এমন ফাইনাল কবে দেখেছে বাংলাদেশের ফুটবল

অবিশ্বাস্য এক ফাইনাল দেখল আজ বাংলাদেশের ফুটবলছবি: শামসুল হক

বাংলাদেশের ফুটবলে এমন ফাইনাল কি হয়েছে আর কখনো?

এত নাটকীয়তা, এমন রুদ্ধশাস লড়াই, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এমন টানটান উত্তেজনা। দুই ঐতিহ্যবাহী দলের মধ্যে এমন ফাইনাল কি আগে কখনো দেখেছে বাংলাদেশের ফুটবল!

১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনালে খেলল দেশের দুই জনপ্রিয় দল আবাহনী ও মোহামেডান। ফুটবলপ্রেমীদের বুঁদ করে কী দুর্দান্ত এক খেলাই না উপহার দিল দুই দল! যে ম্যাচ পেন্ডুলামের মতো হেলেছে একেকবার একেক দিকে, শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ে নির্ধারিত সময় শেষে ৩-৩ ও অতিরিক্ত সময় শেষে স্কোরলাইন ৪–৪। টাইব্রেকারে শেষ পর্যন্ত মোহামেডান বাজিমাত করলেও কুমিল্লার ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে এ ম্যাচে সত্যিকারের জয়ী ফুটবল, বাংলাদেশের ফুটবল।

অনেক দিন পর উৎসবের উপলক্ষ পেলেন মোহামেডান সমর্থকেরা
ছবি: শামসুল হক

পাঁচ মাস আগে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা আর ফ্রান্স এক শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই উপহার দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। আজ যেন কুমিল্লায় সেই ফাইনাল ফিরেছিল। বিশ্বকাপ ফাইনালকে অনেকেই সর্বকালের সেরা ফুটবল ম্যাচ বলেন। আজ আবাহনী–মোহামেডানের মধ্যকার ফেডারেশন কাপ ফাইনালকে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা ফাইনাল বললে কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?

আরও পড়ুন
শ্বাসরূদ্ধকর ম্যাচে শেষ পর্যন্ত জয়ী মোহামেডান
ছবি: শামসুল হক

ফুটবলের যে সোনালি অতীতের কথা বারবার বলি আমরা, সেই অতীতের যেকোনো ফাইনালকেই সম্ভবত ছাপিয়ে গেছে আজকের ফাইনাল। সেই সত্তর–আশি–নব্বইয়ের দশকে দর্শকে ঠাসা স্টেডিয়াম, তীব্র উত্তেজনা, রোমাঞ্চের দিনগুলোতেও এমন কোনো ম্যাচ দেখা যায়নি সম্ভবত।

ম্যাচটি ছিল আবেগের, ম্যাচটি ছিল রোমাঞ্চের
ছবি: শামসুল হক

কী ছিল না এই ম্যাচে! আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, দুর্দান্ত সব সেভ, গোলের পসরা—স্নায়ুর পরীক্ষা, টাইব্রেকার রোমাঞ্চ। গ্যালারিতে দুই দলের সমর্থকদের উত্তপ্ত উপস্থিতি! আবাহনী–মোহামেডানের সেই হারিয়ে যাওয়া উত্তেজনার অনেকটুকুই আজ ফিরেছিল কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে। গ্যালারিতে মোহামেডানের সমর্থকেরা এসেছিলেন সেই সাদা–কালো জার্সি গায়ে। হাতে ছিল ব্যানার–ফেস্টুন, হাতে হাতে ছিল মোহামেডানের সাদা–কালো পতাকা। আবাহনীর গ্যালারি ছিল আরও এক কাঠি সরেস। আকাশি–নীলে সেজে থাকা আবাহনীর সমর্থকদের হাতে ক্লাব পতাকার সঙ্গে ছিল নীল, হলুদ স্মোক ফ্লেয়ারও। ইউরোপীয় ফুটবলের ম্যাচগুলোতে স্মোক ফ্লেয়ার দেখা যায়! আবাহনী সমর্থকদের হাতে এই বস্তুটি যেন দেশের ক্লাব ফুটবলের দারুণ বিজ্ঞাপনই হয়ে রইল। দেশের ফুটবলেরও বড় বিজ্ঞাপন হয়ে রইল এই ম্যাচ।

