হিটলার, মুসোলিনি, রুজভেল্ট তুচ্ছ যে ঘোড়ার খুরে

প্রথম আলো গ্রাফিকস

দেখলে রেসের ঘোড়া বলে মনেই হয় না। আকারে বেশ ছোটখাটো। সামনের হাঁটু দুটো একটু ভেতরের দিকে ঢোকানো—অনেকে যাকে বলেন ‘নবি-নি’। রেসের জন্য এমন হাঁটু মোটেও উপযোগী নয়। স্বভাবেও সে বেশ আলসে, দিন কাটে খাওয়া আর ঘুমেই।
অথচ রক্তে তার রেসের নেশা। সে হলো থরোব্রিড জাতের ঘোড়া, যাদের জন্মই ট্র্যাকে ঝড় তোলার জন্য। এরা একটু গরম রক্তের ঘোড়া, গতি আর ক্ষিপ্রতার জন্য যাদের সুনাম।

কিন্তু সিবিস্কিট তেমন ছিল না। অন্তত তিনজন মানুষের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার আগপর্যন্ত তো নয়ই। এই তিনজন—ভাগ্যবিড়ম্বিত এক সফল ব্যবসায়ী, ঘোড়ার এক পোড়-খাওয়া ট্রেনার আর ভাগ্যান্বেষী এক জকি—তাদের হাত ধরেই এল আসল পরিবর্তনটা। সিবিস্কিট রাতারাতি হয়ে উঠল তিরিশের দশকে মহামন্দায় ডুবে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের আশা-ভরসার প্রতীক। খেটে খাওয়া সাধারণ মার্কিনদের ভাগ্য ফেরানোর প্রেরণা!

সিবিস্কিটের আশ্চর্য গল্পটা প্রথম বইয়ের পাতায় তুলে আনেন মার্কিন লেখক লরা হিলেনবার্গ ১৯৯৯ সালে। ঘোড়াপ্রেমী এই নারী ছোটবেলা থেকেই সিবিস্কিটের গল্প শুনেছেন। ১৯৯৬ সালে একটি নিবন্ধের কাজ করতে গিয়ে ঘোড়াটির মালিক ও ট্রেনার সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়ার পর তিনি বই লেখার কাজে নেমে পড়েন। প্রথম দিকে তাঁর ধারণা ছিল, ‘৫ হাজার কপি বিক্রি হলেই খুশি!’

সিনেমার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন (বাঁ থেকে) টবি ম্যাগুইর, ক্রিস কুপার ও জেফ ব্রিজেস
আইএমডিবি

কিন্তু বইটি হয়ে উঠল বেস্টসেলার, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, সারা বিশ্বেই লুফে নেওয়া হলো। তত দিনে ‘আমেরিকান হেরিটেজ’ সাময়িকীতে সিবিস্কিটকে নিয়ে লেখা হিলেনবার্গের প্রবন্ধ, ‘ফোর গুড লেগস বিটুইন আস’, নজরে আসে গ্যারি রসের। হলিউডের অন্যতম ‘গিফটেড স্টোরিটেলার’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া রসও ছিলেন একজন ঘোড়াপ্রেমী। স্ত্রী ও সহযোগী প্রযোজক আলিসন টমাসের সঙ্গে কথা বলে রস সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত নেন।

আরও পড়ুন

রস জানতেন, তিনি এমন একটি চরিত্রকে নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন, হিলেনবার্গের ভাষায় যা ‘১৯৩৮ সালে বেশির ভাগ সংবাদপত্রের কলামের বিষয়বস্তু... বছরের এক নম্বর সংবাদ-উৎপাদক’। হিটলার, মুসোলিনি, এমনকি বেকারত্বের বোঝায় নুয়ে পড়া তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, এফডিআরও তার কাছে ছিল তুচ্ছ! সিবিস্কিট যেন সব ছাপিয়ে গিয়েছিল!

ঘোড়দৌড়ের দারুণ কিছু দৃশ্য আছে সিনেমায়
আইএমডিবি

হিলেনবার্গের ‘সিবিস্কিট: অ্যান আমেরিকান লেজেন্ড’ বই থেকেই চিত্রনাট্যের মূল রসদ নেওয়া হয়। ২০০৩ সালে ‘সিবিস্কিট’ মুক্তি পাওয়ার পর অস্কারের সাতটি বিভাগে মনোনয়ন পায়। যদিও কোনো পুরস্কার জিততে পারেনি, তবু খেলাধুলার সিনেমার ইতিহাসে এটি ‘ক্ল্যাসিক’-এর মর্যাদা পেয়েছে।

