সাক্ষাৎকারে ইমরানুর

‘অলিম্পিক ফাইনালে দৌড়াতে চাই’

জন্ম ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে, বেড়ে ওঠাও। বাংলাদেশি মা–বাবার সূত্রে লাল-সবুজ বুকে নিয়ে দৌড়ান স্প্রিন্টে। কাজাখস্তানে এশিয়ান ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন ৬০ মিটারে। ২০২৩ সালে সিটি গ্রুপ-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের স্বীকৃতি পাওয়ায় বড় ভূমিকা রেখেছে যে সাফল্য। ১৭ এপ্রিল সেই পুরস্কার অনুষ্ঠানের রাতে ইমরানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর জীবন, তাঁর স্বপ্ন ও আরও অনেক কিছু নিয়ে গল্প করেছেন উৎপল শুভ্র

উৎপল শুভ্র:

শুরুতেই আপনাকে অভিনন্দন। আমি বলব, এটা একটা শুভ পরিবর্তন যে এই প্রথম একজন অ্যাথলেট প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হলেন। কেমন লাগছে?

ইমরানুর রহমান: এটা একটা অসাধারণ অনুভূতি। দেশের এত খেলোয়াড়ের মধ্যে এই পুরস্কারটা জেতা, বিশেষ করে অ্যাথলেটিকসের একজন হিসেবে, যেখানে আমরা এতটা লাইমলাইট পাই না। এটা আমার জন্য, আমার খেলাটার জন্য এবং আমাদের ফেডারেশনের জন্য এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ফেডারেশন আমাকে নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছে, বিভিন্ন টুর্নামেন্টে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠিয়েছে। আমাদের সাধারণ সম্পাদক সব সময়ই খুব সহযোগিতা করেছেন। তাঁকে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না। তিনি আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। কখনো কখনো খারাপ পারফরম্যান্সের পরে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এই সমর্থনটা খুব দরকার হয়। আমি এ জন্য ফেডারেশনের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তারা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। আমি ওদের হয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে দৌড়েছি। অলিম্পিক কমিটি, তারা আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। প্রথমত, সমর্থন, তারপর তারা আমাকে নির্বাচিত করেছে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। আমার দায়িত্ব ছিল তাদের সেই আস্থার প্রতিদান দেওয়া, পদক জেতার চেষ্টা করা।

আরও পড়ুন
উৎপল শুভ্র:

আপনি কি এর আগে বাংলাদেশে প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের মতো এমন কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন?

ইমরানুর: না, এটাই আমার প্রথম।

উৎপল শুভ্র:

কেমন লেগেছে?

ইমরানুর: একটা অন্য রকম অনুভূতি। এই পুরস্কার জেতা, এটা অন্য রকম এক ভালো লাগা। এটা জেতায় মনে হয়েছে, আমি আমার দেশের সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত। এত মানুষের মুখোমুখি হওয়া, তারাও দেখেছে আমি ক্যারিয়ারে কী করেছি এবং সেটার স্বীকৃতি পাওয়া। আমার আবারও মনে হয়েছে, নিজের দেশের জন্য আমি আরও বেশি পদক জেতার চেষ্টা করব। আমি যদি একবার জিতি, তারপর আরও ভালো করার চেষ্টা করব এবং আবার জেতার চেষ্টা করব।

জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ব্যাটসম্যান শাহরিয়ার নাফীসের কাছ থেকে পুরস্কার নেন ইমরানুর
প্রথম আলো
উৎপল শুভ্র:

আপনার গল্পটা আবার শুনতে চাই। আপনি ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে থাকেন। আপনার বাবাই কি ইংল্যান্ডে আপনাদের প্রথম পুরুষ, নাকি তারও আগে পরিবারের কেউ ছিল?

ইমরানুর: বাবা–দাদা একসঙ্গেই। আমার বাবা গিয়েছিলেন আমার দাদার সঙ্গে।

আরও পড়ুন
উৎপল শুভ্র:

আপনার সেখানেই জন্ম?

ইমরানুর: হ্যাঁ, আমার বাবা দেশে ফিরে আমার মাকে বিয়ে করলেন। মা–ও গেলেন তাঁর সঙ্গে। তারপর আমার জন্ম সেখানে।

উৎপল শুভ্র:

আপনার বাবা-মা দুজনই তাহলে সিলেটের?

