ইউনাইটেড-লিভারপুল: স্বপ্নের মঞ্চে আবেগের ‘রোলারকোস্টার’

উত্থান–পতনের নাটকীয়তায় লিভারপুলকে হারিয়েছে ইউনাইটেডরয়টার্স

‘শুরুতে ঈশ্বর স্কুলে যেতেন এবং ক্লাস শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। যদিও ঈশ্বর অনেক কিছু জানতেন, তবু নতুন কিছু করার ও শেখার চেষ্টা করতেন। একদিন ঈশ্বর বললেন, “আজ আমি অনেক পরিশ্রম করেছি, এখন খেলতে যাই।” এরপর ঈশ্বর ও তার বন্ধুরা ফুটবল খেলতে শুরু করলেন। খেলতে খেলতে একসময় ঈশ্বর এত জোরে বলে লাথি মারলেন যে সেটি একটি গোলাপবাগানে গিয়ে পড়ল এবং ফেটে গেল। সেই বিস্ফোরণ থেকেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং আমাদের চারপাশের সবকিছু সৃষ্টি হলো।’ নিতান্তই শিশু মনের হাস্যকর ও কৌতূহলী ভাবনা। এই ভাবনা ৭ বছর বয়সী রদ্রিগো নাভারো মোরালেস নামের এক শিশুর। মোরালেসের ফুটবল ভাবনা এভাবেই বর্ণিত হয়েছে ম্যাক্সিকান লেখক হুয়ান ভিলোরোর ‘গড ইজ রাউন্ড’ বইয়ে।

ফুটবলের সৌন্দর্য, বিশালতা এবং ব্যাপ্তির পুরোটাই যেন ওপরের কথাগুলোয় বলা হয়ে গেছে। ফুটবল তো এমনই, যাকে বলে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। বিল শ্যাঙ্কলির ভাষায় ‘জীবন–মরণ সমস্যার চেয়েও বেশি কিছু।’ ওই যে ‘আনান্দ’ নামের বিখ্যাত এক হিন্দি সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের উদ্দেশে রাজেশ খান্না যে বলেন, ‘বাবুমশাই, জিন্দেগি বাড়ি হোনে চাহিয়ে, লাম্বি নেহি।’ (বাবুমশাই, জীবন বড় হওয়া উচিত, লম্বা নয়। তেমনই! মূলত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করার কথা বলতে গিয়ে আইকনিক এই সংলাপটি বলা হয়েছিল। হ্যাঁ, একটা ফুটবল ম্যাচই আপনাকে দিতে পারে সে অলৌকিক অনুভূতি।

শেষ পর্যন্ত হতাশা নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় লিভারপুলকে
রয়টার্স

ফুটবল মাঠে ৯০ কিংবা ১২০-১৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে আপনি পেতে পারেন কয়েকটা জীবন উপভোগের আনন্দ। সেই সময়টুকুর জন্য জীবনের সমস্ত না পাওয়া, হতাশা কিংবা গ্লানি ভুলে গিয়ে আপনি বাঁচতে পারেন অসংখ্য জীবন। আপনার জীবনকে শুধু দৈর্ঘ্য–প্রস্থে নয়, অনুভবেও অনেক বড় করে দেয় ফুটবল। তবে সব ম্যাচ এমন অনুভূতির জন্ম দেয় তা নয়, কদাচিৎ আসে এমন মুহূর্ত। যেমন গতকাল রাতে এসেছিল লিভারপুল-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এফএ কাপের শেষ আটের ম্যাচে। হয়তো কৌশল কিংবা খেলার মানের দিক থেকে নিঁখুত ম্যাচ নয়, কিন্তু আবেগ ও উত্থান–পতনের নাটকীয়তা ঢেকে দিয়েছে সে ঘাটতি।

আরও পড়ুন

‘থিয়েটার অব ড্রিম’ খ্যাত ওল্ড ট্রাফোর্ডে এই ম্যাচটির ১২০ মিনিট ফুটবল-রোমান্টিকদের জন্য ছিল দুর্দান্ত এক রোলারকোস্টার রাইড। এমন ম্যাচ জয়-পরাজয়ের আনন্দ-বেদনাকে নিয়ে আসে একই সমতলে। দিন শেষে সব ভুলে মনে রয়ে যায় তুরীয় এক আনন্দ, যার রেশও রয়ে যায় অনেক দিন পর্যন্ত। অনেকটা সেই ‘লার্জার দ্যান লাইফে’র মতোই।

তাই এমন ম্যাচে শেষ পর্যন্ত কোন দল জিতল আর কোন দল হারল, তা আর মুখ্য থাকে না। ম্যাচটা হয়ে ওঠে তার চেয়েও বেশি কিছু। তবে ম্যাচটা তো কাউকে না কাউকে জিততেই হতো। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জায়গায় লিভারপুল ৪-৩ গোলে জিতলেও এর মাহাত্ম্য একটুও কমত না। এরপরও ইউনাইটেডের জয়ের ভিন্ন মাহাত্ম্য অবশ্য আছে।

জয়সূচক গোলের পর আমাদো
এএফপি

এই ম্যাচের আগে ইউনাইটেডকে কেউই গোনাতেই ধরেনি। সাবেক লিভারপুল ডিফেন্ডার জোসে এনরিকে বলেছিলেন, লিভারপুল এ ম্যাচে ৫-০ ব্যবধানে জিতবে। অ্যানফিল্ডের ক্লাবটির সমর্থকদের মধ্যেও ভর করছিল এমনই টগবগে আত্মবিশ্বাস বা অতি-আত্মবিশ্বাস, যা হয়তো সংক্রমিত করেছে খেলোয়াড়দেরও। নয়তো এগিয়ে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধে কেন লিভারপুলের গা ছেড়ে দেওয়া!