প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সময়ে আমেরিকার কাঁধে তখন ৫০ শতাংশের বেশি বেকারত্বের বোঝা। এমন এক পটভূমিতে একটি ঘোড়া কীভাবে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য প্রতীক হয়ে উঠল, রস সেই গল্প বলেছেন অসাধারণ দক্ষতায়। ঘোড়দৌড়ের দৃশ্যগুলো তাতে যোগ করেছে দুর্দান্ত এক মাত্রা।

আরও পড়ুন

তবে গল্পটা শুধু সিবিস্কিটের নয়। হিলেনবার্গ যেমন তাঁর বইয়ে ঘোড়ার মানসিক পরিবর্তনের আড়ালে তিনজন মানুষের গল্প বুনেছেন, রসের সিনেমাও ঠিক তা-ই। গাড়ির ব্যবসায়ী হাওয়ার্ডের চরিত্রে জেফ ব্রিজেস, ট্রেনার টম স্মিথের চরিত্রে ক্রিস কুপার এবং জকি পোলার্ডের চরিত্রে টবি ম্যাগুইর অসাধারণ অভিনয় করেছেন।

সিবিস্কিট ও জকি পোলার্ড। টবি ম্যাগুইর অভিনয় করেন পোলার্ডের চরিত্রে
আইএমডিবি

খেলাধুলার সিনেমার ক্ল্যাসিক কাঠামোতে সাধারণত বড় কোনো প্রতিযোগিতার আগে ধাক্কা খাওয়ার একটা মুহূর্ত থাকে। রসের চিত্রনাট্যেও তা আছে। তবে সিনেমার শুরুটা বেশ ধীরে-সুস্থে। রস প্রথমে মহামন্দার সেই সময়ের বিবরণ এবং মূল তিনটি চরিত্রকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। সেই সময়টা ছিল অটোমোবাইল বিপ্লবের ঠিক আগের মুহূর্ত। সাইকেল ব্যবসায়ী হাওয়ার্ড একদিন এক স্ট্যানলি স্টিমার ঠিক করতে গিয়েই যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পেলেন। সাইকেল ছেড়ে অল্প দিনেই হয়ে গেলেন নামকরা গাড়ি ব্যবসায়ী। কিন্তু জীবনে নেমে এল বিপর্যয়।

জীবনের পথে দেখা হলো স্মিথ ও পোলার্ডের সঙ্গে। ঘোড়া চেনায় পাকা জহুরির চোখ ছিল স্মিথের। তাঁর পীড়াপীড়িতেই শেষমেশ এল সিবিস্কিট। আর এখান থেকেই শুরু হলো সিনেমার মূল রোমাঞ্চকর যাত্রা।

আরও পড়ুন

ঘোড়দৌড়ের দৃশ্যগুলো উত্তেজনায় ঠাসা। গল্পের বিভিন্ন সাবপ্লটকে বিচ্ছিন্ন মনে হয় না। যদিও মূল চরিত্র সিবিস্কিটকে পর্দায় আসতে আসতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায়, তাতে কেউ কেউ হয়তো বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু গল্পের আকর্ষণে একবার ডুব দিলে সেই সময়টা আর টের পাওয়া যায় না। হলিউডের যে কটি খেলাধুলার সিনেমা যুক্তরাষ্ট্রের বক্স অফিসে ১০ কোটি ডলারের বেশি আয় করেছে, ‘সিবিস্কিট’ তার মধ্যে অন্যতম।

এলিজাবেথ ব্যাঙ্কস আছেন বিশেষ এক চরিত্রে
আইএমডিবি

তবে সত্য ঘটনা নিয়ে বানানো এই সিনেমার মূল চরিত্রের আসল ভেলকি লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। সিনেমাটি মুক্তির দিন (২৫ জুলাই, ২০০৩) লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের এক লেখায় বলা হয়, সেই সময় প্রতি তিনজন আমেরিকানের একজন রেডিওতে সিবিস্কিটের রেসের খবর শুনতেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টও। তিনি নাকি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শকদের বসিয়ে রেখে সিবিস্কিটের রেসের খবর শুনতে রেডিওতে কান পাততেন!

সিবিস্কিট (২০০৩):

পরিচালক: গ্যারি রস

চিত্রনাট্য: গ্যারি রস

অভিনয়: জেফ ব্রিজেস, টবি ম্যাগুইর, ক্রিস কুপার, এলিজাবেথ ব্যাংকস।

আইএমডিবি রেটিং: ৭.৩/১০

রানটাইম: ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট

আরও পড়ুন