ইমরানুর: হ্যাঁ, আমার মা কুলাউড়ার; আমার বাবা দক্ষিণ সুরমা, জালালপুরের।

উৎপল শুভ্র:

আপনার ছেলেবেলাটা কেমন ছিল?

ইমরানুর: অন্য সবার মতোই। স্কুলে যেতাম, খেলাধুলা করতাম, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম। আমি দেখতাম, আমার বাবা রেস্তোরাঁয় যেতেন কাজ করতে। আমার দাদার রেস্তোরাঁ ছিল। প্রথমে তিনি কারখানায় কাজ করতেন। পরে নিজেই রেস্তোরাঁ খোলেন, ওটাই আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আসলে আমার ছেলেবেলা আলাদা কিছু ছিল না। পড়াশোনা করতাম। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ফুটবল আমার প্রিয় খেলা, আমি ফুটবল দেখতেও খুব পছন্দ করি। আমি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খুব বড় ভক্ত। যদিও এখন ওরা যেভাবে খেলছে, আমি এই পরিচয়টা লুকিয়ে থাকি।

পুরস্কার হাতে মঞ্চে কথা বলছেন ইমরানুর। পাশে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ব্যাটসম্যান শাহরিয়ার নাফীস এবং অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও প্রথম আলো ক্রীড়া বিভাগের প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র
প্রথম আলো
আরও পড়ুন
উৎপল শুভ্র:

এরিক টেন হাগকে আপনার মোটেই ‘হাগ’ করতে ইচ্ছা করে না, বলছেন?

ইমরানুর: না, না (হাসি)। সত্যি বলতে আমি এখন বুঝতে পারি না তিনি কী করতে চাচ্ছেন। আক্রমণ, বল ধরে রাখা, প্রতি–আক্রমণ, কী করতে চাচ্ছেন আসলে! আপনি দেখবেন না যে ওর দল রক্ষণ সামলাচ্ছে, আবার প্রতি–আক্রমণে যাচ্ছে। আবার যখন শুধু প্রেসিং দরকার হয়, সেটাও করতে দেখি না। তিনিই শুধু জানেন, কী করতে চাচ্ছেন!

উৎপল শুভ্র:

প্রথম কখন বুঝলেন যে আপনি জোরে দৌড়াতে পারেন?

ইমরানুর: স্কুলে, বিভিন্ন খেলার সময়। আমি বুঝতাম আমার মধ্যে অ্যাথলেটিসিজম আছে, আমি দ্রুতগতির। তবে সত্যি বলতে, সেটা স্প্রিন্টের মতো দ্রুত কি না, তখনো বুঝিনি। আমি শুধু জানতাম, আমার বন্ধুদের চেয়ে আমি দ্রুত। তারপর আমি একবার আধা-পেশদার ফুটবল খেলতে গেলাম। সেখানে আমার এক বন্ধু বলল, তুমি স্প্রিন্টে যাও না কেন? তুমি তো বেশ ফাস্ট। আমি একটা স্থানীয় ক্লাবে গেলাম শেফিল্ডে। তখন আমার বয়স সম্ভবত ১৮ বা ১৯। ঠিক মনে নেই।

উৎপল শুভ্র:

ওটা কি অ্যাথলেটিকসের ক্লাব ছিল?

ইমরানুর: হ্যাঁ, অ্যাথলেটিকস ক্লাব। আমি ওদের ওখানে দৌড়ে দেখালাম। ওরা বলল, হ্যাঁ, তুমি খুব দ্রুত। তুমি অনুশীলন করা শুরু করো। সেখান থেকেই আমি নিজেকে তৈরি করা শুরু করলাম, যার ফল আমার এই পর্যন্ত আসা।

উৎপল শুভ্র:

ইংল্যান্ডে কি কিছু জিতেছিলেন?

ইমরানুর: হ্যাঁ, সেখানে আমি স্থানীয় ও ঘরোয়া বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় জিতেছি।

পুরস্কারপ্রাপ্ত সাবেক ও বর্তমান ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে ইমরানুর
প্রথম আলো
উৎপল শুভ্র:

কখন আপনার মনে হলো, গ্রেট ব্রিটেনের হয়ে সুযোগ পাওয়া কঠিন হবে, বাংলাদেশের হয়ে আপনি দৌড়াতে চান?

ইমরানুর: আমি সব সময় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছি, অল্প বয়স থেকেই।

আরও পড়ুন
উৎপল শুভ্র:

সেটা কি অ্যাথলেটিকসে না ফুটবলে?

