উইম্বলডনে কেন ‘ভূমিকম্প’

উইম্বলডনে প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ডে যে ধরনের ফল হয়েছে, তাতে ভূকম্পনই অনুভূত হয়েছে টেনিস–বিশ্বে । ৩৬ জন বাছাই খেলোয়াড় বাদ পড়েছেন দ্বিতীয় রাউন্ডের মধ্যে।

শিরোপার খোঁজে নেমে উইম্বলডনের এই ঘাসের কোর্ট থেকেই বিদায় নিচ্ছেন তারকারাউইম্বলডন ওয়েবসাইট

এবার উইম্বলডনের শুরুতেই আলোচনায় ‘ভূকম্পন’। না, খেলার সময় কোর্টের মাটি বা স্থাপনা কেঁপে ওঠেনি। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় রাউন্ডে যে ধরনের ফল হয়েছে, তাতে টেনিস–বিশ্বে ভূকম্পনই অনুভূত হয়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ডের মধ্যেই (একটি ম্যাচ শুক্রবার পর্যন্ত স্থগিত) বাদ পড়ে গেছেন ৩৬ বাছাই খেলোয়াড়। যা টেনিসে নতুন রেকর্ড।

এর আগে তৃতীয় রাউন্ডের আগে সর্বোচ্চ ৩৫ বাছাই বাদ পড়েছিলেন ২০২০ ফ্রেঞ্চ ওপেনে। এবারের উইম্বলডনে দ্বিতীয় রাউন্ডের ভেতরেই বিদায় নিয়েছেন গত মাসে ফ্রেঞ্চ ওপেনের চ্যাম্পিয়ন কোকো গফ ও ছেলেদের তৃতীয় বাছাই আলেক্সান্ডার জভেরভ। শুধু প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েছেন শীর্ষ ১০ বাছাইয়ের আটজন। যা ১৯৬৮ সালে টেনিসে উন্মুক্ত যুগ শুরুর পর সবচেয়ে বেশি।

অবাক করার মতো তথ্য আছে আরও। মেয়েদের শীর্ষ ৫ বাছাইয়ের মধ্যে তৃতীয় রাউন্ডে জায়গা করতে পেরেছেন শুধু র‍্যাঙ্কিংয়ের ১ নম্বরে থাকা আরিয়ানা সাবালেঙ্কা, উন্মুক্ত যুগে এমনটা ঘটল মাত্র দ্বিতীয়বার। প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের উইম্বলডনে এত বেশি ‘তারকা-পতন’ কেন?

বিবিসি এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। যেখানে উঠে এসেছে অন্তত পাঁচটি কারণ।

আরও পড়ুন

অস্বাভাবিক আবহাওয়া

এবারের উইম্বলডনে খেলোয়াড়দের লড়তে হচ্ছে চরম গরমের সঙ্গেও। উইম্বলডনের ইতিহাসে এবারই প্রথম উদ্বোধনী দিনে সবচেয়ে বেশি গরম রেকর্ড করা হয়েছে—সোমবার ও মঙ্গলবার তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। খেলোয়াড়দের বরফের প্যাক, ঠান্ডা তোয়ালে ও প্রচুর পানি দেওয়া হয়েছে পরিস্থিতি সহনশীল করার জন্য। তবু কেউ কেউ শারীরিক অসুস্থতা ও ক্লান্তির কথা জানিয়েছেন। ব্রিটিশ ক্যামেরন নরি যেমন বলেছেন, আবহাওয়া ‘শরীরের জন্য একধরনের ধাক্কা ছিল’।

