হকিতে ‘সম্মানজনক বিদায়’ নাকি ‘বাদ’
ঈদ শেষে এখনো স্বাভাবিক ছন্দ খুঁজে পায়নি ঢাকার নাগরিক জীবন। তবে গুলিস্তান তার চেনা ব্যস্ততা ফিরে পেতে শুরু করেছে। এই ব্যস্ততার মধ্যেও মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে স্টিক-বলের ঠুক–ঠাক শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছাবেই।
ঈদের ছুটি শেষে বুধবার আবার শুরু হয়েছে জাতীয় হকি দলের অনুশীলন। ১৪ এপ্রিল রাতে জাকার্তা রওনা হওয়ার আগ পর্যন্ত চলবে তা। আগামী ১৭ এপ্রিল জাকার্তায় শুরু হতে যাওয়া এশিয়ান হকি ফেডারেশন কাপের জন্য সকাল-বিকেল জাতীয় দলের অনুশীলন চলছে। টুর্নামেন্টটিতে এর আগে চারবার খেলে প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে শিরোপা ধরে রাখার একটা বাড়তি চাপ রয়েছে। কাল অনুশীলন দেখেও সেটাই মনে হলো।
বিকেলের অনুশীলন পর্বের শুরুতেই পেনাল্টি কর্নার নিয়ে কাজ হয়েছে। মাঠের এক প্রান্তে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বিশাল এক বেলুন। সেই বেলুনে যাতে কোনো ছোঁয়া না লাগে, এমনভাবে তার পাশ ঘেঁষে ড্র্যাগ ফ্লিক নিচ্ছিলেন আশরাফুল ইসলামরা। শেষ দিকে হয়েছে নিজেদের মধ্যে অনুশীলন ম্যাচ।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি ৬৩ জনের কুপার টেস্ট দিয়ে শুরু হয় দল নির্বাচনী প্রক্রিয়া। কিন্তু তাতে ডাকা হয়নি দেশের হকির পোস্টার বয় রাসেল মাহমুদ জিমিকে। ৩২ বছর বয়স হলে জাতীয় হকি দলের জন্য কেউ বিবেচিত হবেন না, হকি ফেডারেশনের বর্তমান অ্যাডহক কমিটি অদ্ভুত এই সিদ্ধান্ত কম বিতর্ক ছড়ায়নি। ৩৮ বছর বয়সী সাবেক অধিনায়কও বাদ পড়েছেন বয়সের অজুহাতেই।
তাতে জিমির ২২ বছরের আন্তর্জাতিক হকি ক্যারিয়ারে নীরবেই হয়তো দাঁড়ি পড়ে গেল। কে জানে সাবেক অধিনায়ক সারওয়ার হোসেন আর মিলন হোসেনের ক্যারিয়ারও শেষ কি না! সারওয়ার জাতীয় দলে আসেন ২০১২ সালে ও মিলন ২০১৪ সালে।
৬৩ জন থেকে ধাপে ধাপে কমিয়ে ২৯ মার্চ ২৪ জনের দল চূড়ান্ত করা হয়। তাতে এই দুই সিনিয়র নেই। জাতীয় দলে ফরোয়ার্ড মিলনের সর্বশেষ টুর্নামেন্ট ২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস। সারওয়ার অবশ্য ছিলেন না তাতে। টিম ম্যামেজমেন্টের দাবি, জিমির মতো যাঁদের বয়স নয়, তাঁদের বাদ পড়ার কারণ পারফরম্যান্স।
মিলনকে অবশ্য শেষ পর্যন্ত দলে রাখারই চেষ্টা হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু তাঁর জায়গায় অনূর্ধ্ব-২১ দলের ফরোয়ার্ড ওবায়দুর রহমান জয়কে ‘খুব ভালো’ মনে হয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টের। নতুন মুখ হিসেবে নাইমউদ্দিনের ভাই আবেদউদ্দিনও ঢুকতে পারেন জাতীয় দলে।
পুরোনোদের জায়গায় নতুনরা আসবেন, এটাই চিরন্তন রীতি। একই সঙ্গে হকি ফেডারেশন চাইছে, পুরোনোর বিদায়টা যেন সম্মানজনক হয়। কাল বিকেলে দলের অনুশীলন দেখতে দেখতে ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ও জাকার্তা সফরে দলের সহকারী ম্যানেজার আবু জাফর তপন বললেন, ‘দলে কারও অবস্থান নড়বড়ে হলে আমরা তাদের সিগন্যাল দেব। এই দুজনকে আমরা সিগন্যাল দিয়েছি যে তোমাদের পারফম্যান্সে আমরা সন্তুষ্ট নই। তোমরা তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে পার। আমরা চাই, একজন খেলোয়াড়ের বিদায়টা যেন সম্মানের হয়।’
