বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের ভ্রমণ ১০৯৪ মাইল, আর্জেন্টিনার ৪৬১ মাইল
আর মাত্র ছয় মাস বাকি। শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপের সময় গণনা। ২০২৬ সালের ১১ জুন শুরু হবে ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ মাসের ৫ তারিখে হয়ে গেছে বিশ্বকাপের ড্র, চূড়ান্ত হয়েছে সূচিও। আয়োজক আর অংশ নিতে যাওয়া দলগুলোর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে এখন।
বিশ্বকাপ হচ্ছে তিন দেশে—যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে। মাঠের ট্যাকটিকস আর টেকনিকের পাশাপাশি তাই দলগুলোকে ভাবতে হচ্ছে লম্বা ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ নিয়েও।
কারণ, অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে শত শত, কখনো আবার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। সব মিলিয়ে দলগুলোর ভ্রমণ পরিকল্পনা করা মোটেও সহজ নয়। ২০২২ বিশ্বকাপ হয়েছিল কাতারে। ভেন্যুগুলো ছিল কাছাকাছি। দলগুলোকে ভ্রমণে মোটেই বেগ পেতে হয়নি।
২০২৬ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ভ্রমণ একনজরে
বিশ্বকাপের তিন আয়োজক গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলো নিজেদের দেশেই খেলবে। তবে একেক দেশে এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুর দূরত্বের বেশ পার্থক্য আছে। সেদিক থেকে মেক্সিকোর ভ্রমণই তুলনামূলক স্বস্তিকর।
গ্রুপ পর্বে তারা খেলবে দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও উয়েফার প্লে-অফ জয়ীর (ডেনমার্ক, উত্তর মেসিডোনিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র বা আয়ারল্যান্ড) বিপক্ষে। তিনটি ম্যাচের ভেন্যুই মেক্সিকোতে—দুটি মেক্সিকো সিটিতে, অন্যটি গুয়াদালহারায়।
কানাডা গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচের দুটি খেলবে ভ্যাঙ্কুভারে, কাতার ও সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে। আর উয়েফা প্লে-অফ জয়ীর (ইতালি, নর্দান আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস বা বসনিয়া-হার্জেগোভিনা) বিপক্ষে ম্যাচ টরন্টোয়। যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের গ্রুপ পর্বের ম্যাচের জন্য যেতে হবে সিয়াটল আর লস অ্যাঞ্জেলেসে। তাদের প্রতিপক্ষ প্যারাগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও উয়েফার প্লে-অফ জয়ী (তুরস্ক, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া বা কসোভো)। তিন স্বাগতিকের মধ্যে ভেন্যুর দূরত্ব বিবেচনায় কানাডাকেই বেশি পথ ভ্রমণ করতে হবে।
শিরোপাপ্রত্যাশী দলগুলোর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হবে আলাদা। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে খুব বেশি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে না। তাদের গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচ যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস ও কানসাস সিটিতে। ২০২২ বিশ্বকাপের রানার্সআপ ফ্রান্সও গ্রুপ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকবে। ফেবারিটদের মধ্যে ইংল্যান্ডকে অবশ্য একটু বেশিই ভ্রমণ করতে হবে। ক্রোয়েশিয়া, ঘানা ও পানামার বিপক্ষে তাদের ম্যাচ ম্যাসাচুসেটস আর টেক্সাসে।
কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে সব দল মিলিয়ে গড়ে মাত্র ৮৬ মাইল ভ্রমণ করেছিল, এবার তা ৫ হাজার ১৬৭ মাইল। এরপরও অবশ্য ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের চেয়ে দলগুলোর ভ্রমণ কম হবে, সেবার গড়ে গ্রুপ পর্বে দলগুলোকে ৭ হাজার ৫৪ মাইল ভ্রমণ করতে হয়েছিল।
এবার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করতে হবে উয়েফা উইনার প্লে-অফের ইতালি, ওয়েলস, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও নর্দান আয়ারল্যান্ডের লড়াইয়ে জেতা দলকে—৩ হাজার ১৪৪ মাইল। প্লে-অফ ডি (ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্র, নর্দান আয়ারল্যান্ড, নর্থ মেসিডোনিয়া) জেতা দলকে পাড়ি দিতে হবে ২ হাজার ৮১১ মাইল ও আলজেরিয়াকে ভ্রমণ করতে হবে ২ হাজার ৯৭২ মাইল। কানাডা, বেলজিয়াম, কেপ ভার্দে, উয়েফা উইনার প্লে-অফ এ, ইকুয়েডরসহ বেশ কয়েকটি দলকে পাড়ি দিতে হবে দেড় থেকে দুই হাজার মাইলের বেশি।
দীর্ঘ ভ্রমণের প্রভাব
কারও স্নাতকোত্তর গবেষণা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানে, কেউ ডুব দেন দর্শন বা রসায়নে। সান ডিয়েগো এফসির হেড অব হিউম্যান পারফরম্যান্সের প্রধান লুক জেনকিনসন বলেন, ‘আমার পিএইচডি হচ্ছে উত্তর আমেরিকার ফুটবলে ভ্রমণের প্রভাব নিয়ে।’
স্পোর্টস সায়েন্সেস জার্নালের রিভিউয়ে থাকা তাঁর গবেষণা দেখায় লম্বা ভ্রমণে কী কী ঘটে। ৯০ মিনিটের ম্যাচের যেমন নিজস্ব ছন্দ আছে, তেমনি সূক্ষ্মভাবে প্রস্তুত খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ছন্দও ভ্রমণ ক্লান্তিতে বদলে যায়। ঘুমের ব্যাঘাতের সঙ্গে কিন্তু খাবার হজমের ক্ষমতাও এতে বদলে যায়। তিনি বলেছেন, ‘হজমের সমস্যা বাড়ার শঙ্কা থাকে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি অস্বস্তিকর। এতে পুষ্টি, বিশেষত কার্বোহাইড্রেট শোষণে সমস্যা হয়, সঙ্গে থাকে পানিশূন্যতার ঝুঁকি।’
পুষ্টির ঘাটতি, ক্লান্তি আর হজমজনিত বিরক্তিকর অবস্থা সামলে নিতে না পারলে ফল খুব একটা ভালো হয় না। ভ্যাঙ্কুভার হোয়াইটক্যাপসের ফিজিক্যাল প্রস্তুতি বিভাগের প্রধান জন পোলি বলেছেন, ‘অনেকবার দেখা যায়, লম্বা সফরে আর পর্যাপ্ত রিকভারি না থাকায় মাংসপেশির চোটে পড়ার আশঙ্কা বেশি।’
মানসিক লড়াই
সবশেষ অস্ত্র? মানসিক দৃঢ়তা। প্যাসিফিক এফসির মেরিমান বলেছেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিকতা…বিষয়টাকে খুব বড় করে না দেখা। খেলোয়াড়েরা যদি ক্লান্তির কথা ভাবতে থাকেন, তাহলে সত্যিই তা অনুভব করবেন।’
আর ইয়র্গেনসনের বার্তা—এটি সুযোগ, বোঝা নয়, ‘ভিন্ন দেশ ঘোরা সৌভাগ্যের। রিকভারি ঠিক ততটাই মানসিক, যতটা শারীরিক। ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে শুরু করো, হাইড্রেটেড থাকো, যা করার সব করো এবং হাসিমুখে উপভোগ করো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞকে।’
হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেওয়ার পর, দেখা যাবে কার মুখে উপভোগের সেই হাসি।