ইমরানুর: যেকোনো খেলায়। যেমন ইংল্যান্ড যখন বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্রিকেট খেলে, আমি সব সময় বাংলাদেশকেই সমর্থন করি। মানে, বাংলাদেশের সঙ্গে আমার একটা আত্মিক যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। তবে আমি আসলে জানতাম না, কীভাবে আমি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারব, কার সঙ্গে যোগাযোগ করব! তারপর অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব মন্টু ভাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আমি জানতে পারলাম, বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে আমাকে কী করতে হবে। বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে, বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। আমি এই দেশের মানুষের প্রতি টান অনুভব করি। এই দেশের হয়ে খেলতে পারাটা আমাকে আসলে আরও ভালো অ্যাথলেট বানিয়েছে। কারণ, অনেক উঁচু মাপের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছি, যা আমাকে আরও ভালো করার প্রেরণা দিয়েছে।

উৎপল শুভ্র:

আবদুর রকিবের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কীভাবে হলো?

ইমরানুর: তিনি লন্ডনে এসেছিলেন। এটা সম্ভবত ২০১৭ সালের দিকে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সময় হয়তো।

উৎপল শুভ্র:

আপনি কি আগে থেকেই চিনতেন তাঁকে?

ইমরানুর: না, কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয়েছিল। তারপর তিনি আমার খোঁজখবর রেখেছেন, আমি অ্যাথলেটিকসে কী করছি, কেমন করছি। তারপর কাগজপত্রের প্রক্রিয়া শুরু হলো। কারণ, আমাকে প্রমাণ করতে হতো, আমার বাবা-মা বাংলাদেশি। কোভিডের কারণে সেই প্রক্রিয়াটায় দুই বছরের মতো দেরি হয়ে গেল।

উৎপল শুভ্র:

তারপর আপনি বাংলাদেশে এলেন এবং জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে রেকর্ড গড়ে জিতে গেলেন। টাইমিং করলেন ১০.৫০ সেকেন্ড। বৈশ্বিক বিচারে এটা সাধারণই বলা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটা অসাধারণ। তা এখানে এসে যখন অন্য অ্যাথলেটদের দেখলেন, তখন কি মনে হয়েছিল, আমি জিতে যাব?

ইমরানুর: না, সব সময় আমার প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। তাঁরা সবাই কিছু অর্জনের জন্যই চেষ্টা করছিলেন। আমি শুধু আমার নিজের কাজটার প্রতি মনোযোগ দিয়েছি, আমি কী করতে পারি, সেটার দিকে ফোকাস করেছি।

ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানে এক ফাঁকে ফ্রেমবন্দী ইমরানুর
প্রথম আলো
উৎপল শুভ্র:

আপনার প্রতি তাঁদের মনোভাব কী ছিল? একটা ছেলে বাইরে থেকে এল, যে হয়তো আমাদের চেয়েও ভালো, এটা কীভাবে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের বাকি স্প্রিন্টাররা?

ইমরানুর: সত্যি বলতে, তারা আমাকে ভালোভাবে বা খারাপভাবে গ্রহণ করেছে, এমন কিছু না। বলা যায়, যেভাবে গ্রহণ করার সেভাবেই করেছে। আমিও নিশ্চিত ছিলাম না, তারা কী ভাবছে। তারা এখন আমার সঙ্গে খুবই ভালো, এখন ওরা আমাকে চেনে। তারপর আমি যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দলে খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দিলাম, তারা আমাকে অনেক সম্মানের সঙ্গে বরণ করল। আমাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিল।

উৎপল শুভ্র:

সেনাবাহিনীর সঙ্গে আসলে আপনার চুক্তিটা কী রকম? সেনাবাহিনীর হয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেন জানি। কিন্তু আপনি তো শেফিল্ডে থাকেন। সেনাবাহিনীতে কি আপনি কোনো পদ পেয়েছেন বা মাসিক কোনো বেতন পান?

ইমরানুর: তারা আমার অ্যাথলেটিকসের খরচে সহযোগিতা করে।

উৎপল শুভ্র:

সেটা কি মাসিক বেতন দিয়ে?

