সাক্ষাৎকারে তানজিদ হাসান

‘রান করলাম, দল জিতল না, এসব রানের কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে’

টি–টোয়েন্টিতে এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ ছক্কা, এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ক্যাচের বিশ্ব রেকর্ড—এ বছর টি–টোয়েন্টিতে বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়েছেন তানজিদ হাসান। সাদা বলের ক্রিকেটে এখন জাতীয় দলের অন্যতম সেরা পারফরমার এই ওপেনার। কাল প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন গত বছরের পারফরম্যান্স, বড় টুর্নামেন্টে ব্যর্থতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদুল হাসান

প্রথম আলো:

 এ বছর কতগুলো রেকর্ড গড়েছেন, দেখেছেন?

 তানজিদ: আমি কখনো রেকর্ডের পেছনে দৌড়াই না। সব সময় একটাই চাওয়া থাকে, কীভাবে বাংলাদেশ দলের জন্য ভালো কিছু করতে পারি।

প্রথম আলো:

ছক্কার রেকর্ডকে তো অন্য একটা পর্যায়েই নিয়ে গেছেন। আগে এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ ছক্কা ছিল ২১টা, আপনি এবার মেরেছেন ৪১টা!

 তানজিদ: ভালো করলে তো ভালো লাগা কাজ করেই। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ বয়ে না বেড়ানোই ভালো। কারণ, আপনাকে সব সময় সামনে তাকাতে হবে। যেটা অতীতে করেছি, সেটা তো করেই ফেলেছি। এটা ভেবে আর লাভ নেই। সামনের বছর কীভাবে এটাকে ছাড়িয়ে যেতে পারব—সেই চেষ্টাটাই থাকবে।

প্রথম আলো:

 আপনাকে দেখে মনে হয় খুব সহজেই ছক্কা মারতে মারেন।

 তানজিদ: আলাদা করে ছক্কার কথা কখনো ভাবি না। কী প্যাটার্নে খেলছি, ছক্কা মারার ক্ষেত্রে এটাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটা জিনিস মাথায় থাকে, যখন জোনে বল পাব, তা যেন ওভার বাউন্ডারি হয়, অন্তত বাউন্ডারি যেন মিস না হয়।

বাঁহাতি ওপেনার তানজিদ হাসান আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি অভিষেকেই ফিফটি করেন
শামসুল হক
আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

 তাহলে ব্যাটিংয়ের সময় আপনার পরিকল্পনা কেমন থাকে?

 তানজিদ: পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। যদি রান তাড়া করি, তাহলে একরকম। যখন প্রথম ইনিংসে ব্যাট করি, তখন হয়তো অন্য রকম। উইকেট কেমন, কত রান এখানে যথেষ্ট হতে পারে, এসবও মাথায় রাখতে হয়।

 আমার একটা জিনিস হলো, যেমন উইকেটেই খেলি, ভাবনা থাকে কীভাবে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে খেলা যায়। পাওয়ার প্লেতে তো ঝুঁকি নিতেই হবে। কারণ, তখন মাত্র দুইটা ফিল্ডার বাইরে থাকে। ওই সময়টায় যত বেশি রান করা যায়। পরে পাঁচটা ফিল্ডার বাইরে যায়, তখন একটু কম ঝুঁকির শট খেলতে হয়। ওই সময়টায় যত রান তোলা যায়। পরে ফিল্ডাররা ছড়িয়ে যায়, তখন একটু কম ঝুঁকি নেওয়া যায়, তবু রানটাকে যতটুকু এগিয়ে নেওয়া যায় আরকি।

প্রথম আলো:

  আপনার অনেক ইনিংস এমন আছে, খুব দুর্দান্ত একটা শুরু পেলেন, কিন্তু হুট করে আউট হয়ে যান। ইনিংসগুলো লম্বা হয় না। এটা কেন হয়?

 তানজিদ: আমার ব্যাটিংয়ে অনেক উন্নতির জায়গা আছে। অনেক ইনিংসেই ভালো শুরু পেয়েও বড় করতে পারিনি, এটা আমাকে অনেক ভুগিয়েছে। এটা নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি, কোচদের সঙ্গে কথা বলেছি—ব্যাপারটা স্কিলের সমস্যা নাকি মানসিক, তা বোঝার চেষ্টা করেছি। এখন বোধ হয় একটু উন্নতি হয়েছে এই জায়গাটায়। চেষ্টা করছি, যেন ভালো শুরুটাকে বড় করতে পারি, এটা দলের ও আমার জন্য ভালো।

প্রথম আলো:

  আপনার টি–টোয়েন্টি অভিষেক গত বছর। এ বছরই এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে যাবেন, এটা কি ভেবেছিলেন?

 তানজিদ: আমার তখনই বেশি ভালো লাগে, যখন আমি রান করেছি, দলও জিতেছে। আমি রান করলাম, দল জিতল না, তখন এসব রানের কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে। আমার সব সময় চোখ থাকে কীভাবে দিন দিন আরও উন্নতি করতে পারি। যেখনে বছরটা শেষ করলাম, সেখান থেকে যেন শুরু করতে পারি। এ বছরটাকেও যেন ছাড়িয়ে যেতে পারি পরেরবার।

তানজিদ হাসান
প্রথম আলো
আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

 একটা ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় নিয়মিতই আপনার উদ্বোধনী জুটিতে সঙ্গী বদলে যায়!