আরও পড়ুন
দুইবার এগিয়ে গিয়েও ম্যাচে হার আবাহনীর
ছবি: শামসুল হক

বাংলাদেশের ফুটবল ১০ গোলের ফাইনালও দেখেছে। সেটি ২০১৫ সালে। ফেডারেশন কাপের শিরোপা নির্ধারণী সেই ম্যাচে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ৬–৪ গোলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রকে হারিয়েছিল। ৮ গোলের ফাইনাল হয়েছিল ২০১০ সালে। কমলাপুরের শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে শেখ জামাল ধানমন্ডি আর আবাহনীর সেই ম্যাচ ছিল দুর্দান্ত। শেষ পর্যন্ত আবাহনী জিতেছিল ৫–৩ গোলে।

এর আগে আবাহনী–মোহামেডান ম্যাচ শেষবার ৮ গোলের রোমাঞ্চের সাক্ষী হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তবে সেটি ফাইনাল ছিল না। সেবার ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে আবাহনী–মোহামেডান ম্যাচের স্কোরলাইন ছিল ৪–৪। হ্যাটট্রিক করেছিলেন আবাহনীর শ্রীলঙ্কান ফুটবলার প্রেমলাল। সেই ম্যাচ টাইব্রেকারে জিতে ফাইনালে উঠেছিল আবাহনী। আকাশি–নীল সমর্থকদের স্মৃতিতে সেই ম্যাচ চিরস্মরণীয়।

আরও পড়ুন
৪ গোল করে মোহামেডান–আবাহনী দ্বৈরথের ইতিহাসে দিয়াবাতে
ছবি: শামসুল হক

গোলের বন্যা বয়ে না গেলেও ১৯৯০ ফেডারেশন কাপের ফাইনালটিও রোমাঞ্চকর ছিল। রিজভি করিম রুমির পেনাল্টি গোলে আবাহনী সেই ম্যাচে এগিয়ে ছিল ম্যাচের অনেকটুকু সময়ই। কিন্তু মোহামেডান খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে মোস্তাকিম ওয়াজেদের গোলে সমতায় ফেরে। এরপর অতিরিক্ত সময়ে সেই মোস্তাকিমই গোল করে মোহামেডানকে ২–১ গোলে জিতিয়ে দেন। মিরপুর স্টেডিয়ামে কানায় কানায় পরিপূর্ণ গ্যালারির সামনে মোহামেডানের সেই জয় এখনো রোমাঞ্চিত করে মোহামেডান সমর্থকদের। বাংলাদেশের ফুটবল গোল–পাল্টা গোলের শ্বাসরুদ্ধকর আরেক ফাইনালের সাক্ষী হয়েছিল ৩০ বছর আগে, ১৯৯৩ সালের ডামফা কাপের ফাইনালে। আবাহনী সে ম্যাচে শুরুতে গোল করে এগিয়ে গিয়েছিল। মোহামেডান সমতায় ফিরলেও পেনাল্টি গোলে আবাহনী আবারও এগিয়ে যায়। খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে কায়সার হামিদের অবিশ্বাস্য এক ফ্রি–কিকের গোলে ২–২ করে ফেলে মোহামেডান। অতিরিক্ত সময়ে গোল করে মোহামেডানের জয়ের নায়ক হন ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব।

আরও পড়ুন
দেশের ফুটবলের অনেক অতীত দিনের স্মৃতি ফেরাল এই ম্যাচ
ছবি: শামসুল হক

তবে আজকের ম্যাচ অতীতের অনেক কিছুকেই ছাপিয়ে গেছে। আগ্রহে, রোমাঞ্চে, উত্তেজনায়। আবাহনী–মোহামেডান ম্যাচ নিয়ে মানুষের সেই পুরোনো আগ্রহ হারিয়ে গেছে বলে যে আক্ষেপ ছিল এত দিন, এই ম্যাচ হয়তো সেই আক্ষেপ ঘোচানোর প্রথম ধাপ। এই ম্যাচ অনেক ফুটবলবিমুখ মানুষকেও আগ্রহভরে টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকাতে বাধ্য করেছে। ফেসবুকে বাধ্য করছে স্মৃতিকাতর স্ট্যাটাস লিখতে।

দেশের ফুটবলের সেরা ফাইনাল মোহামেডানকে অনেক দিন পর ঘরোয়া ফুটবলের একটা শিরোপা পাইয়ে দিল। তবে দেশের ফুটবলকে তার সোনালি দিনের কতটা ফিরিয়ে দিতে পারে এই ম্যাচ, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।