ইমরানুর: সেনাবাহিনীর অন্যদের সঙ্গে কী ধরনের চুক্তি, তা আমি জানি না। আমার ক্ষেত্রে যেটা, তা হচ্ছে, আমার পারফরম্যান্স দেখে তারা আমাকে একটা আর্থিক সহযোগিতা করে। একটা অঙ্ক, যেটা ১২ মাসে ভাগ করে দেওয়া হয়।

উৎপল শুভ্র:

আপনার ২০২৩ সালের বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল কাজাখস্তানে এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জয়। সেই অনুভূতিটা কি আবার বলবেন একটু?

ইমরানুর: আমি আসলে ওই টুর্নামেন্টে গিয়েছিলাম বড়জোর ফাইনালে যেতে পারব এই ভেবে। র‌্যাঙ্কিং ও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স দেখে একটা বিশ্বাস জন্মেছিল। তারপর প্রথম দৌড়টা শেষে মনে হলো, আমি তো আজ খুব ভালো দৌড়াচ্ছি। তারপর আমি সেমিফাইনালে আমার ক্যারিয়ারের সেরা টাইমিং করলাম, মনে হলো একটা পদক হয়তো পেতে পারি। ফাইনালে যখন গেলাম, আমার মনে হলো পদক পেলে দারুণ ব্যাপার হবে, যেটা আমার দেশের কেউ আগে পায়নি। তারপর যখন সোনা জিতে গেলাম, আমি ঠিক সেই সময়ের অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। তবে এটা একটা অবিশ্বাস্য অনুভূতি ছিল। আমি খুবই খুশি ছিলাম, কারণ বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে এর আগে কেউ এত বড় পদক পায়নি। শুধু অ্যাথলেটিকস না, আমার মনে হয় অন্য সব খেলা মিলিয়েও এত বড় অর্জন নেই।

উৎপল শুভ্র:

শুধু অ্যাথলেটিকসের কথা বললে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল এসএ গেমসে সোনা...

ইমরানুর: হ্যাঁ, আমি তাই এই ইতিহাসের অংশ হতে পেরে দারুণ আনন্দিত। তবে আমি এখানেই থামতে চাই না। আমি আরও বড় কিছু করার চেষ্টা করে যাব।

উৎপল শুভ্র:

ফাইনালে তো আটজন ছিলেন, এর মধ্যে কয়জন র‍্যাঙ্কিংয়ে আপনার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন?

ইমরানুর: তিনজন মনে হয়।

উৎপল শুভ্র:

তাঁদের মধ্যে সেরা ব্যক্তিগত টাইমিং কার ছিল?

ইমরানুর: একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন, কাতারি মনে হয়। আমি ভেবেছিলাম, ওর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আপনি এটা মুখে বলবেন না, কিন্তু আপনি জানেন, কাকে আপনার হারাতে হবে।

ইমরানুর পুরস্কারকে প্রেরণা বানিয়ে যেতে চান অনেক দূর
প্রথম আলো
উৎপল শুভ্র:

একজন অ্যাথলেটের জন্য এ রকম একটা সাফল্য আসলে বড় কিছুর পথে প্রথম পদক্ষেপ ফেলার মতো। আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন, অনেক কিছু সম্ভব এবং এরপর আপনি অন্য রকম একজন অ্যাথলেট হয়ে উঠবেন। এটা তো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, তা–ই না?

ইমরানুর: হ্যাঁ, খেলা আসলে অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। আপনাকে লাইনে দাঁড়ানোর আগে হেরে গেলে চলবে না। আপনার যদি নিজের ওপর বিশ্বাস না থাকে, তাহলে সাফল্য পাবেন না।

উৎপল শুভ্র:

কাজাখস্তানে ওই সোনা জয়ের পর যেভাবে ভেবেছিলেন, ক্যারিয়ারটা কি সেভাবে এগিয়েছে?

ইমরানুর: হ্যাঁ, ক্যারিয়ার ভালোই এগোচ্ছে। আমি প্রতিবছরই আমার ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং ছাড়িয়ে যাচ্ছি। কিছু দৌড় দেখলে হয়তো সেটা মনে হবে না। কিন্তু আপনি যদি শুধু একটা দৌড় না দেখে গ্রাফটা দেখেন, সেটা ওপরের দিকেই যাচ্ছে। আমিও শুধু সেটাই চাই, উন্নতি, উন্নতি এবং উন্নতি।

উৎপল শুভ্র:

আপনার স্বপ্ন এখন কী?

