানি লো সেলসো ছিটকে যাওয়ায়। এই পরিচিত তারকাদের নিয়ে আলোচনার মধ্যে ম্যাক অ্যালিস্টার, আলভারেজ ও ফার্নান্দেজকে নিয়ে কথা খুব সামান্যই হয়েছে। ‘প্রতিভাবান তরুণ’ বিশেষণ যুক্ত করেই সারা হয় এই তিনজনকে নিয়ে আলাপ।
তখন পর্যন্ত অবশ্য এই তিনজনকে নিয়ে আলাপ করার জন্য খুব বেশি কিছু ছিলও না। ২২ বছর বয়সী হুলিয়ান আলভারেজ তখনই কেবল রিভার প্লেট থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে নাম লিখিয়েছেন। হুটহাট মাঠে নেমে আলো ছড়ালেও তা একেবারেই বিস্তারিত আলোচনার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
২১ বছর বয়সী এনজো ফার্নান্দেজ তখন ছিলেন বেনফিকায়। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের বাইরে থাকা ফার্নান্দেজের ওপর আলোটা কম থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। ফলে খুব একটা আলোচনা হয়নি তাঁকে নিয়েও। একই কথা বলা যায় ২৩ বছর বয়সী ম্যাক অ্যালিস্টারকে নিয়েও। ব্রাইটনের হয়ে তত দিনে আলো ছড়িয়েছেন বটে, কিন্তু বিশ্বকাপের সম্ভাব্য বড় তারকা বিবেচনা করার মতো নয়।
সে সময় লিওনেল মেসিকে বাদ দিলে আর্জেন্টিনার হয়ে যাঁদের ওপর চোখ রাখতে বলা হচ্ছিল, তাঁরা ছিলেন দি মারিয়া, লাওতারো মার্তিনেজ, দিবালা ও রদ্রিগো দি পল। নিজেদের সময়ের অন্যতম সেরা এই তারকারাই ছিলেন আর্জেন্টিনা দলের নিউক্লিয়াস। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর পর বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ওই যে বলা হয়, হাতির খাওয়ার দাঁত এক, দেখানোর আর এক। সেই নিয়ম মেনেই যেন চমক দেন স্কালোনি।
টুর্নামেন্টে যতই বেলা গড়িয়েছে, আর্জেন্টিনার মাঝমাঠে নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন ম্যাক অ্যালিস্টার ও ফার্নান্দেজ। ফার্নান্দেজ তো পরে টুর্নামেন্টের সেরা তরুণ ফুটবলারের পুরস্কারও নিজের করে নিয়েছেন। আর দলের সেরা স্ট্রাইকার লাওতারোর কাছ থেকে জায়গা কেড়ে নেন আলভারেজ। এরপর বিশ্বকাপ শেষ হতেই রাতারাতি তিনজন হয়ে ওঠেন বৈশ্বিক তারকা।
বিশ্বকাপের পর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই ত্রয়ীকে। ম্যাক অ্যালিস্টার ব্রাইটন ছেড়ে লিভারপুলে এসে জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগ। এনজো ফার্নান্দেজ প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে দামি ফুটবলার হিসেবে চেলসির মাঝমাঠ সামলে জিতেছেন ক্লাব বিশ্বকাপ। আর আলভারেজ সিটিতে সম্ভাব্য সবকিছু জেতার পর এখন আতলেতিকো মাদ্রিদের প্রাণভোমরার দায়িত্ব পালন করছেন।
কাতার বিশ্বকাপের আগে খুব একটা আলোচনায় না থাকলেও একজন মানুষের সবকিছু নখদর্পণে ছিল। তিনি ছিলেন কোচ লিওনেল স্কালোনি। তাঁর পরিকল্পনায় এই তিনজন ছিলেন আস্তিনে লুকোনো তাস। প্রয়োজনের সময় যাঁদের সামনে এনে পাশার দানই বদলে দিয়েছেন আর্জেন্টাইন এই কোচ।
প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২৬ বিশ্বকাপেও কি একই কৌশল নিয়ে হাজির হবেন স্কালোনি? আবারও কি আস্তিনে লুকোনো নতুন তাস দিয়ে বদলে দেবেন দৃশ্যপট? উত্তরটা হয়তো এখনই জানা যাবে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে স্কালোনির ঘোষিত দল তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বকাপ বাছাইয়ের জন্য ঘোষিত দলে চমক দেখিয়েছেন আর্জেন্টাইন এই কোচ।