আক্ষেপের মধ্যে ভালো খবর হলো, এবার খেলোয়াড়দের দৈনিক খাওয়া খরচ কিছুটা বেড়ে ৬৫০ টাকা হয়েছে। দলে এই প্রথম ম্যাসিওর দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এই দুই খেলোয়াড়কে ফেডারেশন থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা যেন নিজেরাই চিঠি দিয়ে ক্যাম্প থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর দুজনই ফেডারেশনকে পারিবারিক সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি দিয়ে ক্যাম্প ছেড়েছেন। তাঁদের বিদায় হয়েছে সমঝোতার ভিত্তিতে। এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে দুজনকের কেউই ফোন ধরেননি।
হকির জাতীয় দলে থাকার ক্ষেত্রে বয়সটা যখন বড় বিবেচ্য হয়ে উঠেছে, ঠিক তখন ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে বড় দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন পুস্কর খীসা মিমো। ৩২ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড এবার জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব পেতে পারেন বলে জানিয়েছে সূত্র। দলের সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড় রাঙামাটির ছেলে মিমোকেই অধিনায়ক হিসেবে বেশি পছন্দ কর্মকর্তাদের।
২০০৯ থেকে জাতীয় দলের হয়ে মাত্র তিনটি টুর্নামেন্টে খেলেননি মিমো, খেলেছেন শতাধিক ম্যাচ। ২০১৭ সালে ঢাকায় এশিয়া কাপে ছিলেন সহ–অধিনায়ক। কাল অনুশীলনের ফাঁকে এই প্রতিবেদকে তিনি বলেন, ‘জাতীয় দলে অধিনায়ক হওয়া বড় সম্মানের। অধিনায়কত্ব পেলে সেটা আমার ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে পূর্ণতা আনবে।’
তবে জাকার্তা যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দলেরই একটা অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে। বিদেশি কোনো দলের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা হয়নি তাদের। অথচ জাকার্তায় বাংলাদেশের মূল প্রতিপক্ষ ওমান গতকাল পাকিস্তান সফরে গেছে। পাকিস্তান জাতীয় দলের সঙ্গে তাদের চারটি ম্যাচ খেলার কথা।
ফেডারেশন কর্মকর্তাদের দাবি, আর্থিক সংকটের কারণেই বাংলাদেশ দলের জন্য সেরকম কিছুর ব্যবস্থা করা যায়নি। এমনকি জাকার্তা গিয়ে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার চেষ্টায়ও নাকি সাড়া মিলেছে না। বাংলাদেশের প্রস্তাবে ‘না’ বলে দিয়েছে সিঙ্গাপুর। আগ্রহ দেখাচ্ছে না উজবেকিস্তানও। কোচ মামুন উর রশিদ বলছেন, ‘ক্যাম্পে সবকিছু ঠিক আছে। স্থানীয় দলের সঙ্গে অনুশীলন ম্যাচ খেলেছি। কিন্তু বিদেশি দলের সঙ্গে খেলতে পারলে ভালো হতো।’
এই আক্ষেপের মধ্যে ভালো খবর হলো, এবার খেলোয়াড়দের দৈনিক খাওয়া খরচ কিছুটা বেড়ে ৬৫০ টাকা হয়েছে। দলে এই প্রথম ম্যাসিওর দেওয়া হয়েছে। আগে দলের স্টাফসংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ তিন থেকে চারজন। এখন সংখ্যাটা বেড়ে ছয়— প্রধান কোচ, সহকারী কোচ, ট্রেইনার, ফিজিও, ভিডিও অ্যনালিস্ট, ম্যাসিওর। শেষের জন ছাড়া বাকি পাঁচজনই যাবেন জাকার্তায়।