সাক্ষাৎকারে হাসান মাহমুদ

‘এটা মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছে শিখেছি’

গত বছরের জুলাইয়ে চোট থেকে ফেরার পর দারুণ ছন্দে আছেন হাসান মাহমুদ। টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে দলে এখন নিয়মিত। এ সময়ে ২৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৩১ উইকেট। পাওয়ারপ্লে ও মাঝের ওভার তো বটেই, ইনিংসের শেষের জন্যও হাসানের ওভারগুলো জমিয়ে রাখা হয়।

প্রশ্ন:

ইংলিশ কন্ডিশনে প্রথম খেলেছেন। কী শিখলেন?

হাসান মাহমুদ: বোলিংয়ের জন্য খুবই ভালো। শুনেছি, সামারের এই সময়টা এমনই থাকে। ওইখানে একটা জিনিস দেখেছি, মেঘলা থাকলে খেলাটা এক রকম, মেঘ সরে গেলে আরেক রকম। মেঘ সরে গেলে বোলারদের জন্য আর কিছু থাকে না।

প্রশ্ন:

চোটের কারণে গত এশিয়া কাপ খেলা হয়নি। এরপর অবশ্য টানা খেলছেন। ক্যারিয়ারে এই প্রথম চোটমুক্ত অবস্থায় আছেন। টানা খেলছেন। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

হাসান: ইনজুরি হলো গাড়ি চালানোর মতো। কখন অ্যাক্সিডেন্ট হবে, কেউই জানে না। কখন একটা গাড়ি এসে মেরে দেবে, কে জানে। আপনার গাড়ি ভালো, আপনি ভালো ড্রাইভারও। কিন্তু হুট করেই কিছু একটা হয়ে গেলে আপনার আর কিছু করার থাকে না। আপনি বোলিং করছেন, ফিট আছেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু হুট করেই ইনজুরি হয়ে গেল। তখন কী করার আছে, বলুন! এটা কারও হাতে নেই।

ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

উইকেট নিয়ে একদমই উদ্‌যাপন করেন না। এটার কারণ কী?

হাসান: আগেই একবার বলেছিলাম, ব্যাটসম্যানের উইকেট নিয়েছি। এটাই তো বড় ব্যাপার। আবার উদ্‌যাপন করে তার মন খারাপ করার কী দরকার (হাসি)।

প্রশ্ন:

আপনার কখন মনে হয়েছে, আপনি বড় মঞ্চে ভালো খেলার সামর্থ্য রাখেন?

হাসান: (টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে) অ্যাডিলেডে ভারতের সঙ্গে ম্যাচে। সেদিন ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। বিশ্বকাপের ওই ম্যাচটা ছিল ভারতের বিপক্ষে আমার প্রথম ম্যাচ। খুবই নার্ভাস ছিলাম। ওদের যে স্কোরিং শট, ওরা যেভাবে খেলে, সেটা আপনি না খেললে বুঝবেন না। টিভিতে যতই দেখেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনাকে মেরে রান নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝবেন না। খেলার পরই আপনি বুঝতে পারবেন, কীভাবে বল করলে ওদের আটকানো যাবে।

প্রশ্ন:

কে এল রাহুল আপনার গুড লেংথের একটা বলে কাভার পয়েন্ট দিয়ে ছক্কা মেরেছিলেন। অবিশ্বাস্য শট ছিল সেটা।

হাসান: হ্যাঁ, আমি আগে খেললে হয়তো বুঝতাম যে আউটসুইংয়ের ওপর সে কাভার দিয়ে ছক্কা মারার চেষ্টা করবে। তখন আমি হয়তো তাকে লেগ মিডলে বেশি খেলানোর চেষ্টা করতাম। দেখতাম, সে লেগ সাইডে ফ্লিক করে কি না। এটা খেলার পরই বুঝব, এর আগে না।

প্রতিযোগিতার চাপ নিয়ে খুব একটা
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রতিযোগিতার চাপ অনুভব করেন? অনেক পেসার আছে এখন জাতীয় দলের আশপাশে।

