আমার বিয়ের শাড়িটা দেশি

পন্ডস ও নকশার আয়োজনে হয়ে গেল ‘বিয়ের শাড়ি দেশি’ বিষয়ে লেখার প্রতিযোগিতা। সারা দেশ থেকে পাঠকেরা লিখে পাঠিয়েছিলেন লেখা। বিচারকদের মতে সেরা পুরস্কার পাওয়া তিনটি লেখা প্রকাশিত হলো এখানে।

বিচারক শাহনাজ মুন্নী ও বাহার রহমানের সঙ্গে পুরস্কার বিজয়ীরা
বিচারক শাহনাজ মুন্নী ও বাহার রহমানের সঙ্গে পুরস্কার বিজয়ীরা

১ম
জামদানিই সেরা
প্রত্যেক মেয়ের জন্যই বিয়ের শাড়িটা বিশেষ। কিন্তু আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যদি ঝামেলা শব্দটি জড়ায়, তবে কেমন হয়? আমার বিয়ের শাড়ি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল! আরাভও (হবু স্বামী) চিন্তিত। কারণ ও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। কাতান না জর্জেট।
বাবার বাড়ি ঐতিহ্যের পক্ষে, চাইছে কাতান কিনতে। শ্বশুরবাড়ি আধুনিক, চাইছে হাল আমলের টিভি সিরিয়াল ‘বহু’দের জর্জেটের শাড়ি। আমি চাই বিয়ে করতে, যুদ্ধ আটকাতে এবং বিয়ের শুরুটা যেন হয় দুই পরিবারের মজবুত বন্ধনের মধ্য দিয়ে। এখানে পক্ষ নেওয়াটা বিপজ্জনক। আরাভের সঙ্গে আলোচনায় মাথায় ১০০ ভোল্টের বাতিটা জ্বলে উঠল। ও চাইছে শাড়িটা হোক ঐতিহ্যবাহী, ট্রেন্ডি ও জমকালো। এসব গুণ দুই ধরনের শাড়িতে থাকলেও একটি শাড়িতে আছে একসঙ্গে। সেটি জামদানি। সত্যি মনে হচ্ছিল, ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’। সমাধানটি বলার সঙ্গেই দুই পরিবারই একমত। আমার হবু ননদ বলছিল, ‘ভাবি সব জামদানির ডিজাইন একই কিন্তু।’ আমি বললাম, ‘ফ্যাশন হাউসগুলো এখন নিজেদের মতো ডিজাইন করে জামদানি বানাচ্ছে।’ আমার বোন বলল, ‘আপা, এখনকার দিনে কোনো তারকা কি এটা পরতে পারে? ট্রেন্ডের ব্যাপার আছে না।’ আমি বললাম, ‘অভিনয়শিল্পী তিশা তো বিয়েতে জামদানি পরেছেন।’ তখন সবাই সিদ্ধান্ত নিল, জামদানিই কেনা হবে।
বিয়ের দিন দুই পক্ষের আত্মীয়রা বলছিলেন, সত্যি দুজনকে দেখতে ভালো লাগছে। দেশি জামদানি শাড়ি আর খদ্দরের পাঞ্জাবিতে যে এত জমকালো লাগতে পারে তা নাকি তাঁরা ভাবতেই পারেননি।
আফসানা নাসরিন
নিউ বেইলি রোড, ঢাকা।

