সাবিনাদের বিদ্রোহের মধ্যেও কাকভোরে বাটলারের অনুশীলনে ৩৩ জন
ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ফটকটা পুরোই খোলা। সেটির পথ ধরে একটু ভেতরে এগোতেই স্টেডিয়াম চত্বর অচেনা লাগে।
দিনের তুমুল ব্যস্ত এলাকায় সুনসান নীরবতা। দোকানপাট সব বন্ধ। ছিন্নমূল মানুষেরা ঘুমিয়ে এখানে-সেখানে। বাতি জ্বলছে কোথাও কোথাও। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজে নেমে পড়েছেন। নতুন একটা দিন শুরুর আগমনী বার্তা পাওয়া যাচ্ছে।
খানিক আলো-আঁধারির মধ্যে একটা বাস এসে থামে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকে। একে একে একদল মেয়ে বাস থেকে নেমে স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকে যান। বাসের গায়ে ‘বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন’ লেখা। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, নারী ফুটবলাররা এসে পড়েছেন অনুশীলনের জন্য। ঘড়িতে তখন ঠিক ভোর ৬টা ১০ মিনিট। পূব আকাশে সূর্য স্বাগত জানাতে তখনো ২৭ মিনিট বাকি।
কোচ পিটার বাটলার কোন ফাঁকে স্টেডিয়ামে ঢুকে গেছেন, টের পাওয়া গেল না। তাঁকে মাঠে আবিষ্কার করা গেল খানিক বাদে। সেটাও অভিনব উপায়ে। স্টেডিয়ামের ফটকে থাকা দুই সেনাসদস্য বলে দিলেন, ভেতরে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষেধ। কড়া নির্দেশ আছে। কিন্তু এত বড় স্টেডিয়ামে অনুশীলন দেখার ফাঁকফোকরের অভাব নেই।
সৌভাগ্যক্রমে স্টেডিয়ামের তৃতীয় তলায় এক ফেডারেশন অফিস খোলা পাওয়া গেল এই ভোরেও। অফিসকর্মীর ঘুম ভেঙেছে। দরজা খুলে রেখেছেন। সেই ফেডারেশনে বসে খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে চোখ যায় মাঠে। প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিকও সেখান থেকেই ক্যামেরা তাক করেন। নতুন চেয়ারে সজ্জিত লাল-সাদা গ্যালারি চোখে প্রশান্তি বুলিয়ে দেয়। একটু আবছা হলেও ভোরের হাওয়ায় পরিবেশটা বেশ সতেজ লাগে।
কয়েক দিন থেকেই বাটলারের এই অনুশীলন পর্ব নিয়ে চলছে নানা চর্চা। কতজন অনুশীলনে এলেন, কারা যোগ হলেন, তা নিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতে হচ্ছে। কারণটা তো জানাই। সাবিনা খাতুনদের বিদ্রোহ। নারী ফুটবল দলের ক্যাম্পে ডাক পাওয়া ১৮ জন খেলোয়াড় কোচ বাটলারের অনুশীলন বয়কট করছেন। ঋতুপর্ণা, মনিকা, মারিয়া, সানজিদারা ঘোষণা দিয়েছেন বাটলারকে অপসারণ না করলে তাঁরা আর মাঠে ফিরবেন না। চলে যাবেন গণ-অবসরে।
বাফুফের সাত সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি করেছে সমাধানের পথ খুঁজতে। রবি ও সোমবার বিদ্রোহী মেয়েদের কথা শুনেছে কমিটি। মঙ্গলবার রাতে বাটলারের কথা। কমিটিকে সাক্ষাৎ দিয়েই হোটেলে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন বাটলার। ভোরবেলায় ওঠেন রোজ। এটাই এখন ইংলিশ প্রিমিয়ারের ক্লাব ওয়েস্টহামের সাবেক ফুটবলারের দৈনিক রুটিন। ব্যতিক্রম ছিল না আজও।
কঠিন হলেও আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি সব। নেতিবাচক কিছু মাথায় আনছি না। ওরা বেশ উদ্যমী ও শিখতে চায়। চায় সামনে এগোতে।পিটার বাটলার, বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কোচ
