কাতারে নির্যাতনের শিকার হলেও গর্ব ও সম্মান অর্জন শ্রমিকদের

বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে আল থুমামা স্টেডিয়ামের মতো অনেক নতুন প্রকল্পই হাতে নিয়েছে কাতারছবি: টুইটার

জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর নিস্তরঙ্গ জীবনে বোধ হয় বড্ড আপত্তি। সুযোগ পেলেই বিতর্কের জন্ম দেওয়া আর সে সুবাদে সমালোচনার ঝড় সামলাতেই যেন আনন্দ তাঁর। ২০১৬ সালে ফিফার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ফিফার অর্থবিত্ত বাড়ানোয় নজর দিয়েছেন। ৩২ দলের ফুটবল বিশ্বকাপকে ৪৮ দলের করা হয়েছে। দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ আয়োজনের চেষ্টা চালিয়েছেন। এর পক্ষে নানা অজুহাত দিয়েছে, আর্থিকভাবে দুর্বল ফেডারেশনগুলোকে ৪ বছরে অন্তত ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের (২১৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা) টোপ দিয়েছেন।

দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ আয়োজিত হলে ভাগ্য বদলাতে ইউরোপে যেতে চাওয়া মানুষের মৃত্যু হবে না, এমন অদ্ভুত এক যুক্তিও দিয়েছিলেন। তাঁর সে চেষ্টা তবু ব্যর্থ হয়েছে। এবার নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বেশ আগে থেকেই সোচ্চার। অনেকেই বর্জনের ডাক দিয়েছেন। সাবেক ও বর্তমান অনেক খেলোয়াড়ই নারী ও অভিবাসীদের ওপর নির্যাতনের নজির আছে, এমন দেশে বিশ্বকাপ আয়োজনে ফিফার অর্থলিপ্সার ভূমিকা দেখছেন।

এমন প্রসঙ্গে জবাব দিতে গিয়ে বিতর্ক আরও বাড়িয়েছেন ফিফা সভাপতি। বলেছেন, নির্যাতিত হলেও এসব শ্রমিক কাজ করে সম্মান পাচ্ছেন, গর্ব করতে পারছেন!

এমন অনেক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের আহবান দিচ্ছে কাতার
ছবি: টুইটার

ফুটবলের সবচেয়ে সফল দুটি অঞ্চল—ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার বাধার মুখে দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারছে না ফিফা। সেটা নিশ্চিত হওয়ার পর ইনফান্তিনো ভোল পালটে বলেছিলেন, তাঁরা কখনো দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা বলেননি। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা নাকি শুধু বলেছিলেন!

অথচ গত জানুয়ারিতে ফ্রান্সের স্ত্রাসবুরে ইউরোপীয় কাউন্সিলের সংসদীয় পরিষদের সামনে ফিফা সভাপতি বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে নিজের যুক্তি দিয়েছিলেন এভাবে, ‘পুরো বিশ্বকে সঙ্গী করার উপায় খুঁজতে হবে আমাদের। আফ্রিকানদের আশা জাগাতে হবে, যেন তারা ভালো জীবনের আশায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ না করে।’

বিশ্বকাপের উদ্বো‌ধনী ম্যাচ হবে এই স্টেডিয়ামে
ছবি: টুইটার

এমন মন্তব্য করে তুমুল সমালোচনা শুনেছিলেন ইনফান্তিনো। নিজের ইচ্ছাপূরণে যেনতেন যুক্তি দিয়ে যে লাভ নেই, সে শিক্ষা তবু তাঁর হয়নি। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে একটি ব্যবসায়িক সম্মেলনে কথা বলেছেন ফিফার প্রধান। কাতারে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সাধারণ অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এ নিয়ে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে গার্ডিয়ানের এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ১০ বছরে শুধু দক্ষিণ এশিয়ারই সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কাতারে মৃত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজার ১৮!

কিছুদিন আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অভিবাসী শ্রমিকদের জোরপূর্বক কাজ করায় কাতার। অনেক ক্ষেত্রে এতে আইন লঙ্ঘন হচ্ছে জেনেও প্রতিবাদ করার সুযোগ পান না শ্রমিকেরা। অ্যামনেস্টির সেই প্রতিবেদন ধরেই ইনফান্তিনোর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল কাল। লস অ্যাঞ্জেলেসে মিলকেন ইনস্টিটিউটে বৈশ্বিক এক সম্মেলনে ইনফান্তিনোর কাছে সঞ্চালক স্টেফানি রুহলে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ফিফা প্রচুর আয় করে। সেখান থেকে কাতারে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, ফিফা তাঁদের সাহায্য করার কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিনা।

বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে দেশের অবকাঠামোই বদলে ফেলেছে কাতার
ছবি: টুইটার

এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ইনফান্তিনো। বরং ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, ‘একটা জিনিস ভুলবেন না...আমরা কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছি, এখানে মূল হলো কাজ, এমনকি কঠিন কাজ, কষ্টকর কাজ। যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের দেশ। আমার মা–বাবাও ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ডে গিয়েছেন। এত দূর না, তবু গিয়েছেন তো।’

এরপরই বিতর্কিত সে মন্তব্য করে বসেছেন ইনফান্তিনো, ‘আপনি যখন কাউকে কাজ দিচ্ছেন, সেটা কঠিন পরিবেশে হলেও আপনি তাকে সম্মান ও গর্ব করার সুযোগ দিচ্ছেন। আপনি তাকে দান করছেন না। আপনি কাউকে কিছু এমনিতেই দিয়ে বলছেন না, “যেখানে আছো থাকো। আমি তোমাকে কিছু দিলাম এবং এতে আমার খুব ভালো লাগছে।”’ গত জানুয়ারিতেও এমন কিছু বলেছিলেন ইনফান্তিনো, ‘আমাদের উচিত সুযোগ দেওয়া, সম্মান দেওয়া, দান নয়। পুরো বিশ্বকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিতে হবে।’

বিশ্বকাপের কথা চিন্তা করে মিউজিয়ামও বানিয়েছে কাতার
ছবি: টুইটার

ইনফান্তিনোর এই সম্মান ও গর্বের ডাক শুনেও সন্তুষ্ট হননি সঞ্চালক, ‘বিশ্বকাপ ফুটবল যে স্টেডিয়ামে খেলা হবে সেগুলো নির্মাণেও?’ অর্থাৎ স্টেডিয়াম নির্মাণে শ্রমিকদের নির্যাতন করার বিষয়টি এই যুক্তিতে মেনে নিচ্ছেন কিনা ইনফান্তিনো। ফিফা সভাপতি সব সন্দেহ উড়িয়ে দিয়েছেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। কারণ, এর মাধ্যমে যদি ১৫ লাখ মানুষের অবস্থা বদলানো যায়, তাহলে তো সেটা গর্বের ব্যাপার।’ ইনফান্তিনো গার্ডিয়ানের প্রকাশিত প্রতিবেদনের পক্ষে–বিপক্ষে কিছু বলেননি। তাঁর দাবি, স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত মৃত শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ৩।

ইনফান্তিনোর দাবি, বিশ্বকাপের কারণে, কাতারে কাজ করা ১৫ লাখ শ্রমিকের কাজের পরিবেশে উন্নতি এসেছেন, ‘৬ হাজার মানুষ হয়তো অন্য কাজে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর ফিফা তো বিশ্বে পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে না বা বিশ্বে যা–ই ঘটে, তার দায় ফিফার নয়। কিন্তু ফিফার কারণে আমরা কাতারে কাজ করা ১৫ লাখ শ্রমিকের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পেরেছি।’