ইমরানুর: আমি অলিম্পিক ফাইনালে যেতে চাই। ওটাই আমার স্বপ্ন। সত্যি বলতে, মানুষ শুধু অ্যাথলেটদের ফলটাই দেখে। তারা ১০-১১ বছরের পরিশ্রমটা দেখে না। আমি এই পর্যায়ে আসতে অনেক পরিশ্রম করেছি, দুটি চাকরি করেছি। তবে আমি সব সময়ই বিশ্বাস করেছি, আমার মধ্যে কিছু একটা আছে। আমি নিজেকে তৈরি করতে, পরিবার চালাতে, দুজন কোচের বেতন দিতে দুটি চাকরি করেছি, তবু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছি। এশিয়ান ইনডোরের পর অবশ্য আমি কিছু সহযোগিতাও পেয়েছি।

উৎপল শুভ্র:

এখন তো আর দুটি চাকরি করেন না?

ইমরানুর: না, এখন একটা চাকরি করি। তবে আমি এমন অ্যাথলেটদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি, যাদের কোনো চাকরি করতে হয় না। তারা পুরোপুরি অ্যাথলেটিকসে সময় দেয়। আপনি ওদের আমার জায়গায় রেখে দেখুন। যদি চাকরিও করতে হয়, আবার খেলতেও হয়….। মাঝেমধ্যে আমি ভাবি, আমি যদি ওদের মতো হতে পারতাম, তাহলে আরও ভালোভাবে সবাইকে দেখাতে পারতাম, আমি কী করতে পারি। তারপরও আমার যা আছে, তা নিয়ে যতটুকু করতে পারি, সেটাই আমার লক্ষ্য।

উৎপল শুভ্র:

এবার তো প্যারিস অলিম্পিকে সোনা জিতলে অ্যাথলেটদের ৫০ হাজার ডলার করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান কো। ঘোষণাটা তো শুনেছেন...

ইমরানুর: শুনেছি। তবে আমি বলব, অলিম্পিকে সোনা জেতাটাই কি যথেষ্ট নয়? আপনি অলিম্পিকে সোনা জিতছেন, আপনার নাম ইতিহাসে লেখা হচ্ছে, সোনা জেতার পর অনেক স্পনসর আসছে। যা হোক, তারপরও তারা প্রাইজমানি দিচ্ছে জেনে আমি খুশি।

উৎপল শুভ্র:

তবে এটা তো শুধু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্টের জন্য। এতে অলিম্পিকে একটা বৈষম্য তৈরি হবে। অন্য খেলার অ্যাথলেটদের মনে হতেই পারে, আমরা জিতে তো কোনো টাকা পাব না। যা–ই হোক, এটা আমাদের সমস্যা নয়, এটা সেবাস্তিয়ান কোর সমস্যা। আপনি তো প্যারিস অলিম্পিকে যাচ্ছেন?

ইমরানুর: হ্যাঁ, আমাকে বলা হয়েছে, কিন্তু এখনো আনুষ্ঠানিক কিছু হয়নি।

উৎপল শুভ্র:

আমাদের দ্রুততম মানবেরা মোটামুটি নিয়মিতই অলিম্পিকে যান এবং তাঁরা নিয়মিতই নিজেদের হিটে অষ্টম হয়ে ফেরেন। এটাই হচ্ছে ইতিহাস। আমি চারটা অলিম্পিক কাভার করেছি। ২০১২ অলিম্পিকে আমাদের দ্রুততম মানব মোহন খানের কথা মনে পড়ছে। নিজের সেরা টাইমিং করেছিলেন, তবে সেটা বৈশ্বিক মান থেকে অবশ্যই অনেক দূরে। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না, দৌড় শেষ করে তিনি আমাকে এসে বলেছিলেন, আমি খুব খুশি। কারণ, এখন আমি ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে আমার টাইমিং জানি। ভাবতে পারেন, অলিম্পিকে যাওয়ার আগে তিনি ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডেই দৌড়াননি!

