হকিতে তবুও সেমিফাইনালের সাহসী স্বপ্ন

এশিয়াডে কঠিন সব প্রতিপক্ষ। তবু বড় আশা বাংলাদেশ হকি দলেরছবি: প্রথম আলো

‘না, না, না। আমি কিছু বলব না। আমি ইংরেজিতে ভীষণ কাঁচা। দয়া করে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।’

ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতেই কথাগুলো বলে সাংবাদিকদের সামনে থেকে দ্রুত সরে গেলেন ইয়ং কিউ কিম। যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। বিমানবাহিনীর ফ্যালকন হলে ১৪ সেপ্টেম্বর এশিয়াডের জন্য বাংলাদেশ হকি দলের জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠানে এভাবেই সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে যান দলটির দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ।

আরও পড়ুন

সেই তাঁকেই কিছুটা ভিন্ন মেজাজে পাওয়া গেছে পরশু মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামে, গত রাতে চীনের হাংজু রওনা হওয়ার আগে শেষ অনুশীলন সেশনে। দোভাষী ছিলেন না তখনো। ফলে ‘কথা বলব না’, ‘বলব না’ বলেও শেষতক একটু মুখ খুলেছেন। অনভ্যস্ত ইংরেজিতে বললেন, ‘আমি তো হাই হোপ নিয়ে যাচ্ছি এশিয়ান গেমসে। সেমিফাইনালে খেলতে চাই।’ সেমিফাইনালে খেলার কথা গত ৩ আগস্ট প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেই বলেছেন। জানার ইচ্ছা ছিল, বাস্তবতা মাথায় রেখে শেষক্ষণে নিজের লক্ষ্যে কোনো বদল এনেছেন কি না। উল্টো তাঁর মুখে আরও উচ্চাশা, ‘আমি তো ফাইনালও খেলতে চাই।’ শুনে পাশে বসা তিন সহকারী কোচের একজন মিটিমিটি হাসছেন। বলে কী!

কিন্তু কিমের মধ্যে রসিকতার কোনো লক্ষণ নেই। বরং পরিশ্রম করলে যে অনেক বড় কিছু করা সম্ভব হকি দলের, সেটা বোঝাতে বলে যান, ‘আমি প্রতিদিন প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে দেখি, ঢাকার রাস্তায় রিকশাচালকেরা নেমে পড়েছেন। কী কঠোর পরিশ্রমই না করেন তাঁরা। বাংলাদেশের হকি খেলোয়াড়েরা (জার্সিতে লাল-সবুজ লোগো দেখিয়ে) দেশের জন্য খেললে অনেক কিছুই সম্ভব। বাংলাদেশের জনগণের পয়সায় আমি বেতন পাই। কিছু দিতে চাই এ দেশকে। তাই হাই হোপ নিয়েই যাচ্ছি।’

হকি দল নিয়ে অনুশীলনে কোচ
ছবি: প্রথম আলো

এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের ষষ্ঠ হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। আপাতদৃষ্টে তাই মনে হতে পারে, ক্লাসের ষষ্ঠ ছেলে তো চতুর্থ হতেই পারে। এ আর এমন কঠিন কী! কিন্তু এশিয়ান হকির হিসাবটা আলাদা। সেখানে সেরা কয়েকটি দলের স্থান পাটিগণিতের সরল অঙ্কের মতো মোটামুটি নির্দিষ্টই। সেটিকে বদলানোর সাধ্য অন্যদের নেই বললেই চলে। সেই অন্যদের মধ্যে আছে বাংলাদেশও। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে নিজেদের প্রথম ও ২০১৮ সালে জাকার্তায় সর্বশেষ এশিয়াডে ষষ্ঠ হওয়াই বাংলাদেশের সেরা অর্জন। এ ছাড়া কখনো সপ্তম, কখনো অষ্টম, দুবার নবমও হয়েছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন

এ–ই যখন অতীত খতিয়ান, উচ্চাশার আসলে জায়গা কোথায়! গতবারের ষষ্ঠ স্থান ধরে রাখতে পারাই ঢের ভালো ফল মনে হচ্ছে। কিন্তু সেটাও কঠিন। কারণ, গ্রুপিংয়েই এবার ‘সর্বনাশ’ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পড়েছে ভারত, পাকিস্তান, জাপানের সঙ্গে। এশিয়াড হকিতে পাকিস্তান সোনা জিতেছে আটবার, ভারত তিনবার। জাপান চ্যাম্পিয়ন একবার, সেটাও সর্বশেষ ২০১৮ জাকার্তায়। এই ত্রয়ীর কাছে হারই ভবিতব্য বাংলাদেশের। উজবেকিস্তান আর সিঙ্গাপুরের সঙ্গে হয়তো জয় আসবে।

কিন্তু গ্রুপে দুই জয়ে ষষ্ঠ হওয়া যাবে না। গতবার পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার পেছনে থেকে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ খেলে পঞ্চম স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। তাতে ৭-০ গোলে হেরে বাংলাদেশ ষষ্ঠ হয়। কিন্তু এবার গ্রুপে সম্ভবত চতুর্থ হতে হবে। চতুর্থ হলে সপ্তম স্থানের লড়াইয়ে পাওয়া যাবে অন্য গ্রুপের সম্ভাব্য চতুর্থ দল ওমানকে। এই ওমানও এখন বাংলাদেশের জন্য শক্ত প্রতিপক্ষ, যাদের হারানোর নিশ্চয়তা নেই। ফলে অষ্টম হয়ে যাওয়ারও শঙ্কা আছে।

কোরিয়ান কোচের অধীনে এই প্রথম খেলবে বাংলাদেশ
ছবি: প্রথম আলো

তার ওপর এই প্রথম কোরিয়ান কোচের অধীন খেলবে বাংলাদেশ। কিন্তু উপমহাদেশীয় ধারার হকি ছেড়ে কোরিয়ার ‘হিট অ্যান্ড রান’ ঘরানায় যাওয়া ভালো না খারাপ হলো? খেলোয়াড়েরা মানিয়ে নিতে পারবেন এর সঙ্গে? দলের ভেতরই আছে নানা প্রশ্ন। কিছুটা উত্তর পাওয়া যেত বিদেশি কোনো দলের সঙ্গে অনুশীলন ম্যাচ খেলতে পারলে। সেটাও খেলা যায়নি। তাই মাঠে নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আড়াই মাসে গতিনির্ভর একটা দল তৈরি করে সেটিকে পরখ করতে পারলেন না কোচ। চার নবীনকে সুযোগ দিয়ে অধিনায়ক করেছেন রোমান সরকারকে। যাঁর চোখে বাংলাদেশের বড় উন্নতি হয়েছে ফিটনেসে।

আরও পড়ুন

২০ বছর ধরে টানা আন্তর্জাতিক হকি খেলা রাসেল মাহমুদ জিমিও ফিটনেসে উন্নতি দেখছেন। উজবেকিস্তান ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ‘ইনশা আল্লাহ আমরা জিতব’ বলে আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে সঙ্গে যোগ করলেন, ‘কিন্তু ভারত, পাকিস্তান ও জাপানের সঙ্গে ম্যাচ তিনটি অনেক অনেক কঠিন হবে। এই এশিয়াড আমাদের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জই। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা হারের আগে হারব না।’

জিমির এই প্রত্যয়ই এশিয়াড অভিযানে বাংলাদেশ হকি দলের ‘থিম সং’।