হাসান: দলে আমার একটা দায়িত্ব আছে। সেটা যদি অন্য কেউ করে থাকে, তাহলে ম্যানেজমেন্টের কাছে দুইটা চয়েস থাকবে। প্রতিযোগিতাটা তো এমনই। দিন শেষে পারফরম্যান্সটাই আসল। আমি সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছি।

আমার মনে হয়, ব্যাটসম্যানরা এখনো বুঝতে পারেনি। কারণ, আমার রিস্ট সোজা থাকে। বল নতুন থাকলে আমি সহজেই আউটসুইং করাতে পারি। পুরোনো হলে ওটা পড়ে ভেতরে আসে
হাসান মাহমুদ
প্রশ্ন:

এখন ম্যাচের তিন অবস্থায়ই আপনাকে বল করতে দেখা যায়, পাওয়ারপ্লে, মিডল ওভার ও ডেথে। তিন অবস্থায় আপনার মূল পরিকল্পনা কী থাকে?

হাসান: সর্বশেষ আয়ারল্যান্ড সিরিজের কথা যদি বলি, চেমসফোর্ডের উইকেট খুব ভালো ছিল। কিন্তু কন্ডিশনের কারণে যথেষ্ট সুইংও ছিল। আমি দুই দিকে সুইং করাতে পারি। তাই আমার জন্য কাজটা সহজ হয়েছে। যখন দেখেছি আমার সুইং হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণও আছে; তখন আমি অনেক সাহস পেয়েছি। সাদা বলে যতক্ষণ সুইং থাকে, সেটা প্রথম ৩-৪ ওভারে, সেটা কাজে লাগিয়েছি। এরপর মিডল ওভারে ফিল্ডিং যেভাবে সাজাচ্ছি, সে অনুযায়ী বোলিং করার পরিকল্পনা থাকে। আর স্লগ ওভারে তো বোঝেনই, রান কীভাবে চেক দেওয়া যায়, সেটাই একমাত্র পরিকল্পনা। ওইভাবেই বল করেছি। ইয়র্কার–স্লোয়ার মিক্স করে বা ওয়াইড ইয়র্কারের সঙ্গে স্লোয়ার মিশিয়ে বল করেছি। ১ রান বা ডট দেওয়ার জন্য যে বল করা যায়, সেটা করেছি।

প্রশ্ন:

নতুন বলে সুইং নিয়ন্ত্রণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

হাসান: অতিরিক্ত সুইং হলে কিন্তু এজ হবে না। এজ পেতে যতটা সুইং দরকার, সেটা অনুযায়ী বোলিং করতে হবে। ধরুন, যদি অফ স্টাম্প থেকে সুইং করিয়ে দেখলাম যে বেশি সুইং হচ্ছে, তখন মিডল থেকে সুইংয়ের চেষ্টা করি। তখন জিনিসটা কাভার হয়ে যায়। হয়তো এজও হতে পারে। অনেক সময় লেগ স্টাম্প থেকেও সুইংয়ের চেষ্টা করি। আর যদি কম সুইং করে, তাহলে অফ স্টাম্পের বাইরে রাখার চেষ্টা করি। ফোর্থ বা ফিফথ স্টাম্পে রাখার চেষ্টা করি।

উইকেট পেয়ে হাসান উদ
ছবি: টুইটার
প্রশ্ন:

এটা তো আউটসুইং ডেলিভারির কথা বলছেন। কিন্তু আপনি মূলত ব্যাটসম্যানকে ইনসুইংয়ের জন্য প্রস্তুত করেন।

হাসান: হ্যাঁ, আউটসুইং যদি এজ হয়, তাহলে ভালো। তবে মূলত ইনসুইংয়ে বোল্ড না করে এলবিডব্লুর চেষ্টা করি।

প্রশ্ন:

নতুন বলে আপনার প্যাটার্নটা কেমন, তিনটি আউটসুইং, এরপর একটি ইনসুইং?