ইমরানুর: হ্যাঁ, এতে বোঝা যায়, অ্যাথলেটিকসে আরও সহযোগিতা ও মনোযোগ দরকার। এখানে আরও প্রণোদনা দরকার। ধীরগতিতে হলেও তা শুরু হয়েছে। এখন তো ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড আছে।

মঞ্চে শাহরিয়ার নাফীসের সঙ্গে মজাও করেন ইমরানুর
প্রথম আলো
উৎপল শুভ্র:

আপনি যা করছেন, সেটা শুধু আপনার নিজের জন্য নয়, বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের জন্যই দারুণ কিছু। একটা উদাহরণ দিই, আপনি গলফার সিদ্দিকুর রহমানের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। একসময় বাংলাদেশে বনেদি খেলা হিসেবে পরিচয় ছিল গলফের। সিদ্দিক একাই সেটা বদলে দিয়েছেন। তাঁর কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও গলফ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

ইমরানুর: হ্যাঁ, আমি সেটাই করতে চাই। খেলা ছাড়ার পরও বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চাই। যাতে প্রতিভার পরিচর্যা করা হয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়।

আরও পড়ুন
উৎপল শুভ্র:

বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে ফিরি। পুরস্কারের মঞ্চে আমি আপনার সঙ্গে উসাইন বোল্ট-জাস্টিন গ্যাটলিনের দ্বৈরথ নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমি জানি, আপনার বয়সী অ্যাথলেটদের সবাই বোল্টের ভক্ত, যেখানে আপনি কীভাবে জাস্টিন গ্যাটলিনকে এত পছন্দ করেন?

ইমরানুর: বোল্ট অ্যাথলেটিকসের আইকন, আমাকে ভুল বুঝবেন না। তবে গ্যাটলিন আমার প্রথম অলিম্পিক দেখার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। ২০০০ অলিম্পিক আমি সেভাবে মনে করতে পারি না। ২০০৪–ই তাই আমার অলিম্পিকের প্রথম স্মৃতি। সেটিতে গ্যাটলিন যেভাবে জিতেছেন, ওয়াও! যেভাবে ছিটকে বেরিয়েছেন, তাঁর দৌড়ের স্টাইলটা দারুণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন।

উৎপল শুভ্র:

তবে এরপর দারুণভাবে ফিরে এসেছেন...

ইমরানুর: শুধু তা–ই নয়, ফেরার পর নিজের সেরা টাইমিং করেছেন।

উৎপল শুভ্র:

২০০৪ অলিম্পিকে গ্যাটলিনের ১০০ মিটারে সোনা জয় আমি স্টেডিয়ামে বসে দেখেছি। ফিরে আসার পরও দেখেছি তাঁকে। পুরো স্টেডিয়াম তাঁকে দুয়ো দিচ্ছিল। এরপরও এমন পারফর্ম করতে অবিশ্বাস্য মানসিক শক্তি লাগে...

ইমরানুর: সত্যি তা–ই। যেভাবে তিনি ফিরেছেন, ভাবাই যায় না। হ্যাঁ, মানুষ তাঁকে (ডোপ কেলেঙ্কারির জন্য) ক্ষমা করবে না, কিন্তু আমি তাঁকে আবার শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি।

উৎপল শুভ্র:

গ্যাটলিনের সঙ্গে কি কখনো দেখা হয়েছে?

ইমরানুর: আমি তাঁকে দেখেছি ফ্লোরিডাতে, ২০১৫ সালে। অনুশীলনে। আমি যেখানে অনুশীলন করছিলাম, গ্যাটলিনও সেখানেই অনুশীলন করছিলেন। ওইভাবে আলাপ হয়নি। শুধু হাই-হ্যালো।

উৎপল শুভ্র:

বোল্টের সঙ্গে?

ইমরানুর: না, তবে দেখা হলে দারুণ লাগবে।

আরও পড়ুন
উৎপল শুভ্র:

আপনি কি অন্য খেলা ফলো করেন? ফুটবলের কথা তো বললেনই, ক্রিকেট?

ইমরানুর: হ্যাঁ, ক্রিকেট। আমি আমাদের জাতীয় দলের খেলা দেখি।

উৎপল শুভ্র:

সম্প্রতি কোনটা দেখেছেন?

ইমরানুর: আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। গত বছর।

উৎপল শুভ্র:

ও হ্যাঁ, বাংলাদেশ যখন আয়ারল্যান্ড সফরে গেল, আপনি মাঠে গিয়েছিলেন, সেখানে লিটন-নাজমুলদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বললেন। আচ্ছা ইমরান, মানুষ তো অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখে। কখনো কখনো পূরণ হবে না, তা জেনেও। তা আপনার এমন কোনো স্বপ্ন?