ফেডারেশন অফিস থেকেও বাটলারের বাঁশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সময়টা পার করছিলেন মহা ব্যস্ততায়। টানা দুবারের সাফজয়ী তারকারা বেঁকে বসেছেন সপ্তাহখানেক হলো। কিন্তু বিকল্প দল তৈরি করা চাই। ২৪ ফেব্রুয়ারি আরব আমিরাতে যাওয়ার কথা বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের। ২৬ ফেব্রুয়ারি আমিরাতের সঙ্গে ফিফা প্রীতি ম্যাচ। বাফুফে সফরটি বহাল রাখতে তৎপর। বাটলার তাই বিদ্রোহে যোগ না নেওয়া ১২ জনের সঙ্গে যোগ করেছেন আরও বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়।
কতজন? আজ মাঠের দিকে তাকিয়ে গুনে শুনে বের করা গেছে—সব মিলিয়ে পাঁচ গোলকিপারসহ ৩৩ জন! বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠটাকে অর্ধেক করে সেখানেই চলে অনুশীলন। কোচ, কোচিং স্টাফ, বলবয়সহ ৪০ জনে মাঠটা গিজগিজ করে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ সামনে রেখে অ্যাথলেটরাও অনুশীলনে নেমে পড়েছেন ততক্ষণে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনেক দিন পর সাতসকালে খেলোয়াড়দের ব্যস্ততা মনে করায় পুরোনো দিনের স্মৃতি।
অর্ধেক মাঠকে অর্ধেক করে ছোট ছোট গ্রুপে বল দেওয়া-নেওয়া, পাসিং অনুশীলন চালিয়ে নেন বাটলার। এই মেয়েরা অপেক্ষাকৃত নবীন হওয়ায় তাঁদের বল নিয়ন্ত্রণ, পাসিংয়ের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরিতে কাজ চলে।
কখনো বড় গ্রুপ, কখনো ছোট ছোট ভাগে ট্যাকটিক্যাল সেশন হয়। কখনো দেখা যায় সবাই গোল হয়ে শুনছেন ‘স্যারের’টিপস। শেষে ম্যাচ। যা শুরু হতে হতে কখন যে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, তা টেরই পাননি নবীন ফুটবলাররা।
সবাইকে অবশ্য নবীন বলা ঠিক হবে না। ‘আপুরা’ বিদ্রোহ করলেও জাতীয় দলের মুখ আফঈদা খন্দকারকে আলাদা করা যায় এই ভিড়ে। ছিলেন ‘কক্সবাজারের মেসি’ খ্যাত শাহেদা আক্তার রিপা কিংবা নতুন মুখ সুরভী আক্তার প্রীতিও। ঋতুপর্ণা-রুপনা-মনিকাদের যেখান থেকে উঠে আসা, সেই পাহাড়ি এলাকার কিছু মুখও চোখে পড়ে। হাসিমুখেই সবাই বেরিয়ে আসেন স্টেডিয়াম থেকে।
সবার শেষে বেরোন পিটার বাটলার। স্টেডিয়ামের ফটকে তাঁর জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে। গুড মর্নিং বললে উত্তর এল, ‘গুড মর্নিং।’ এরপর নিজেই এই প্রতিবেদককে ‘হাউ আর ইউ’ প্রশ্নটা ছুড়ে দেন। অনুশীলন কেমন হলো জানতে চাইলে ঝটপট জবাব, ‘গুড, ভেরি পজিটিভ।’
বিদ্রোহীদের নিয়ে ভাবছেন না বলে দিয়েছেন আগেই। এদিনও একই কথা। কিন্তু নতুন একটা দল তৈরি কতটা কঠিন? বাটলারের উত্তর, ‘কঠিন হলেও আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি সব। নেতিবাচক কিছু মাথায় আনছি না। ওরা বেশ উদ্যমী ও শিখতে চায়। চায় সামনে এগোতে।’
যে ১৮ জন অনুশীলন বর্জন করেছেন, তাঁদের ফেরার কোনো রাস্তা কি আছে? নির্বিকার মুখে বাটলার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। খেলোয়াড়দের মধ্যে যাদের আগ্রহ আছে, তাদের নিয়ে কাজ করছি।’
বিদ্রোহীদের মধ্যে সাতজনকে নাকি বাদ দিতে বলেছেন আপনি? এবার ‘নো কমেন্টস’ বলে ড্রাইভার মহসিনের পাশে বসেন পড়েন। মহসিনকে তাড়া দেন গাড়ি ছাড়তে।
সকালে ‘নো কমেন্টস’ বলে এড়িয়ে গেলেও পরে বিকেলে বাফুফে ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন নারী ফুটবল দলের এই কোচ। জানিয়েছেন, বাফুফের তদন্ত কমিটিকে তিনি বলেছেন, বিদ্রোহী ফুটবলারদের মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকজন ক্যাম্পে থাকলে তিনি এই দলকে কোচিং করাবেন না!