২য়
পুরো সাজটাই লাল অথবা মেরুন রঙে
আমি নেলী সিনিড পাড়ৈ, খ্রিষ্টান মেয়ে। ধর্ম উল্লেখ করলাম, কারণ খ্রিষ্টান বিয়েগুলোতে বিদেশি রীতিতে ওয়েডিং গাউন পরার প্রচলন এ দেশেও আছে। চার্চে বিয়ে পড়ানোর সময় অনেক মেয়েই সাদা গাউন আর লাল ঘোমটা (ভেইল) পরে থাকে। সিনেমা, টিভি অথবা অন্য বিয়েতে ধবধবে সাদা পোশাকে কনেদের দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার শখ ছিল বিয়ের দিন আমি সাজব লাল বেনারসি বা কাতান শাড়িতে। পুরো সাজটাই হবে লাল অথবা মেরুন রঙে।
আমাদের বিয়ের শাড়ি আর আনুষঙ্গিক সব জিনিস আসে ছেলের বাড়ি থেকে। তাই একটু শঙ্কা ছিল মনে যে নিজের শখ যদি না মেলে, যদি শ্বশুরবাড়ি থেকে জর্জেট শাড়ি, গাউন অথবা অন্যান্য বিদেশি শাড়ি দেয়। কিন্তু আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে এ ক্ষেত্রে আমার ছোটবেলার শখ এবং আমার শ্বশুরবাড়ির পছন্দ মিলে গিয়েছিল। আমার বিয়ের শাড়ি কেনার সময় আমি সঙ্গে যাইনি। কিন্তু আমার শাশুড়ি মা, আমার হবু বর এবং তাঁদের এক আত্মীয় মিরপুর বেনারসি পল্লি থেকে আমার বিয়ের যে শাড়িটি কেনেন, সেটা ঠিক আমার মনের মতোই হয়েছিল।
বিয়ের দিন সকালে আমার হবু শাশুড়ি আমাকে বলেছিলেন, তাঁদের বাড়ির সব মেয়ের বিয়েতে বেনারসি শাড়ি দেওয়া হয়েছে। এটা একরকমের পারিবারিক ঐতিহ্য। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি খুশি কি না, আমার শাড়ি পছন্দ হয়েছে কি না। এতই মুগ্ধ ছিলাম যে আমি ওই দিন তেমন কিছু বলতে পারিনি, শুধু বলেছি, ‘বিশ্বাস করেন মা, শাড়িটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।’
অফ হোয়াইট জমিন আর মেরুন পাড় ও আঁচল। তাতে সোনালি সুতার পেটানো কাজ। কী দারুণ সমন্বয়, কী যে সুন্দর মানিয়েছিল আমাকে!
আমি আমার মনের মতো সাজতে পেরে খুবই আনন্দিত এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি আবার কোনো অনুষ্ঠানে আমার বিয়ের শাড়িটি পরব।
নেলী সিনিড পাড়ৈ
গুলশান, ঢাকা।

৩য়
একটি মাত্র নীল বেনারসি পেলাম
আমার কাছে শাড়ি মানে ক্যানভাস। কিন্তু বিয়ের শাড়িটা যেন ছিল একটা গল্প।
গল্পটা বলি। দেশি শাড়ির প্রতি আগ্রহ বাড়ে যখন বস্ত্র প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করি। কিন্তু কেন যেন মিরপুরের বেনারসি শাড়ির সৌন্দর্য কখনো সেভাবে উপলব্ধি হয়নি। ধারণা ছিল, এই শাড়িতে বুঝি আমাকে মানাবে না। দুই বাড়ির গুরুজনদের মধ্যেও কারও কারও ভীষণ অনীহা। কিন্তু দৃঢ় ইচ্ছা ছিল; আর যাই হোক; বিয়ের শাড়িটা বিদেশি চকরাবকরা কোনো জবরজং শাড়ি অবশ্যই হবে না। দেশি শাড়ি হওয়া চাই।
বিদেশি শাড়ির প্রতি আমার বিদ্বেষ আছে এমনটা ভাবলে ভীষণ ভুল হবে। কিন্তু আমাদের শাড়ির শিল্পমর্যাদা যে কত উঁচুতে, সে ধারণা নেই আমাদের অনেকেরই। যা হোক; আমাকে কিন্তু কিনতে হয় একটা বিদেশি শাড়িই! তবে বিয়ের মাত্র ১০ দিন আগে প্রথম আলোতে একটা প্রতিবেদনে ছাপা হয়, আমি যে শাড়িটা কিনেছি, এবার ঈদে সেটাই কিনছে সবাই। আর কী! উদ্বিগ্ন আমার শ্বশুরবাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সেদিনই বেরিয়ে পড়লাম নতুন শাড়ির খোঁজে। এবার অবশ্যই দেশি শাড়ি। বাবার রাজকীয় নীল (রয়েল ব্লু) রংটা প্রিয় ছিল বলে শাড়িটাও সেই রঙেরই চেয়েছিলাম। তিন দিন বেনারসি পল্লি চক্কর কেটে অবশেষে একটি মাত্র নীল বেনারসি পেলাম। আমার নকশা করা ওড়নাটার সঙ্গে এত সুন্দর মিলে গেল! একটু ভিন্নতা আনতে সবুজ পাইপিং আর কিছু সোনালি পাথর বসালাম।
অবশেষে যেদিন শাড়িটা পরলাম সেদিন প্রথম বুঝলাম বেনারসি শাড়ির মর্ম। মনে হচ্ছিল আমার জন্যই বানানো হয়েছে শাড়িটা।
নুসরাত রাইসা আলী
দক্ষিণ কল্যাণপুর, ঢাকা