রোনালদো যেদিন মেসিকে রেখে চলে গিয়েছিলেন

লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। যখন দুজন লা লিগায় ছিলেনফাইল ছবি

ফেসবুকে নিজেদের ভেরিফায়েড পেজে রিয়াল মাদ্রিদ সেই ঘোষণায় লিখেছিল, ‘ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ইচ্ছা এবং অনুরোধের ভিত্তিতে রিয়াল মাদ্রিদ জানাচ্ছে, ক্লাব তাকে জুভেন্টাসে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদ আনুষ্ঠানিকভাবে এমন একজন খেলোয়াড়কে এই ধন্যবাদটা দিতে চায়, যে নিজেকে বিশ্বের সেরা হিসেবে উপস্থাপন করেছে, ক্লাবের অন্যতম সেরা সময়ে এবং বিশ্ব ফুটবলে নিজের ছাপ রেখেছে...।’

মেসি–রোনালদোর সমর্থকেরা সেদিন মুদ্রার অপর পিঠটাও দেখেছিলেন। এক পিঠে তো দ্বৈরথ, যা হিরণ্ময় হয়ে আছে ফুটবলের ইতিহাসে। অন্য পিঠে? সে কথা লিখতে গেলে যে দ্বৈরথটাই উল্টে যায়! টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের উদাহরণ টানা যায়। বাড়িতে টম না থাকলে জেরি বরাবরই তাকে মিস করেছে। কিংবা এর উল্টোটা। কিন্তু সামনাসামনি দুজনের শত্রুতার শেষ নেই। আচ্ছা, পর্দায় দুজনকে দেখে কখনো মনে হয়নি টম অ্যান্ড জেরি আসলে ‘শত্রু’ নয়, একটা জোড়া। একজন আরেকজনকে ছাড়া ভীষণরকম অপূর্ণ!

আরও পড়ুন

মেসি–রোনালদোও তেমনই। একটা জোড়া। ফুটবলের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দ্বৈরথের ইতিহাস লেখাটা ছিল যাঁদের নেশা। কিন্তু একদিন রোনালদোর সেই নেশা কেটে গেল। রিয়ালের সঙ্গে বেতনে বনিবনা হলো না। রোনালদো বলেছিলেন, ‘আমি চললাম!’ সেই বলাটা শুধুই রিয়ালের প্রতি হলেও তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল মেসির হৃদয়েও। খেলার সাথি চলে যেতে চাইলে কারই–বা ভালো লাগে! রিয়ালও মুঠো ছেড়ে দেওয়ায় ফুটবলের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দ্বৈরথের শেষ পাতাটা সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা হয়ে গিয়েছিল। কোন দিন? পাঁচ বছর আগে এই দিনে।

দিনটা তাই মেসি–রোনালদোর সমর্থকদের মনে থাকার কথা। পাঁচ বছর আগে আজকের দিনেই বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৫৯ মিনিটে ফেসবুকে ঘোষণাটি দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। লা লিগায় ৯ বছর চোখে চোখ রেখে দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধ্যায়ের শেষ পাতা সেটি। এরপর চ্যাম্পিয়নস লিগে মেসি–রোনালদোর দেখা হয়েছে। কিন্তু তুষের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে নিভে যাওয়ার আগে সামান্য বাতাসে যেভাবে জ্বলে ওঠে, তাঁদের সেই সাক্ষাৎ এর বেশি কিছু ছিল না। রোনালদো ২০১৮ সালে রিয়াল ছাড়ার পর এই পাঁচ বছরে জুভেন্টাস, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ঘুরে এখন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া মেসি স্পেনে ছিলেন তিন বছর। ২০২১ সালে বার্সা ছেড়ে যোগ দেন পিএসজিতে, এরপর কি মেসির সময়টা ভালো কেটেছে?

চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে মেসিকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল পিএসজি। লিগ জিতলেও মেসি আসল লক্ষ্য পূরণ করতে পারেননি। পরিণামে দুয়ো শুনেছেন গত মৌসুমে। নিষিদ্ধও হয়েছেন। মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই দুজনের পুনর্মিলনের গুঞ্জন উঠেছিল। আল হিলাল নাকি মেসিকে কিনতে চায়—গুঞ্জনে সয়লাব ছিল ইউরোপের সংবাদমাধ্যম। তখন বন্ধ হওয়া সেই ‘অধ্যায়’–এর নতুন সংস্করণ দেখার স্বপ্নও দেখেছেন অনেকে—মেসি–রোনালদোর সৌদি ক্ল্যাসিকো! কিন্তু মেসি সম্ভবত জাতীয় দল ছাড়া কোনো কিছুর প্রতি ফিরে তাকান না। একটু বুঝিয়ে বলা যায়। জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে মানে চলে যাওয়ার পর শুধু এটার প্রতিই ফিরে তাকিয়েছেন, ফিরে এসেছেন। কিন্তু রোনালদোর কাছে আর ফিরে যাননি। টম ও জেরির ক্ষেত্রে এমনটা কখনো ঘটেনি। আসলে কার্টুন আর মানুষের চরিত্র তো এক না! কল্পনার ঘুড়ির সুতা আরেকটু ছেড়ে বলতে হয়, কার্টুনকে যা করানো হয় তাই করে, কিন্তু মানুষ তেমন নয়। মানুষ অভিমানী হয়, যেমন লিওনেল মেসি।