গরমে ভুগছেন খেলোয়াড়েরা
এএফপি

তীব্র গরমের পাশাপাশি এর প্রভাব ঘাসের কোর্ট এবং বলের মিথস্ক্রিয়াও অনেকের জন্য হতাশার কারণ হয়েছে। প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেওয়া কানাডিয়ান ২৭তম বাছাই ডেনিশ শাপোভালভ বলেছেন, ‘বলগুলো ভয়াবহ, ঘাসের ট্যুর এখন একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এটা আর ঘাসের কোর্টই নয়, এটা এখন মাটির কোর্টের চেয়েও ধীর।’ ধীরগতির কোর্টে খেলোয়াড়দের বল মারার জন্য বেশি সময় পাওয়া যায়, যার ফলে র‍্যালি দীর্ঘ হয় এবং ম্যাচগুলো হয়ে ওঠে শারীরিকভাবে আরও বেশি ক্লান্তিকর।

উইম্বলডনের প্রধান গ্রাউন্ডসম্যান নেইল স্টাবলিও স্বীকার করেছেন, গরমের কারণে ঘাস শুকিয়ে গিয়ে বলকে বেশি আঁকড়ে ধরছে, ফলে কোর্ট ধীরতর হয়েছে।

আরও পড়ুন

ভারী ও ধীরগতির বল

সাবেক চ্যাম্পিয়ন মার্কেতা ভন্দ্রোসোভাকে হারানোর পর ব্রিটিশ নাম্বার ওয়ান এমা রাদুকানু বলের প্রভাব নিয়ে বলেন, নতুন বল দিয়ে একটু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়, তবে কয়েকটা গেম বা লম্বা র‍্যালির পর এই স্লাজেঞ্জার বলগুলো খুব তাড়াতাড়ি ‘ফ্লাফি’ হয়ে যায়, ভারী আর ধীরগতি হয়ে পড়ে। আমি মনে করি, এতে বড় হিটাররা উপকৃত হয়, কারণ তারা শটের জন্য সময় পায় এবং জোরে মারতে পারে।’

অবশ্য উইম্বলডন বলছে, ১৯৯৫ সালের পর বলে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে আবহাওয়ার ভিত্তিতে বলের পারফরম্যান্স ভিন্ন হতে পারে। যেমন গরম ও শুষ্ক দিনে বল হালকা ও দ্রুতগামী হয়, আর ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে দিনে হয় ভারী ও ধীরগতির।

উইম্বলডনে এবার বল একটু ভারী ও ধীরগতির বলে মনে করেন রাদুকানু
এএফপি

ঘাস কোর্টের সংক্ষিপ্ত মৌসুম

আগে থেকেই ঘাসের কোর্টে খেলোয়াড়দের খেলা হয় কম। তবে ইদানীং সমস্যাটা অনেকের জন্য তীব্রতর হয়ে উঠেছে। এবার ঘাসের কোর্টের মৌসুম ৫০ দিনও হচ্ছে না।

ফ্রেঞ্চ ওপেনের মধ্যে জুনের শুরুর দিকে ঘাসের কোর্টের মৌসুম শুরু হয়েছে, শেষ হবে ১৩ জুলাই উইম্বলডন ফাইনাল দিয়ে। ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতার পর কোকো গফ উইম্বলডনের আগে মাত্র একটি ঘাসের কোর্ট টুর্নামেন্টে খেলতে পেরেছিলেন। সেটি ছিল বার্লিন ওপেন, যেখানে তিনি প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েন। ঘাসের কোর্টের সংক্ষিপ্ত মৌসুম নিয়ে উইম্বলডন টুর্নামেন্টের পরিচালক জেমি বেকার বিবিসিকে বলেন, ‘সব গ্র্যান্ড স্লামের মধ্যে এটিই (উইম্বলডন) সবচেয়ে বেশি অপ্রত্যাশিত ফলাফলের ঝুঁকিতে থাকে, কারণ মাটির কোর্ট থেকে ঘাস কোর্টে পরিবর্তনটা খুব দ্রুত ঘটে।’

