পিকের কিংস লিগ: ফুটবল নাকি ফুটবল নয়

জেরার্দ পিকের কিংস লিগের অনেক ম্যাচে লা লিগার চেয়েও বেশি দর্শক হয়এক্স

একবার ভেবে দেখুন তো, আপনি এক গোল করলে সেটিকে দুই গোল বিবেচনা করা হচ্ছে, যত ইচ্ছা বদলি খেলোয়াড় নামাতে পারছেন, এমনকি নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে সং সেজে বা মুখোশ পরেও মাঠে নামতে পারছেন...।

অন্য কোথাও এই নিয়মে ফুটবল হোক বা না হোক, জেরার্দ পিকের প্রতিষ্ঠিত লিগে এভাবেই হয়ে আসছে। বার্সেলোনা ও স্পেনের কিংবদন্তি ডিফেন্ডার পিকে ২০২২ সালে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় বলে দিয়েছেন। এরপর গত বছর তিনি নিজেই একটি ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন, যার নাম ‘কিংস লিগ’।

প্রতিযোগিতাটি এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় স্পেনের সীমানা ছাড়িয়ে যুক্তরাজ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন পিকে। এমনকি এ মাসে কিংস লিগের বিশ্বকাপও আয়োজন করতে যাচ্ছেন। সম্প্রতি বিবিসি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব জানিয়েছেন তিনি।

সাক্ষাৎকারে পিকে বলেছেন, ‘গত বছর এর (কিংস লিগের) প্রথম সংস্করণ ছিল এবং আমরা অসাধারণ সাড়া পেয়েছি। অনেক ম্যাচে লা লিগার চেয়েও বেশি দর্শক ছিল। আমরা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। এ বছর আমরা এটিকে সম্প্রসারণ করেছি। মে মাসে আমরা প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছি। স্পেন ও আমেরিকার দলগুলো বিশ্বকাপে অংশ নেবে।’

তবে স্পেন ও আমেরিকা মহাদেশের বাইরে অন্য দেশের দলগুলোকেও ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে খেলার সুযোগ দেবেন পিকে, ‘আমরা অন্য দেশের দলগুলোকেও খেলার সুযোগ করে দেব। বিশেষ করে যে দেশগুলোয় আমরা শিগগিরই লিগটি চালু করতে চাই। যুক্তরাজ্য সেই দেশগুলোর একটি। রিও ফার্ডিনান্ডও একটি দল গঠন করবে। এ ছাড়া আমাদের নেইমার আছে। ব্রাজিলে ওর মালিকানাধীন একটি দল আছে। ইতালিতে ফ্রান্সেসকো টট্টির একটা দল আছে। এডেন হ্যাজার্ড বেলজিয়ামের একটি দলের হয়ে খেলবে। আমার পরিকল্পনা হলো, বিশ্বকাপ দুই সপ্তাহের মধ্যে শেষ করা, যেহেতু সামনে ইউরো আছে। ওই সময় অন্য কোনো ফুটবল টুর্নামেন্ট নেই। তাই সবাই এটা দেখতে চাইবে।’

কিংস লিগের মজাদার কিছু নিয়ম

৭ জনের দল
১ গোল = ২ গোল
যত খুশি, তত বদলি
চাইলে যে কেউ মুখোশ পরে বা সং সেজে খেলতে পারেন

কিংস লিগ কোন নিয়মে খেলা হয়?

টুর্নামেন্টের দল ১২টি, প্রতিটি দল সবার সঙ্গে একবার করে মোট ১১টি ম্যাচ খেলে। সব ম্যাচই হয় রোববার, বার্সেলোনার একটি ভেন্যুতেই।

প্রতিটি দল নিজেদের স্কোয়াডে ১২ জন খেলোয়াড় রাখতে পারে। সাবেক ফুটবলার, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ইন্টারনেট সেলিব্রিটিদের নিয়ে দল গঠন করা হয়। স্কোয়াডের ১২ ফুটবলারের মধ্যে ১০ জনকে ড্রাফট থেকে বেছে নেওয়া হয়, বাকি ২ জন অতিথি। তাঁদের বেছে নেন দলের সভাপতি। ইকার ক্যাসিয়াস ও সের্হিও আগুয়েরোও দল চালান।

আরও পড়ুন

দুই অর্ধে ২০ মিনিট করে ৪০ মিনিটের ম্যাচ হয়। নির্ধারিত সময় শেষে দুই দল সমতায় থাকলে টাইব্রেকার হয়। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদিনিও, মেক্সিকোর সাবেক স্ট্রাইকার হাভিয়ের হার্নান্দেজ এবং আর্জেন্টিনার সাবেক দুই ফরোয়ার্ড সের্হিও আগুয়েরো ও হাভিয়ের সাভিওলা টুর্নামেন্টের খেলোয়াড়দের মধ্যে বড় নাম।