হাসান: তিনটাও করি, আবার কিছু সময় পাঁচটা আউটসুইংয়ের পর ইনসুইং করি। কখনো কখনো প্রথম ওভারে কোনো ইনসুইংও করি না। তবে ব্যাটসম্যানের মাথায় কাজ করে যে আমার ইনসুইং আছে। আর সেটা তাদের মাথায় কাজ করে। যে কারণে ব্যাটসম্যানরা ডাবল মাইন্ডে থাকে। তাই সে পুরোপুরি ফরোয়ার্ড হয়ে খেলে না। আমি চাইলে কিন্তু প্রথম বল থেকেই ইনসুইং করাতে পারি। কিন্তু ব্যাটসম্যানের মনে সংশয় সৃষ্টি করার জন্য এটা করি।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

আপনার অ্যাকশন, বল ছাড়া দেখে খুব একটা বোঝার উপায় নেই কখন কোনটা আসতে যাচ্ছে।

হাসান: আমার মনে হয়, ব্যাটসম্যানরা এখনো বুঝতে পারেনি। কারণ, আমার রিস্ট সোজা থাকে। বল নতুন থাকলে আমি সহজেই আউটসুইং করাতে পারি। পুরোনো হলে ওটা পড়ে ভেতরে আসে।

দুই দিকে সুইং করাতে পারেন হাসান
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

মাঝেমধ্যে ওবল সিমও করতে দেখি...

হাসান: হ্যাঁ, বল পুরোনো হলে। যদি মনে হয়, এখন একটা বল বাইরে নেওয়া দরকার, তখন ওবল সিমে করি। আমি যখন ওবল সিম করি, তখন আউটসুইংয়ের শেপে বলটা ধরি। কিন্তু অ্যাঙ্গেল ইউজ করি। তখন সিম পজিশনটা থাকে ফার্স্ট স্লিপের দিকে। কিন্তু অ্যাঙ্গেলের কারণে বল আসে ভেতরে। অনেকটা রিভার্স সুইংয়ের মতো। ব্যাটসম্যান কিন্তু আউটসুইংয়ের সিম দেখছে। কিন্তু বল আসে ভেতরে। আবার কিছু বল আছে সোজা সিমেও ভেতরে আসে।

প্রশ্ন:

আপনি জানেন যে ওই সোজা সিমের বলটা ভেতরে আসবে, নাকি এমনিতেই হয়ে যায়?

হাসান: পুরোনো বলে আমার টার্গেট থাকে ভেতরে আনা। বেশির ভাগ সময় সেটা হয়।
প্রশ্ন: গতিও কিছুটা কমিয়ে এনেছেন। সেটা কি সুইং পাওয়ার জন্য?
হাসান: হ্যাঁ। মানিয়ে নিতে হবে কন্ডিশনের সঙ্গে। নতুন বলে যখন সুইং পাচ্ছি, তখন ১৪০-এ করার দরকার নেই। ১৩৫-এর আশপাশে করাই ভালো। বল পুরোনো হলে পেস একটু বাড়াই।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

ডেথ বোলিংয়ের সময়টায় আপনার বোলিং খুবই সিম্পল। ইয়র্কার আর ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার, তা–ই তো?

হাসান: এই দুইটা মিক্স করি। সেদিন লাস্ট ওভারে যেমন মিক্স করে করেছি। সেদিন যখন মার্ক অ্যাডাইর স্ট্রাইকে ছিল, তখন স্লোয়ার দিয়েছি। কারণ, সে ব্লক হোলের বল ভালো মারছিল। মৃত্যুঞ্জয়কে একবার মেরেছিল, আমাকেও। আমি চিন্তা করেছি, ওকে ব্লক হোলে করব না। সে মেরে দেবে। সামনে মাঠ ছোট। ভেবেছিলাম তাকে পেস ভেরিয়েশন করব। এরপর আমি তাকে ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড মেরেছি।

অধিনায়ক তামিমের বড় ভরসার নাম হাসান
ছবি: টু্ইটার
এটা মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি। উনি এই বলটা করেন। শর্ট লেংথে ফেলে বলটাকে উঁচুতে নিয়ে যান, ব্যাটসম্যানের কাছাকাছি এলে আবার তা নিচু হয়ে যায়। তখন মারতে গেলে টাইমিংয়ে মেলে না। উনি অফ কাটারের মতো মারেন, আমি ব্যাক অব দ্য হ্যান্ডে।
হাসান মাহমুদ
প্রশ্ন:

কিন্তু স্লোয়ারের মধ্যে ব্যাক অব দ্য হ্যান্ডটা সবচেয়ে কঠিন...