যেখানে তরুণ মুখ হিসেবে দেখা যাচ্ছে ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুয়োনো, ক্লদিও এচেভেরি ও হোসে ম্যানুয়াল লোপেজকে। তাঁদের মধ্যে মাস্তানতুয়োনোর রেকর্ড গড়া অভিষেক হলেও অন্যরা এখনো আছেন সুযোগের অপেক্ষায়। এই তিনজন ছাড়াও অন্যদের মধ্যে হুলিও সোলের, অ্যালেন ভারেলা ও ভ্যালেন্তিন কার্বোনিও আছেন তালিকায়। এখন তাঁদের মধ্যে কেউ ২০২৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার নতুন তারকা হিসেবে আবির্ভূত হন কি না, সেদিকেই চোখ থাকবে সবার।
এই মাসেই ১৮তম জন্মদিন পালন করা মাস্তানতুয়োনোকে বিবেচনা করা হচ্ছে আর্জেন্টাইন ফুটবলের ভবিষ্যৎ হিসেবে। প্রতিভার ঝলক দেখিয়েই রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়েছেন তিনি। দুর্দান্ত ড্রিবলে প্রতিপক্ষকে নাকানি–চুবানি খাওয়ানো, উইং ধরে আগ্রাসী রূপে আক্রমণে যাওয়া কিংবা নিখুঁত ফ্রি–কিকে গোলরক্ষককে বোকা বানানোর দারুণ সামর্থ্য আছে বাঁ পায়ের এই ফুটবলারের। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দল অবশ্য তাঁর জন্য এখনো অনেক দূরের পথ।
সেই পথ মসৃণ হবে যদি আর্জেন্টিনা জাতীয় দল এবং রিয়াল মাদ্রিদে পাওয়া সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারেন। বিশ্বকাপের এখনো এক বছরের কম সময় বাকি। এমন পরিস্থিতিতে সদ্য শুরু হওয়া মৌসুমটা মাস্তানতুয়োনোর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যেই স্কালোনির আস্থা অর্জন করতে হবে তাঁকে। যদি সেটি করতে পারেন, তবে আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডা বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন-চমক হিসেবে দেখা যেতে পারে তাঁকে।
বয়সভিত্তিক ফুটবলে অনেক দিন ধরেই আলোচনায় ছিলেন এচেভেরি। তাঁর মাঝে একই সঙ্গে মেসি ও ম্যারাডোনার মিশ্রণও দেখেছেন অনেকে। এমন ফুটবলারের ওপর স্বাভাবিকভাবেই চোখ ছিল ইউরোপিয়ান শীর্ষ ক্লাবগুলোর। পরবর্তী সময়ে তাঁকে কিনেও নিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। মাস্তাতুয়োনোর মতো তাঁকেও অবশ্য কঠিন পথ অতিক্রম করেই জায়গা পেতে হবে বিশ্বকাপ দলে। প্রতিটা সুযোগই তাই এখন অমূল্য। লুফে নিতে না পারলে শেষ পর্যন্ত দর্শক হয়েই হয়তো থাকতে হবে।
৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার ফরোয়ার্ড লোপেজের সুযোগ পাওয়া অবশ্য আকস্মিক। শেষ পর্যন্ত বাছাইয়ের মূল দলে জায়গা পাবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। কিন্তু পেলে দারুণ কিছু করে নিজের জায়গা পাকা করার সুযোগ আছে তাঁর। সাম্প্রতিক সময়ে পালমেইরাসের হয়ে দারুণভাবে আলো ছড়িয়েছেন লোপেজ। চলতি মৌসুমে ক্লাবটির হয়ে করেছেন ৪২ ম্যাচে ১৫ গোল। ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ হিসেবে স্কালোনি তাঁর ওপর আস্থা রাখলে বদলে যেতে পারে ভাগ্যও।
অন্যদের মধ্যে সোলের, কার্বোনি ও ভারেলা অনেক দিন ধরেই জাতীয় দলের আশপাশে আছেন। নাটকীয় কিছু না হলে এখনই জাতীয় দলের দরজা হয়তো খুলছে না তাঁদের জন্য। তবে স্কালোনির মন বলে কথা! কখন, কাকে, কীভাবে যে চমক হিসেবে হাজির করেন, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।