 তানজিদ: আমার কাছে মনে হয়, এটা হয় পুরোপুরি টিম কম্বিনেশনের কারণে। যদি বোঝাপড়াটা ঠিক থাকে, তাহলে এটা কোনো বিষয় নয়। আমার সবার সঙ্গেই তা আছে। কেউ হয়তো একদিন ওপেন করল, আবার তিনে নামছে, এসব হচ্ছে শুধুই টিম কম্বিনেশনের কারণে। অনেকে মনে করতে পারে পারফরম্য্যান্সের কারণে, আসলে তা নয়।

প্রথম আলো:

 জাতীয় দলে সবচেয়ে বেশি ২৩ ইনিংসে আপনি জুটি বেঁধেছেন পারভেজ হোসেনের সঙ্গে। আপনাদের এই জুটি তো অনূর্ধ্ব–১৯ দল থেকেই।

 তানজিদ: মাঠের বাইরে সবার সঙ্গেই বোঝাপড়াটা ভালো, পারভেজের সঙ্গেও। হোটেলে আমরা একসঙ্গে মজা করি, একই রুমে বসে আড্ডা দিই। একসঙ্গে খাবার খেতে বের হই। আমার মনে হয়, এগুলো বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে, মাঠেও তা কাজে দেয়।

তানজিদ হাসান। ২০২০ অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে।
আইসিসি
প্রথম আলো:

অনূর্ধ্ব–১৯ এর কথা এলেই আপনাদের ঘিরে একটা বাড়তি প্রত্যাশার প্রসঙ্গও আসে। সবাই ভাবে, আপনারাই (২০২০ সালে যুব বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়েরা) জাতীয় দলের ট্রফি জিততে না পারার আক্ষেপটা দূর করবেন...

তানজিদ: স্বপ্ন তো সবারই থাকে একটা আইসিসি ইভেন্ট জেতার। আপনি যে খেলোয়াড়কেই জিজ্ঞেস করবেন, বলবে বিশ্বকাপ জিততে চাই। যেহেতু আমরা যুব বিশ্বকাপ জিতেছি, আমাদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। কিন্তু সেটা তো এখন অতীত হয়ে গেছে। এখন আমরা সিনিয়র পর্যায়ে চলে এসেছি। এখানেও একটা ট্রফি জেতার স্বপ্ন আছে। কিন্তু এটার জন্য ধাপে ধাপে এগোতে হবে। যুব বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্ব, কোয়ার্টার, সেমিফাইনাল, ফাইনাল—এভাবেই এগিয়েছি। জাতীয় দলেও ধাপে ধাপে এগোতে পারলে স্বপ্নটাকে ছুঁতে বেশি দিন লাগার কথা নয়।

প্রথম আলো:

 আরেকটা বিষয়—যুব বিশ্বকাপে হয়তো তেমন আলো কাড়তে পারে না, কিন্তু অন্য দেশের ক্রিকেটাররা পরে জাতীয় দলে অনেক ভালো করে। বাংলাদেশে এটা তেমন দেখা যায় না।

তানজিদ: আমি কারও সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। যে যার জায়গা থেকে সেরা। হয়তো আমরা স্কিল বা মাইন্ডসেটে পিছিয়ে আছি। এখানে কীভাবে উন্নতি করতে পারি আর শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটেও ডমিনেট করতে পারি, এদিকেই নজর দিচ্ছি। কারও সঙ্গে তুলনা না করাটাই ভালো।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যত বেশি সম্ভব রান করতে চান তানজিদ হাসান
বিসিবি
প্রথম আলো:

 আপনাকে নিয়ে একটা সমালোচনা আছে যে আইসিসি টুর্নামেন্টে ভালো করতে পারেন না…

 তানজিদ: হ্যাঁ, আমিও তা–ই মনে করি। আইসিসি ইভেন্ট বা এশিয়া কাপে আমি সফল নই, আমার পারফরম্যান্সে আমি নিজেও সন্তুষ্ট নই। বড় টুর্নামেন্টে সামর্থ্য অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারিনি। এটা আমাকেও খুব পীড়া দেয়। আমি এখন ধারাবাহিকভাবে রান করা নিয়েই কাজ করছি। আমি নিজেও এটা নিয়ে সব সময় ভাবি। তবে মাইন্ডসেটটা ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করি। এটা আমার চাওয়া যে বড় টুর্নামেন্টেও যেন ধারাবাহিক রান করে দলকে সাহায্য করতে পারি।

প্রথম আলো:

 আপনি সাদা বলে নিয়মিত। টেস্ট খেলা নিয়ে ভাবনাটা কী?

তানজিদ: আমি বাংলাদেশের হয়ে তিনটা সংস্করণেই খেলতে চাই। চেষ্টা চালিয়ে যাব প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যত বেশি সম্ভব রান করতে। তারপর যদি সুযোগ পাই, তাহলে কেন জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলব না!

প্রথম আলো:

 সব মিলিয়ে তো এ বছরটা ভালোই কাটল। আগামী বছর কোথায় থামতে চান?

তানজিদ: আমি কখনো ভবিষ্যতের চিন্তা করি না। সব সময়ই বর্তমানে থাকার চেষ্টা করি। আমার সামনে কোন সিরিজ আছে, এটা নিয়েই ভাবি। ম্যাচ বাই ম্যাচ কীভাবে নিজের সেরাটা দিয়ে দলকে সাহায্য করা যায়, সেটা ভাবি।

আরও পড়ুন