ইমরানুর: আমার স্বপ্ন অলিম্পিক ফাইনালে দৌড়ানো। অলিম্পিক ফাইনালে বাংলাদেশের হয়ে কিছু করতে পারা হবে দারুণ ব্যাপার। আমি জানি না, এটা হবে কি না। সব দেশের অ্যাথলেটরাই এই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আমি এই স্বপ্ন দেখে যাব এবং সেটা সত্যি করার চেষ্টা করে যাব। এটা করতে পারলে এই দেশের অ্যাথলেটিকস অন্য পর্যায়ে চলে যাবে।

উৎপল শুভ্র:

সে জন্য কত টাইমিং করতে হবে, তা নিশ্চয়ই ভেবেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিযোগিতায় আপনার সেরা টাইমিং কত?

ইমরানুর: অলিম্পিকের ফাইনালে উঠতে ১০ সেকেন্ড বা এর কমে দৌড়াতে হবে। গত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০.০২ সেকেন্ড টাইমিং করে একজন কোয়ালিফাই করেছে। অলিম্পিকেও এমনই হবে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিযোগিতায় আমার সেরা টাইমিং ১০.১১ সেকেন্ড।

উৎপল শুভ্র:

আপনার বয়স এখন কত?

ইমরানুর: ৩০।

উৎপল শুভ্র:

তার মানে ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকই আপনার শেষ সুযোগ। ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে আর থাকছেন না...

ইমরানুর: এতটা নিশ্চিত হবেন না! গ্যাটলিন ৩৭ বয়সেও দৌড়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সেরাটা এসেছে ৩৭ বছর বয়সে। মেসি-রোনালদোর বয়স ৩৭ আর ৩৯ বছর।

উৎপল শুভ্র:

তাহলে কি ২০৩২ অলিম্পিকেও…

ইমরানুর: (হাসি) নাহ, লস অ্যাঞ্জেলেসেই আমার শেষ।

অনুষ্ঠানে দর্শকদের আসনে ইমরানুর (মাঝে)
প্রথম আলো
উৎপল শুভ্র:

বাংলাদেশের দ্রুততম মানব হওয়ার পর, কাজাখস্তানে সোনা জয়ের পর ইংল্যান্ডে আপনার জীবন কি কিছুটা বদলেছে? লোকজন কি এখন আপনাকে চেনে?

ইমরানুর: হ্যাঁ, কিছু লোক এখন আমাকে চেনে, যাদের বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে।

উৎপল শুভ্র:

ইংল্যান্ডের লোকেরা?

ইমরানুর: অল্প কিছু। তারা ব্রিটিশ অ্যাথলেটদের বেশি চেনে। তবে যারা চেনে, তারা এখন আমাকে একটু বেশি শ্রদ্ধা করে। বলে, ওহ, আজ ইমরান অনুশীলন করবে…

উৎপল শুভ্র:

২০২২ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতে আসার আগেও তো আপনি এসেছেন বাংলাদেশে, তা–ই না?

ইমরানুর: আমি চারবার এসেছি। আমার বয়স যখন ৩ বছর, তখন টানা ১০ মাস ছিলাম, সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। ৯ বছর বয়সে, তখন আবার এসে ৬ মাস ছিলাম। এখন আর এত দীর্ঘ সময় থাকতে পারি না।

উৎপল শুভ্র:

বাংলাদেশ কেমন লাগে? প্রশ্নটা করছি, কারণ দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসী অনেককে দেখেছি, বাংলাদেশের প্রতি কোনো টান অনুভব করে না, কারণ তারা একটা ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠে…

ইমরানুর: আমি সব সময় টান অনুভব করি, অল্প বয়স থেকেই আমার এই যোগাযোগটা ছিল। আমার নানা-নানি বাংলাদেশে থাকেন। তাঁদের প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা। আমার দাদা-দাদি অবশ্য ইংল্যান্ডেই থাকেন। তবে মায়ের পক্ষের আত্মীয়দের দেখতে আসতে হয় আমার। আমি তাদের জন্য টান অনুভব করি, নিজেকে বাংলাদেশের অংশই মনে করি।

উৎপল শুভ্র:

এখন আপনি বাংলাদেশের তারকাও। মানুষের ভালোবাসাটা কি টের পান?

ইমরানুর: টের পাই। এখন আমি রাস্তায় বের হলে অনেকে এসে বলে, ‘ইমরানুর ভাই, একটা ছবি তুলতে চাই…’। দারুণ লাগে।