সালাহর বিদ্রোহ, স্লট আউট স্লোগান আর মাঠের দুর্দশা—যেভাবে ভেঙে পড়েছে লিভারপুল
এই লেখা নানা জায়গা থেকে শুরু করা যায়। সেটি হতে পারে মোহাম্মদ সালাহর বিদ্রোহ, স্লটের ওপর সমর্থকদের আস্থা হারানো, দলীয় ঐক্যের ভরাডুবি কিংবা তারকাদের ছায়ার নিচে ঢেকে যাওয়া থেকে। যেখান থেকেই শুরু করা হোক, ডটগুলো মেলালে একটা দৃশ্যই ফুটে উঠবে—লিভারপুলের অবিশ্বাস্যভাবে ধসে পড়া। যে ধসে পড়া শুধু মাঠের খেলাতেই নয়, ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে লিভারপুলকে। দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে উত্তরণের কোনো আলোর রেখাও। যদিও শুরুটা মোটেই এমন হতশ্রী ছিল না।
ইয়ুর্গেন ক্লপের বিদায়ের পর গত মৌসুমটাকে লিভারপুলের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ভাবা হচ্ছিল। ক্লপ বিশেষ এক দর্শনে দলটিকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন এবং এনে দিয়েছেন সাফল্যও। ম্যানচেস্টার সিটির একচ্ছত্র আধিপত্যকে ক্লপের লিভারপুলই কিছুটা চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ক্লপের বিদায়ের প্রভাব দলের মধ্যে পড়তে দেননি নতুন কোচ আর্নে স্লট। ক্লপের রেখে যাওয়া দল এবং দর্শনকে কাজে লাগিয়েই সবাইকে চমকে দিয়ে নিজের প্রথম মৌসুমে জিতে নেন লিগ শিরোপা।
স্লটের এই অর্জন দলের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। যার ওপর ভর করে দলবদলে লিভারপুল অবিশ্বাস্য পরিমাণে অর্থ খরচ করে এবং নিয়ে আসে ইউরোপের সম্ভাবনাময় একাধিক তারকাকে। যেখানে আলেক্সান্দার ইসাক, ফ্লোরিয়ান ভির্টৎস এবং উগো একিতিকের মতো তারকারাও ছিলেন।
সব মিলিয়ে দলবদলে রেকর্ড ৪৮২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে অ্যানফিল্ডের ক্লাবটি। ভার্জিল ফন ডাইক, সালাহ, গাকপোদের সঙ্গে নতুন এই তারকাদের অন্তর্ভুক্তি ক্লাবটির সমর্থকদের আরও বড় কিছু অর্জনের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। সেই পথে নতুন মৌসুমে লিভারপুলের শুরুটাও হয়েছিল দুর্দান্তভাবে।
প্রিমিয়ার লিগে টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে সমর্থকদের শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন দেখায় লিভারপুল। চ্যাম্পিয়নস লিগেও লিভারপুল শুরুটা করে আতলেতিকো মাদ্রিদের মতো ক্লাবকে হারিয়ে। কিন্তু একটু দূরে যে বিপদ উঁকি দিয়ে বসে ছিল, তা খেয়াল করেনি কেউই। শুরুতে যে দলটি শেষ মুহূর্তে এসে গোল করে একের পর এক ম্যাচ জিতছিল, এরপর সেই একই উপায়ে ম্যাচ হারা শুরু করে তারা।
প্রথম দিকে অবশ্য হারটাকে স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। কিন্তু লিগে টানা ৪ ও ৭ ম্যাচের ৬টি হারের পর, কোনো কিছুই আর স্বাভাবিক থাকেনি। একের পর এক হার লিভারপুলকে রীতিমতো কোণঠাসা করে দেয়। আর সেসব হারকে ঘিরে উঠতে থাকে একের পর এক প্রশ্নও।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে সালাহর পারফরম্যান্স নিয়ে। গত মৌসুমে লিভারপুলের লিগ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন সালাহ। প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও উঠেছিল তাঁর হাতে। অথচ সেই সালাহ এই মৌসুমে হয়ে গেছেন নিজের ছায়া। এই মৌসুমে সব মিলিয়ে ১৯ ম্যাচ খেলে সালাহ গোল করেছেন মাত্র ৫টি, যা তাঁর নামের পাশে একেবারেই বেমানান। টানা ব্যর্থতা একপর্যায়ে সালাহকে দল থেকেই ছিটকে দিয়েছে।