প্রতিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ডে গিয়ে বারবার খাপছাড়া হয়ে পড়ার কারণই–বা কী! অথচ লিভারপুল চাইলে প্রেসিংয়ের চাপ অব্যাহত রেখে ম্যাচটা ৭০ থেকে ৮৫ মিনিটের মধ্যেই শেষ করে দিতে পারত, যেটা তারা প্রায়ই করে থাকে। লিভারপুল এদিন নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা লাগামটা আলগা করেছে। আর ইউনাইটেডকে ঘরের মাঠে লাল উৎসবে মাতার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে, যা একই সঙ্গে লিভারপুলের হয়ে ইয়ুর্গেন ক্লপের কোয়াড্রপল জয়ের স্বপ্নকেও ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

অবশ্য লিভারপুলের দায় বাড়িয়ে ইউনাইটেডের কৃতিত্ব হালকা করা অন্যায় হবে। এই ম্যাচ ‘রেড ডেভিল’দের ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য এক দৃষ্টান্তও হয়ে থাকবে। তা–ও এমন একটা ম্যাচে, যে ম্যাচের আগে তাদের কেউ হিসাবেই রাখেনি। যা একেবারেই অমূলকও ছিল না। সাম্প্রতিক ফর্ম বা পরিসংখ্যানও কোনোটাই তাদের পক্ষে ছিল না। তবে কোনো কিছুই পক্ষে না থাকার পরও ফুটবলেই কেবল পারে পাশার দান বদলে যেতে পারে।

আর যে পথ ধরে পুরো দৃশ্যপটটি বদলেছে, তা হার মানাবে দুর্দান্ত কোনো থ্রিলার সিরিজের চিত্রনাট্যকেও। নির্ধারিত সময়ের শেষ মুহূর্তে গোলরক্ষককে একা পেয়েও মার্কাস রাশফোর্ডের সেই মিস অথবা হার্ভে এলিয়টের শট অবিশ্বাস্যভাবে পোস্টে লেগে ফিরে আসা কিংবা শেষ মিনিটে আমাদ দিয়ালোর করা গোলের সামনে হয়তো সিনেমার জন্য বানানো চিত্রনাট্যকেও বাড়াবাড়ি মনে হবে। এর সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত গল্পটা এতে জুড়ে দেওয়া হবে তখন ইউনাইটেডের জয়টা হয়ে উঠবে মহাকাব্যের মেলোড্রামাটিক মঞ্চায়ন। আমাদের পায়েই ওল্ড ট্রাফোর্ড আক্ষরিক অর্থে হয়ে উঠেছিল থিয়েটার অব ড্রিম।

লিভারপুলের এই উদ্‌যাপন শেষ পর্যন্ত থাকেনি
রয়টার্স

অথচ এই আমাদের ম্যাচটা খেলারই কথা ছিল না! লিভারপুলের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে প্রিমিয়ার লিগে ৪৬ মিনিট এবং এফএ কাপে খেলেছিলেন ১৭ মিনিট। এমনকি ধারে ক্লাব ছাড়তে পারতেন জানুয়ারিতেই। বেশ কয়েকটি ক্লাবের আগ্রহও ছিল। কিন্তু টেন হাগের অনুরোধে থেকে যান ইউনাইটেডে। আর সেই থেকে যাওয়াতেই ইউনাইটেডের ঐতিহাসিক এক জয়ের নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ২১ বছর বয়সী এই আইভরিয়ান উইঙ্গার।

শেষ মুহূর্তে গোল করেছেন, জার্সি খুলে উদ্‌যাপন করে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড খেয়ে দেখেছেন লাল কার্ডও। মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সময় জার্সি দিয়ে গেলেন দর্শককে। পরে জানা গেল আমাদ এই ম্যাচটি খেলেছেন রোজা রেখে। তার জয়সূচক গোলের পরই অঝোর কাঁদতে দেখা গেল ইউনাইটেডের এক খুদে দর্শককে। সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা মুহূর্তই বটে। এমন দৃশ্যের জন্যই তো ফুটবল এত জয়জয়কার।

আরও পড়ুন

এই ধরনের ম্যাচের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষার কথা বলেছিলেন উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্রীড়ালেখক এদোয়ার্দো গালিয়ানো, ‘আমি ভালো ফুটবলের কাঙাল। আমি হাত ছড়িয়ে পৃথিবীর স্টেডিয়ামগুলোয় বিচরণ করি এবং প্রার্থনা করে বলি: ঈশ্বরের দোহাই, খেলাটা যেন ভালো হয়। আর খেলাটা যখন আসলেই ভালো হয়, তখন সেই অলৌকিক ঘটনার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিই। সেই খেলাটা কোন দল বা দেশ খেলল, তাতে আমার কিছুই যাই আসে না!’

হ্যাঁ, এমন একটি ম্যাচ উপহার দেওয়ার জন্য ফুটবল রোমান্টিকেরাও তাই ধন্যবাদ দিতেই পারেন দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুল ও ইউনাইটেডকে।