‘টিটির মুবেল ভাই’ যা পারেননি, সেটাই করে দেখাচ্ছেন তাঁর দুই মেয়ে
রংপুরের নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়ায় আব্দুর রাজ্জাককে একনামে সবাই চেনেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি ‘টিটির মুবেল ভাই’ হিসেবে পরিচিত। নিজে টেবিল টেনিস খেলে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পেয়ে হয়েছেন কোচ, দুই মেয়ে রায়তা চৌধুরী ও রাফিয়া চৌধুরীকেও বানিয়েছেন টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। রায়তা–রাফিয়ার মা নাদিরা ইসলামই–বা বাদ যাবেন কেন! তিনিও জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে জিতেছেন পদক।
আশির দশকের শুরুর কথা। দেশের আর দশ জেলার মতো রংপুরেও তখন ফুটবল নিয়ে মাতামাতি। তার মধ্যেও টেবিল টেনিসেই দিনরাত মগ্ন ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। রংপুরে তখন দুটি টেবিল টেনিস ক্লাব—রংপুর টেবিল টেনিস সংস্থা ও সন্ধানী সংঘ। এক দশক সন্ধানী সংঘেই খেলেছেন রাজ্জাক। এরপর যোগ দেন রংপুর টেবিল টেনিস সংস্থায়। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে এখন তিনি কোচ।
১৯৮৭ সালে জাতীয় জুনিয়র টেবিল টেনিসের দ্বৈতে রানারআপ হয়েছিলেন রাজ্জাক। ২০০৮ সালে ২৯তম জাতীয় টেবিল টেনিসে দলগতভাবে হন রানারআপ। জাতীয় পর্যায়ে ততটা সফল হতে না পেরে মন দেন কোচিংয়ে। স্বপ্ন দেখেন দুই মেয়েকে দেশসেরা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় বানানোর, ‘আমার খুব ইচ্ছে ছিল দেশের হয়ে বড় কিছু করা। কিন্তু পারিনি। আমি যেটা পারিনি, সেটা যেন আমার মেয়েরা করে দেখাতে পারে, তাই দুজনকে টেবিল টেনিস শিখিয়েছি।’
যখন থেকে রায়তা-রাফিয়া বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই বাবা তাদের নিয়ে যেতেন টেবিল টেনিস দেখাতে। রাজ্জাকের ছাত্ররা খেলতেন আর রায়তা-রাফিয়া মুগ্ধ চোখে দেখতেন। তখন বল কুড়িয়েই আনন্দ পেতেন। এভাবে টেবিল টেনিস ক্লাবে আসাটাও নিয়মিত হয়ে যায়। বাবা আব্দুর রাজ্জাকের স্বপ্নটাও বড় হতে থাকে। দুই মেয়েকে একটু একটু করে টেবিল টেনিস শেখাতে শুরু করেন। কখনো বাবার সঙ্গে এককে, কখনো জুটি বেঁধে দ্বৈত ইভেন্টে খেলেছেন মেয়েরা।
২০২০ সালে রায়তা আর ২০২১ সালে রাফিয়া বিকেএসপিতে ভর্তি হন। এরপর শুধুই সামনে এগিয়েছেন। রোববার নেপালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ান টেবিল টেনিসের অনূর্ধ্ব-১৫ বালিকা বিভাগের দ্বৈতে ব্রোঞ্জ জিতেছেন রাফিয়া। সেখান থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বললেন বাবার স্বপ্ন পূরণের কথা, ‘বাবা বলেছেন ভালো টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হতে হবে। তাঁর সেই চাওয়া আমরা (দুই বোন) পূরণ করতে চাই।’
অল্প দিনে একাধিক পদক জিতেছেন রাফিয়া। ২০২৩ সালে বিভাগীয় পর্যায়ের দলগত ও দ্বৈত ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি একই বছর যুব গেমসে দলগত বিভাগে ব্রোঞ্জ জেতেন। এ বছর বিকেএসপি কাপে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৬ বিভাগ আর একমি কাপের অনূর্ধ্ব-১৩ বিভাগে সেরার পুরস্কার পান রাফিয়া।
রাফিয়ার বড় বোন রায়তারও অনেক পদক জমেছে। ২০২০ বাংলাদেশ গেমস দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক টেবিল টেনিসে পথচলা শুরু হয়েছিল তাঁর। রায়তা সেবার টুর্নামেন্টের দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জেতেন। ২০২৩ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে একক, দ্বৈত ও দলগত বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন। একই বছর যুব গেমসের দ্বৈত ও দলগততে জেতেন ব্রোঞ্জ। রায়তা এখন আছেন দারুণ কিছুর অপেক্ষায়, ‘বাবা টেবিল টেনিস ছাড়া কিছু বোঝেন না। আমাদের পুরো পরিবারের রক্তের সঙ্গে খেলাটি মিশে গেছে। আমরা টেবিল টেনিসে আসায় বাবা অনেক খুশি। যেদিন দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারব, সেদিন তিনি আরও খুশি হবেন।’
টেবিল টেনিসের প্রতি দুই বোনের এমন ইচ্ছাশক্তি তাদের মা নাদিরাকেও এই খেলায় টেনে এনেছে। ঈদের ছুটিতে যখন পরিবারের সবাই এক হন তখন টেবিল টেনিসেই সময় কাটে তাঁদের। একটা সময় যে নাদিরা টেবিল টেনিসের আলাপ শুনলে বিরক্ত হতেন, এখন প্রায় তিনিই দুই মেয়েকে নিয়ে গল্প জুড়ে দেন। খেলাটাও অনেকখানি রপ্ত করেছেন। ৩৩তম জাতীয় টেবিল টেনিসের দলগত বিভাগে তৃতীয় হন নাদিরা।