আরও পড়ুন

পেশাদার দুনিয়ায় খেলার মাঠ বাদে আবেগটা সেভাবে প্রকাশ্যে আসে না। কারও জন্য কারও মন পোড়ার বিষয়টি তো নয়ই। আর সেটা যদি হয় সর্বকালের সেরা ব্যক্তিগত দ্বৈরথ, তাহলে তো কথাই নেই। এর সঙ্গে কত টাকার বাণিজ্য সৃষ্টিকর্তা মালুম! চরিত্রগুলোকে তাই শক্ত ও ঋজু হতে হয়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে রোনালদোর সেই ঘোষণার পর প্রায় এক মাস মেসি মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। ৪ সেপ্টেম্বর কাতালুনিয়া রেডিওকে বলেছিলেন, ‘বিস্মিত হয়েছি। ভাবিনি সে রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়বে।’ রোনালদো তত দিনে রিয়ালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা, ব্যালন ডি’অরসহ যা যা জেতার সবকিছুই জিতে ফেলেছেন। মেসিও বার্সায় হাঁটছিলেন একই পথে। মেসি কি ভেবে রেখেছিলেন, ‘রোনালদোর শেষ হবে রিয়ালে, আমারও শেষ হবে বার্সায় আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের দ্বৈরথেরও...?’

নাহলে এক বছরের মাথায় এসে পেশাদারত্বের খোলস ভেঙে কেন ওই কথাটা বলবেন, ‘চেয়েছিলাম রোনালদো লা লিগায়ই থাকবে, মাদ্রিদে থাকবে। লা লিগা, ক্ল্যাসিকো এবং আমাদের দ্বৈরথকে তা এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল।’

ওই যে কল্পনার ঘুড়ির কথা বলা হলো, সেটার সুতা আরেকটু ছাড়া যাক—রোনালদোকে রিয়াল ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর মেসি জানতেন এই মহাকাব্যিক দ্বৈরথের দৌড় এখানেই শেষ। একই লিগ ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবের সেরা দুই খেলোয়াড় হিসেবে প্রায় এক দশকের দ্বৈরথের এখানেই শেষ। লা লিগায় দুজনের যে লিগ্যাসি, তা আর কোথাও পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়। সেটা শুধু বয়সের জন্য না, জনপ্রিয়তা ও ফুটবলের সংস্কৃতি বিচারেও। ওই এক দশক অনেকের কাছেই মেসি–রোনালদোর দ্বৈরথ দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল, রোজনামচার জীবনের চর্চা যা অন্য কোথাও একই সুরে একই টানে সমর্থকদের ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। মেসি তাই ‘প্রতিশোধ’টা নিয়েছেন। কিসের প্রতিশোধ?

আরও পড়ুন

মেসির মনের খবর তো আর জানার উপায় নেই। তবে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে এভাবে ধরে নেওয়া যায়, মেসি চেয়েছিলেন রোনালদো রিয়ালে থাকুন। রোনালদো থাকেননি। মেসিও তাই সৌদির ঘরোয়া ফুটবলে ফিরে সাঁইত্রিশ পার করা রোনালদোকে আর ভালো বানানোর ‘উপকার’টা করতে চাননি। জাতীয় দলে মেসি তাই ফিরে তাকালেও কে জানে ‘হৈমন্তী’ গল্পটা হয়তো তাঁরও পড়া, তাই জানতেন—‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মত বিড়ম্বনা আর হয় না।’ সে জন্যই কি রোনালদোর প্রতি আর ফিরে তাকাননি?

মেসি নস্টালজিক সেই বিড়ম্বনা এড়িয়ে যোগ দিয়েছেন ইন্টার মায়ামিতে। পৃথিবীর এক প্রান্তে রোনালদো যখন সৌদি ফুটবলের মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত, মেসিও তখন অন্য প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওপর থেকে দেখলে দুজনের কাজটা আসলে একই—কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পর শেষ বয়সে দুজনেই একটু পিছিয়ে পড়া দেশের ফুটবলকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জোয়াল কাঁধে নিয়েছেন। যেমনটা চেষ্টা করেছিলেন পেলে, বেকেনবাওয়ার, জিকো...। তাই পরিসংখ্যান যা–ই বলুক, সেই ‘জোড়া’ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এখনো কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নেই মোটেও। এমনকি ভাগ্যও সায় দিচ্ছে তাঁদের পক্ষে।