হাসান: আমি অনুশীলন করি। এর পেছনে কোনো রহস্য নেই। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি যত বেশি চাপে পড়ি, এই বলটা তত ভালো হয়। চাপের মধ্যেও আমি এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

প্রশ্ন:

শুনেছি দুই রকমের ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার আছে আপনার?

হাসান: একটা কনভেনশনাল সিমে ধরে করি। আরেকটা ক্রস সিমে। সিমে করলে বল পড়ে লাফায়। আবার লাফিয়ে উঠলে মার খাওয়ার চান্স আছে। ক্রস সিমে করলে বলের পেটে পিচ করার চান্স আছে। পেটে পড়লে বল নিচু হয়ে যায়। ব্যাটসম্যানের তখন মারা কঠিন। আবার ক্রস সিম করলে মাঝেমধ্যে সিমেও পিচ করে। তখন আবার বল লাফিয়ে ওঠে।

প্রশ্ন:

ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড থেকে বাউন্সারও মারতে দেখি। এটা কীভাবে সম্ভব?

হাসান: এটা মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি। উনি এই বলটা করেন। শর্ট লেংথে ফেলে বলটাকে উঁচুতে নিয়ে যান, ব্যাটসম্যানের কাছাকাছি এলে আবার তা নিচু হয়ে যায়। তখন মারতে গেলে টাইমিংয়ে মেলে না। উনি অফ কাটারের মতো মারেন, আমি ব্যাক অব দ্য হ্যান্ডে।

ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড থেকে বাউন্সার মোস্তাফিজের কাছ থেকে শিখেছেন হাসান
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

এসব ক্ষেত্রে চিন্তাটা পরিষ্কার থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

হাসান: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি সেদিন শেষ ওভারে (আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে) যখন ভেবেছি স্লোয়ার বল দেব, তখন স্লোয়ারই দিয়েছি। বোলিং মার্কে থাকা অবস্থায় কোনো কনফিউশন ছিল না। আমাকে তামিম ভাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমার যা ইচ্ছা করতে। সেদিন দেখেছেন কি না, জানি না, শেষ ওভারের সময় কেউই আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেনি। এটা একদিক থেকে আমাকে পরিষ্কার চিন্তা করতে সাহায্য করেছে।

প্রশ্ন:

ইয়র্কার নিয়ে আপনার কিছু থিওরি আছে শুনেছি। সেগুলো একটু বলুন...

হাসান: ধরুন, আন্দ্রে রাসেল বা পোলার্ডের মতো ব্যাটসম্যানরা ব্যাট করছে, যাদের মিস হিটেও ছক্কা হওয়ার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া বাকিদের ইয়র্কার করাই যায়। ইয়র্কার মিস হলেও লো ফুলটস মারা কিন্তু কঠিন। ওই বলটা করার ক্ষেত্রে এই ভাবনাটা আমাকে সাহস দেয়। আর এরপরও ডেথে আপনি মার খেতে পারেন। ভালো ইয়র্কারেও চার-ছক্কা হতে পারে। সেটা মেনে নিতে হবে।

প্রশ্ন:

বিশ্বকাপের বছর যেহেতু, এটা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। আপনি কি নিজেকে বিশ্বকাপের দলে দেখেন?

হাসান: এত দূর চিন্তা করি না। দিন ধরে ধরে এগোচ্ছি। যখন বিশ্বকাপ আসবে, তখন দেখা যাবে।

আরও পড়ুন