শেষ তিন লিগ ম্যাচে সালাহর ঠাঁই হয়েছে বেঞ্চে। এর মধ্যে দুই ম্যাচে মাঠে নামানোও হয়নি তাঁকে।
শেষ তিন লিগ ম্যাচে সালাহর ঠাঁই হয়েছে বেঞ্চে। এর মধ্যে দুই ম্যাচে মাঠে নামানোও হয়নি তাঁকে। দল এবং কোচের এমন সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি সালাহ। গতকাল রাতে লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে ৩-৩ ড্রয়ের পর দল এবং কোচ আর্নে স্লটকে এক হাত নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, দলের ব্যর্থতায় তাঁকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হচ্ছে। এ সময় কোচের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে পড়ার কথাও জানান এই উইঙ্গার। পরিস্থিতি এখন এত দূর গড়িয়েছে যে জানুয়ারিতে সালাহর লিভারপুল ছাড়ার গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে।
সালাহ হয়তো জানুয়ারিতে লিভারপুল ছাড়বেন, হয়তো ছাড়বেন না; ফুটবলে যেহেতু শেষ কথা বলে কিছু নেই। এমনও হতে পারে যে সালাহর আগে স্লটই ছাঁটাই হয়ে গেলেন। এরই মধ্যে সালাহর সঙ্গে তাঁর তিক্ত সম্পর্কের কথা সামনে এসেছে। পাশাপাশি দল পরিচালনায় কৌশলগত ব্যর্থতাও স্পষ্ট। লিভারপুল সমর্থকদের অনেকে এখন ‘স্লট আউট’ স্লোগানও ধরেছেন। যা স্লটকে একরকম কোণঠাসা করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সামনের কয়েক ম্যাচ স্লটের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অতিমানবীয় কিছু করে দলের ভাগ্য বদলাতে না পারলে ছাঁটাইয়ের ঝড়ে পড়তে পারেন তিনিও।
লিভারপুলের ভেতরে-বাইরে যে ঝড় উঠেছে, তার মূল কারণ দলের পারফরম্যান্স। মাঠের ফল না বদলালে এই সংকট সন্দেহাতীতভাবে আরও বাড়বে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। একমাত্র ইতিবাচক ফলই পারে লিভারপুলকে এই ধস থেকে টেনে তুলতে। সে জন্য মূলত দায়িত্ব নিতে হবে নতুন তারকাদের। যাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত পারফরম্যান্স না পাওয়াই লিভারপুলের ভরাডুবির আরেকটি কারণ।
নিউক্যাসল থেকে লিভারপুলে এসে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন ইসাক। ১৩ ম্যাচে মাত্র ২ গোল, তাঁর নামের পাশে বেমানান। একই কথা ভির্টৎসের জন্যও প্রযোজ্য। লিভারপুলের হয়ে ১৯ ম্যাচ খেলে এখনো গোলের খাতা খুলতে পারেননি বায়ার লেভারকুসেনকে ঐতিহাসিক লিগ জেতানো এই তারকা।
লিভারপুলের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এই দুই তারকা ছন্দে ফেরা বিশেষভাবে জরুরি। পাশাপাশি রক্ষণকে শক্তিশালী করার উদ্যোগও নিতে হবে দলটিকে। জানুয়ারির দলবদলে রক্ষণে বিকল্প খেলোয়াড় এনে রক্ষণকে শক্তিশালী করতে না পারলে তা দলটিকে আরও ভোগান্তিতে ফেলতে পারবে।
তবে সবকিছুর আগে লিভারপুলকে সালাহ ও স্লট–প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। যদি দুজনকে নিয়েই তারা এগোতে চায়, তবে দুজনের মধ্যে যে টানাপোড়েন, তা দূর করেই এগোতে হবে। নয়তো সংকটের স্তূপের মধ্যেই চাপা পড়ে যেতে পারে দলটির গোটা মৌসুমও।