সাত বছর আগে পর্তুগালের হয়ে প্রথম বড় শিরোপা জিতেছিলেন রোনালদো—২০১৬ ইউরো। মেসির আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম বড় শিরোপা কোপা আমেরিকা, সেটা দুই বছর আগে। দুজনের দেশের হয়ে প্রথম বড় শিরোপা জয়ই আজকের দিনে। আর দেখুন কী কাণ্ড, আজকের দিনেই দুজনের দ্বৈরথের সেই ‘জুটি’ আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে গিয়েছিল! তারপর জল গড়িয়েছে অনেক দূর। মেসি বিশ্বকাপ জিতে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে কারও কারও চোখে এগিয়ে। সে তর্ক আজ তোলা থাক। আজ বরং অন্য একটা তর্ক তোলা যাক। ২০০৯–২০১০ মৌসুম থেকে ২০১৭–২০১৮ এই ৯ মৌসুমে স্প্যানিশ ফুটবল ও ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল মিলিয়ে ৪৩৮ ম্যাচে ৪৫০ গোল করেছেন রোনালদো। মেসি ৪৭৬ ম্যাচে করেছেন ৪৭২ গোল। ওই সময়ে কে এগিয়ে?

আরও পড়ুন

এই প্রশ্নের উত্তরটা দিতে হয় ‘কুইন’ ব্যান্ডের সদস্য, গীতিকার, গায়ক ও গিটারিস্ট স্যার ব্রায়ান মে–র কথায়। তাঁর কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিশ্বের সেরা গিটারিস্ট কে? সর্বকালের অন্যতম সেরা গিটারিস্টদের তালিকায় ঢুকে পড়া ব্রায়ান বলেছিলেন, ‘কে সেরা, এটা বলা যায় না। গিটার বাজানোর সুন্দর ব্যাপার হলো, সবার বাজানোর ধরনই আলাদা। কে সেরা, বলা যায় না। তবে প্রশ্নটা শুনতে ভালো লাগে।’

সংগীতের মতো আনুষ্ঠানিক না হলেও ফুটবলকেও কেউ কেউ আর্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেন। মেসি–রোনালদো সেই ‘কলা’র অন্যতম সেরা হওয়ার পরও কি তুলনা চলে? দুজনের খেলার ধরন যে আলাদা!

বরং দুজনের খেলার ধরন মিলিয়ে দারুণ একটা ছবি পাওয়া যায়। ঘরটার নাম লা লিগা। তার ভেতরে কে কত গোল করেছেন তার চার্ট। প্রচুর ফলা গাঁথা দুটি ডার্ট বোর্ডও আছে। আর একটা বল এবং দুটি হাতুড়ি। সঙ্গে একটা কাটাকুটির তালিকা, সেখানে কে কত গোল করে কাকে কবে টপকে গেছেন, সেসবের বিবরণ। আর ঘরের মাঝে মুখ বেজার করে দাঁড়িয়ে মেসি, তাঁকে রেখেই উল্টো দিকে মুখ করে রিয়ালের জার্সিটা ছুড়ে ফেলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন রোনালদো। কল্পিত এই ছবিটা আসলে কার্টুন। রোনালদোর রিয়াল ছাড়ার ঘোষণা আসার পর এঁকেছিল ইউরোস্পোর্ট।

রিয়াল রোনালদোর চলে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর এই কার্টুন প্রকাশ করেছিল ইউরোস্পোর্ট
ছবি: টুইটার

ওই একটা ছবিতেই বিষয় পরিষ্কার। প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো থাকবেই, সে জন্যই তাঁরা আজ একটা উচ্চতায়। কিন্তু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচেই দুজনের হৃদয় গলেছে একে অপরের প্রতি। তাই টম অ্যান্ড জেরির মতো ‘জোড়া’ হয়ে উঠেছিলেন। পাঁচ বছর আগে সেই জোড়া কাটা পড়ার পর কেউ কি ভালো আছেন? রোনালদো রিয়াল ছাড়ার পর সিরি আ ছাড়া তেমন কিছুই জিততে পারেননি। সেরার দৌড় থেকেও ছিটকে পড়েছেন। কিন্তু মেসি দেশের হয়ে জিতেছেন বিশ্বকাপ। হ্যাঁ, মেসির ভাষায় বিশ্বকাপ জয়ই তাঁর জীবনের সেরা মুহূর্ত। কিন্তু ক্লাব ফুটবল? যেখানে দুজনে চষে বেড়িয়ে শত শত লাল ও নীল পদ্মের খোঁজ করেছেন ও পেয়েছেনও—সেই জমিনে কিন্তু মেসিকে আর আগের মতো দেখা যায়নি।

দেখা যাবে কীভাবে? খেলার সাথি না থাকলে খেলে মজা আছে!