আরও পড়ুন

খেলোয়াড়দের মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি

ঠাসা সূচি ও ক্লান্তি নিয়ে খেলোয়াড়দের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। উইম্বলডনেও সেটা অব্যাহত। নারী এককের চতুর্থ বাছাই জ্যাসমিন পাওলিনি দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে যাওয়ার পর বলেছেন, ‘আমি এখন মানসিকভাবে একটু ক্লান্ত। এখানে আসার আগে গত দুই মাস ঠাসা সূচির মধ্যে ছিলাম। এখন নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে।’

রাদুকানুর কথায়ও উঠে এসেছে একই বক্তব্য, ‘এটা একেবারেই মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জিং খেলা। আমি যেটা কাজে লাগিয়েছি, সেটা হলো নিজেকে ভালো মানুষদের সঙ্গে ঘিরে রাখা, প্রতিদিন ভালোভাবে পার করার চেষ্টা করা এবং প্রক্রিয়ায় মনোযোগ দেওয়া। কারণ, ফলাফলে আনন্দ নেওয়া খুব কঠিন, এটা কখনো ওপরে ওঠে, কখনো নিচে নামে। একদম রোলার কোস্টারের মতো।’

বিদায়ের পর ক্লান্তি নিয়ে কথা বলেছেন জভেরভ
এএফপি

পুরুষ এককে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নাম হিসেবে বিদায় নেওয়া জার্মানির আলেক্সান্ডার জভেরভও বলেছেন ক্লান্তির কথা, ‘আমি একধরনের গর্তে পড়ে গেছি। কোর্টে খুব একা বোধ করছি। জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনালে সিনারের কাছে হারের পর থেকে মানসিকভাবে লড়ছি।’

ডোমিনো প্রভাব

শীর্ষ বাছাই খেলোয়াড়দের বিদায়ের দৃশ্য কি অন্যদের মধ্যেও একই পরিণতির ভয় তৈরি করছে? বিপরীতে তালিকার নিচের খেলোয়াড়দের কি এটি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে? প্রথম রাউন্ডে এক সেট পিছিয়ে পড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জেতার পর এখনো লড়াইয়ে টিকে থাকা আমেরিকান ষষ্ঠ বাছাই ম্যাডিসন কিসের কথায় তেমনই ইঙ্গিত, ‘আপনি যখন বসে বসে দেখছেন সবাই একে একে হারছে, তখন সেটি বাড়তি চাপ তৈরি করে। আমি নিজেও প্রথম রাউন্ডে খুব কাছাকাছি ছিলাম, তাই মনে হচ্ছে একটু অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি।’ সাবেক ব্রিটিশ নাম্বার ওয়ান জো ডুরিও এমনটাই মনে করেন, ‘আমার মনে হয় সবাই এখন ড্রেসিংরুমে ভাবছে, “এই টুর্নামেন্টে আমারও একটা সুযোগ আছে।” আমি সত্যিই মনে করি, আরও অনেক বাছাই খেলোয়াড় এখনো বিদায় নেবে।’

আমেরিকান ষষ্ঠ বাছাই ম্যাডিসন কিস
এএফপি

আগের ঘাস কোর্ট র‍্যাঙ্কিং পদ্ধতি কি ফিরে আসবে

২০০২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পুরুষ এককের সিডিং নির্ধারণ করা হতো ঘাসের কোর্টে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে। কিন্তু এর পর থেকে সেটিকে নারী বিভাগের মতো বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হচ্ছে। এবারের আসরে যেভাবে শুরুর দিকেই বড়সড় অঘটন ঘটছে, তাতে সেটি কি আগের পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়?

এ বিষয়ে জো ডুরি বলেন, ‘আমি সত্যিই মনে করি, বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত, কারণ ঘাসের কোর্ট সত্যিই অন্য সব কোর্ট থেকে আলাদা। আগের পদ্ধতিটি তখন সময়োপযোগী ছিল। যদি সেটা ফিরিয়ে আনে, তাহলে তা বেশ আকর্ষণীয় হবে।’