২০২২ সালে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় বলেন পিকে। গত বছর তিনি কিংস লিগ প্রতিষ্ঠা করেন
এএফপি

গত বছর একজন খেলোয়াড় এনিগমা ছদ্মনামে মুখোশ পরে খেলতে নেমেছিলেন। তখন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল, তিনি বিখ্যাত কোনো ফুটবলার হতে পারেন। কেউ কেউ সেই মুখোশধারী খেলোয়াড়কে রিয়াল মাদ্রিদ ও স্পেনের সাবেক তারকা ইসকো ভেবেছিলেন। তবে সাংবাদিক গিয়েম বালাগে নিশ্চিত করেন, মুখোশধারী সেই ফুটবলার ইসকো নন, কাদিজের সাবেক ফরোয়ার্ড নানো মেসা।

ম্যাচের আগে দুই দল এলোমেলোভাবে একটি কার্ড নির্বাচন করে। প্রতিটি দলের কাছে থাকে একটি গোপন অস্ত্র, যা তারা দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে ম্যাচের ৩৮ মিনিটের মধ্যে ব্যবহার করতে পারে। কার্ড চালু রাখা অবস্থায় একটি দল যেসব সুবিধা পেতে পারে, সেগুলো হলো—

ডাবল গোল: কার্ড ব্যবহার করা অবস্থায় ৪ মিনিটের মধ্যে কোনো দল যদি একটি গোল করতে পারে, তাহলে তা ২ গোল ধরা হয়।

নিষেধাজ্ঞা: একটি দল প্রতিপক্ষ দলের যেকোনো এক খেলোয়াড়কে ৪ মিনিটের জন্য মাঠের বাইরে পাঠাতে পারে।

পেনাল্টি: কার্ড ব্যবহার করে কোনো দল একটি পেনাল্টি নিতে পারে। এই পেনাল্টি টাইব্রেকারের মতো। অর্থাৎ গোলকিপার আর পেনাল্টি শট নিতে যাওয়া খেলোয়াড় ছাড়া আর কারও সম্পৃক্ততা থাকে না।

তারকা খেলোয়াড়: একজন খেলোয়াড়কে একটি বাহুবন্ধনী দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, তিনি তাঁর দলের তারকা খেলোয়াড়। যদি তিনি একটি গোল করেন, তাহলে দুটি গোল বিবেচনা করা হয়। তিনি গোল পাওয়ামাত্রই গোপন অস্ত্র ব্যবহারের সময়সীমা শেষ হয়ে যায়।

ওয়াইল্ড কার্ড: একটি দল অন্য কার্ডগুলোও সক্রিয় করতে পারে, এমনকি প্রতিপক্ষের কার্ড চুরিও করতে পারে।

পিকের কিংস লিগে মাঠের কৃত্রিম ঘাসের রং কালো
এক্স

পিকের মতে, কিংস লিগ শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলেই চলবে না, প্রদর্শনীর মতোও হতে হবে। এ কারণেই অদ্ভূত সব নিয়ম চালু করা হয়েছে। টুর্নামেন্টের নিয়মগুলো কীভাবে করা হয়, সেটাও জানিয়েছেন পিকে, ‘কখনো কখনো টুইটারে (এক্সে) মানুষ ভোট দেয়। যেমন ধরুন, বর্তমানে মাঠের কৃত্রিম ঘাসের রং কালো, দলের সভাপতিরাও ম্যাচে পেনাল্টি নিতে পারেন—এই নিয়মগুলো ভোটের মাধ্যমে পাস হয়েছে। আসলে আমরা নিয়মের পরিবর্তনই চেয়েছিলাম। কারণ, আমরা এমন মজাদার, প্রতিযোগিতামূলক কিছু চেয়েছিলাম, যার মাধ্যমে এটিকে প্রদর্শনী ম্যাচ মনে হবে। ফুটবল হলো সব খেলার রাজা। তবে আমরা এখানে ভিন্নধর্মী উপাদান যোগ করতে চেয়েছিলাম।’

আরও পড়ুন

নিয়মে এত বদল আনার পর সেটা কি আর ফুটবল থাকল? পিকের উত্তর, ‘আপনি যদি মনে করেন, এটা ফুটবল, তাহলে তা–ই। আর যদি মনে করেন, এটা ফুটবল নয়, তাহলে সেটাও ঠিক। এটা ফুটবল, কিন্তু এটা ফুটবল নয়।’