মানিবল: টাকার খেলায় কম টাকার জয়

ওকল্যান্ড অ্যাথলেটিকসের অবিশ্বাস্য সেই মৌসুম খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আমেরিকান লেখক ও অর্থবিষয়ক সাংবাদিক মাইকেল লুইস। টানা ২০ জয়ের ইতিহাস এবং আমেরিকান লিগ ওয়েস্ট অঞ্চলে প্রথম, সেটাও অন্য সব বড় দলের তুলনায় অর্ধেকের কম টাকায় দল গড়ে; বেসবলের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা ওকল্যান্ডের সেই মৌসুম নিয়ে ‘মানিবল: দ্য আর্ট অব উইনিং অ্যান আনফেয়ার গেম’ নামে ২০০৩ সালে বই প্রকাশ করেন লুইস।

আরও পড়ুন

এই বই অবলম্বনেই আট বছর পর হলিউডে মুক্তি পায় ‘মানিবল’। শুধু বেসবল নয়, অন্য সব খেলার ভক্তদেরও কাছেও সিনেমাটি বেশ পছন্দ হওয়ার কারণও খুব চেনা। ‘আন্ডারডগ স্টোরি’—অর্থাৎ, কেউ গোনায় ধরেনি, এমন জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। আর সেটাও যদি হয় সাফল্যের বৈপ্লবিক কোনো সূত্র আবিষ্কার করে, তাহলে দর্শকের মনে দাগ কাটবেই। মাত্র ৫ কোটি ডলার প্রযোজনা বাজেট নিয়ে ১১ কোটির বেশি আয় বলে দেয় মানিবল বক্স অফিসে সাফল্য তো পেয়েছেই, খেলাধুলা নিয়ে বানানো সিনেমার জগতে ‘ক্ল্যাসিক’ মর্যাদাও পেয়ে গেছে। এ বছর নিউইয়র্ক টাইমসের ‘একুশ শতকের সেরা ১০০ সিনেমা’র তালিকায় মানিবল ৪৫তম।

সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রাড পিট
আইএমডিবি

ফরাসি বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক ও ঐতিহাসিক জ্যাক ব্রাজুন তাঁর ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘গডস কান্ট্রি অ্যান্ড মাইন’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘আমেরিকার হৃদয় ও মনকে জানতে হলে বেসবল শিখতে হবে…।’ ওকল্যান্ড অ্যাথলেটিকসের জেনারেল ম্যানেজার বিলি বিনের (অভিনয়ে ব্র্যাড পিট) মাধ্যমে সেই হৃদয় ও মনের ‍দুর্দমনীয় প্রকাশ ঘটিয়েছেন পরিচালক বেনেট মিলার। যদিও শুরুতে পরিচালনার কথা ছিল স্টিভেন সোদেরবার্গের। চিত্রনাট্য নিয়ে সনির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সোদেরবার্গের জায়গায় ‘কাপোতে’ পরিচালককে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

স্বল্প বাজেটের দল ওকল্যান্ড ২০০১ সালের মৌসুমে কিন্তু খারাপ করেনি। আমেরিকান লিগ ওয়েস্টে দ্বিতীয়, ডিভিশন সিরিজে মেজর লিগ বেসবলের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী ও সফল দল নিউইয়র্ক ইয়াঙ্কিসের কাছে হেরে যায়, যে ম্যাচটি দিয়ে সিনেমার শুরু। টাকার অঙ্কে দুই দলের শক্তির তারতম্যটা দেখানো হয় জায়ান্টস্ক্রিনে। ১১ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের দল বনাম ৩ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের দল। বেসবলে অবিশ্বাস্য প্রতিভা নিয়ে জন্মেও কিছু করতে না পারা বিলির মাথায় বিষয়টি ধরা পড়ে অন্যভাবে। ‘আনফেয়ার গেম’! যে দলের টাকা বেশি, সাফল্যও তাদের। এমন কিছু বের করতে হবে, যেখানে স্বল্প বাজেটের মধ্যেও বড় দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব।

ব্রাড পিটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন জোনা হিল
আইএমডিবি

ক্লিভল্যান্ডে খেলোয়াড় বিকিকিনি করতে গিয়ে বিলি এক ‘রত্ন’ খুঁজে পায়। পিটার ব্র্যান্ড, ক্লিভল্যান্ডের দলবদল বিভাগে সে কাজ করে। এই তরুণের সঙ্গে নিজের দর্শন মিলে যাওয়ায় ব্র্যান্ডকে ওকল্যান্ডে নিয়ে আসে বিলি। শুরু হয় এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। বেসবল নিয়ে স্কাউটদের শত বছরের দর্শন ও ঐতিহ্যকে এক পাশে সরিয়ে বিলি ও পিটার শুধু পরিসংখ্যানে তাকিয়ে এমন কিছু খেলোয়াড় খুঁজে বের করে, যারা আসলে যোগ্যতা অনুযায়ী অতটা ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারেনি। এককথায় ‘আন্ডারভ্যালুড’ কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যকর হতে পারেন। কী হয়েছিল তারপর? বিলি ও পিটার কি খুব সহজেই সবাইকে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন

সিনেমা এগিয়ে চলার সঙ্গে বিলি ও পিটার যেসব উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যান, সেসবের চিত্রায়ণে যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন বেনেট মিলার। বেশি কিছু ‘ক্লাচ মোমেন্ট’ এবং আবহসংগীত একদম যথার্থ। এমনকি রবিন রাইটের মতো অভিনেত্রীর বিলির স্ত্রী হিসেবে খুব অল্প সময়ের উপস্থিতিও চিত্রনাট্যের সঙ্গে মানানসই। কারণ, বেসবল নিয়ে মানুষের প্রচলিত হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে বিলির মনের ভেতর যে জেদকে বের করার প্রয়োজন ছিল, ব্র্যাড পিট তা খুব ভালোভাবেই পেরেছেন। অস্কার ও গোল্ডেন গ্লোবে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

ওকল্যান্ড অ্যাথলেটিকসের কোচের ভূমিকায় আছেন ফিলিপ সিমুর হফম্যান
আইএমডিবি

ঐতিহাসিকভাবে সত্য এমন দু-একটি চরিত্র চিত্রনাট্য থেকে বাদ দেওয়ায় মানিবল নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। ওকল্যান্ডের তখনকার ম্যানেজার আর্ট হাওয়ারকে যেভাবে চিত্রায়ণ করা হয়েছে, সেটা নিয়ে তিনি নিজেই আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ সমালোচকের মতে, খেলাধুলায় সাফল্যের পরিচিত একটি গল্পটই এত ধারালো, মজার ও আবেগময় করে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা দর্শকের মন কেড়ে নেয়।

খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই সিনেমায় যে তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়েছে, তাকে বলা হয় ‘স্যাবেরমেট্রিকস’। আমেরিকান লেখক, ঐতিহাসিক ও পরিসংখ্যানবিদ বিল জেমস এর নামকরণ করেন। এই পদ্ধতি মানিবল নামেও পরিচিত, যা সিনেমায়ও বলা হয়েছে।

মানিবল (২০১১):

পরিচালক: বেনেট মিলার

চিত্রনাট্য: স্টিভেন জাইলিয়ান, অ্যারন সোরকিন।

অভিনয়: ব্র্যাড পিট, ফিলিপ সিমুর হফম্যান, জোনা হিল, রবিন রাইট।

আইএমডিবি রেটিং: ৭.৬/১০

রানটাইম: ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট